নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে হবে সবাইকে
কবি গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে মা নিয়ে সেই বিখ্যাত গান- ‘পথের ক্লান্তি ভুলে স্নেহ ভরা কোলে তব/মাগো, বলো কবে শীতল হবো?/কত দূর, আর কত দূর, বলো, মা’। যে মা নিয়ে মানুষের এত আকুতি ও ভালোবাসা অথচ দেশে সেই মায়েদের মৃত্যু ও নবজাতক মৃত্যুহার আশানুরূপভাবে কমলেও এখনো রয়ে গেছে অনেক সমস্যা।
এখনো দেশে ৩৩ শতাংশ প্রসব হয় বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীদের হাতে ঝুঁকিপূর্ণভাবে। ৬১ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা চারবার প্রসব-পূর্ব সেবা পান না। মাত্র ৪৯ শতাংশ মায়ের স্বাভাবিকভাবে সন্তান প্রসব হচ্ছে। অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে প্রসব হচ্ছে ৫১ শতাংশ মায়ের। নবজাতক, এক বছরের কম বয়সী এবং পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু মৃত্যুর হার বেড়েছে। তাই এবারের নিরাপদ মাতৃত্ব দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল, ‘হাসপাতালে সন্তান প্রসব করান, মা ও নবজাতকের জীবন বাঁচান’।
গত ১৪ মার্চ সাফজয়ী নারী ফুটবল খেলোয়াড় রাজিয়া সুলতানা (২১) বাড়িতে সন্তান প্রসবের পর মারা যান। তার মৃত্যুর পর দেশজুড়ে নতুন করে আলোচনায় আসে বাড়িতে সন্তান প্রসবের উচ্চহার, অন্তঃসত্ত্বা নারী ও পরিবারের অসচেতনতা, সরকারি উদ্যোগের অভাব, প্রসব-পূর্ব অন্তত চারবার সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে উদাসীনতার মতো বিষয়। এরকম বহু ঘটনাই আমাদের অজানা থেকে যায়। অজানা থেকে যাওয়ার ফলে এ বিষয়ে সচেতনতাও কম সৃষ্টি হয়।
বাড়িতে সন্তান প্রসবের বিষয়ে সাধারণ মানুষের অসচেতনতার পাশাপাশি কিছু অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত বিষয়ও দায়ী। প্রত্যন্ত অঞ্চলে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো না হওয়ার কারণে অনেক মা-ই নিয়মিত হাসপাতালে এসে ডাক্তার দেখান না। সন্তান প্রসবের সময়ও তারা স্থানীয় ধাত্রীদের ওপর নির্ভর করেন। প্রসবজনিত কোনো জটিলতার সৃষ্টি হলে এসব ধাত্রী তেমন সাহায্য করতে পারেন না। যার কারণে এক সময় গ্রাম দেশে বহু মা ও শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখন এই মৃত্যুর হার অনেক কমলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) থেকে অনেক দূরে। এই লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রতি লাখ জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু ৭০-এর নিচে নামিয়ে আনতে হবে; কিন্তু এখনো অনিরাপদ মাতৃত্ব ও সন্তান প্রসবের কারণে দেশে প্রতি লাখ জীবিত শিশুর জন্ম দিতে গিয়ে ১৩৬ জন মা মারা যাচ্ছেন।
চিকিৎসকদের মতে, একজন অন্তঃসত্ত্বাকে প্রসব-পূর্ব সময়ে অন্তত চারবার চিকিৎসাসেবা নিতে হবে; কিন্তু এই সেবার ক্ষেত্রে শহরাঞ্চলের চেয়ে পিছিয়ে গ্রামের গর্ভবতীরা। এর কারণ সচেতনতা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার সমস্যা। সিএনজিচালিত যান, অটোরিকশায়, নৌকায় বা হেঁটে দূরবর্তী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা হাসপাতালে পৌঁছুতে অনেকেই আলস্য বোধ করেন, কখনোবা তাদের যাত্রাজনিত বিড়ম্বনায়ও পড়তে হয়। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, প্রসবের সময় হাসপাতালে গেলে অনেক ডাক্তারই অপ্রয়োজনীয় সিজারের কথা বলেন, এটা এড়াতেও অনেকে বাড়িতেই স্বাভাবিক প্রসব বেছে নেন। ২০২২ সালে যেখানে দেশে ৪১ শতাংশ মায়ের অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব হতো, সেটা ২০২৩ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫১ শতাংশে। অন্যদিকে, গত এক বছরে বাসা-বাড়িতে অদক্ষ ধাত্রীদের মাধ্যমে সন্তান প্রসবের হার ৯ শতাংশ কমেছে। তার মানে দেখা যাচ্ছে ধাত্রীদের হাতে সন্তান প্রসব কমার পাশাপাশি সিজারের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। এর কারণ কিছু চিকিৎসকের অসাধু-উপায় অবলম্বন।
নিরাপদ মাতৃত্বের স্বার্থে মা ও তার পরিবারসহ সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসক, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে আরও সচেতন হতে হবে। আমরা চাই না একটু অসচেতনতা ও ভুল সিদ্ধান্তের কারণে একজন মায়েরও অকাল মৃত্যু হোক, কোনো শিশুর জীবন হুমকির মধ্যে পড়ুক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে