হরিজন সম্প্রদায়ের মিরনজিল্লা পল্লী উচ্ছেদ সিটি করপোরেশনের বিবেকহীনতার নামান্তর
একটি সমাজের সভ্যতার মাপকাঠি নিরূপণ করা হয় সেখানকার আইনের শাসনের মাধ্যমে। জাতি-ধর্মের পাশাপাশি মানবতা একটা দেশের জন্য বড় জিনিস। সেই মানবতা আর আইনের শাসনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে রাজধানীর বংশালে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের হরিজন সম্প্রদায়ের মিরনজিল্লা পল্লীতে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। এ উচ্ছেদ অভিযানে ক্ষোভে-হতাশায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন একজন। স্কুল ড্রেস পরে স্কুলে যাওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদে যোগ দেয় মানববন্ধনে।
মুখে কালো কাপড় বেঁধে প্রতিবাদী স্লোগান দেন তারা। এই স্লোগান ছিল নিজের ভিটেবাড়ি রক্ষার। কেন চালানো হলো এমন অমানবিক অভিযান? এ প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। গত ১০ জুন বিকেলে এ অভিযান শুরু হয়। যদিও হরিজন সম্প্রদায়ের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস পল্লী উচ্ছেদ না করার আশ্বাস দিয়েছিলেন। এই আশ্বাসকে প্রহসনে পরিণত করে ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়।
তাদের বিকল্প কোনো আবাসনের ব্যবস্থা না করেই দফায় দফায় বস্তি উচ্ছেদ অভিযান চালানোয় নাগরিক সমাজ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। যে বস্তিতে এই উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে, সেখানে বাস করে দেশের দরিদ্রতম হরিজন সম্প্রদায়। তারা কয়েকশ বছর ধরে এই কলোনিতে বসবাস করে আসছেন। নগরবাসীর সেবার জন্য তাদের আনা হয়েছিল। এখন তাদের উচ্ছেদ করে কাঁচাবাজার নির্মাণ করতে চাইছে সিটি করপোরেশন। পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে কাঁচাবাজার নির্মাণের জন্য তাদের উচ্ছেদ করতে হবে কেন? কাঁচাবাজার নির্মাণের জন্য সেখানে অন্য কোনো জায়গা নেই?
যারা ঢাকা শহরকে পরিচ্ছন্ন রাখছেন, তাদের প্রতি এই নির্দয় ও নিষ্ঠুর আচরণ কেন? তারা গরিব বলেই কি সিটি করপোরেশন এমন অভিযান পরিচালনার সাহস দেখাচ্ছেন? এই শহরে শত শত বড় লোক যে খেলার মাঠ, পার্ক, নদী, খাল, সরকারি খাস জমি দখল করে রখেছেন, তাদের ব্যাপারে সিটি করপোরেশন এমন অভিযান পরিচালনা করে না কেন? বস্তির মানুষের টাকা ও ক্ষমতার জোর নেই বলে? কিন্তু তারাও তো দেশের নাগরিক এবং ভোটার। সাংবিধানিকভাবেই তো তাদের অধিকার রয়েছে, এই শহরে বসবাস করার!
যে বস্তিতে সিটি করপোরেশনের কর্তারা উচ্ছেদের নামে জবরদস্তি চালিয়েছেন, সেই মিরনজিল্লার সুইপার কলোনিতে প্রায় ৪ হাজার লোক বাস করেন। এখানে একটি মন্দির ও একটি বিদ্যালয় আছে। এতগুলো মানুষকে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। তারা পাশের মন্দির, বিদ্যালয় ও কমিউনিটি কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে শিশু ও বৃদ্ধদের নিয়ে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছেন।
এখানকার বাসিন্দাদের প্রায় সবাই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছিন্নতা কর্মী হলেও কর্তৃপক্ষ সুচতুরভাবে তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি করেছে। তারা বলছে, সাচিবিক আদেশে নিয়োগ পাওয়া স্থায়ী কর্মীরাই ঘর পাবেন। অস্থায়ী কর্মীদের ঘর দেয়া হবে না। তাদের অবৈধ বলা হচ্ছে। স্থায়ী কর্মীর সংখ্যা মাত্র ৪০ জন। অথচ সেখানে প্রায় ৫০০ পরিবার বাস করে। যারা ঘর পেয়েছেন, তারা কেউ চাবি নেননি। তাদের দাবি, সবাইকে ঘর দিতে হবে। না হলে তারাও নতুন ঘরে উঠবে না।
আমাদের দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে হরিজনরা আরও বেশি প্রান্তিক। সমাজে ‘অচ্ছুৎ’। কেউ তাদের ঘরভাড়া দেয় না। এমনকি রেস্তোরাঁ-হোটেলেও তাদের প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ আছে। আগে ভোরে ঢাকার রাস্তায় বের হলে একটি সাধারণ চিত্র দেখা যেত। প্রত্যেক পরিচ্ছন্নতাকর্মীর হাতে ঝাড়ুর সঙ্গে একটি টিনের মগ থাকত। কেননা ভদ্রলোকদের হোটেল-রেস্তোরাঁয় তাদের বসতে দেয়া হয় না। রেস্তোরাঁ থেকে চা এনে টিনের মগে খেতে হয় তাদের। তাদের প্রতি আমাদের সমাজের নীতি অত্যন্ত সংকীর্ণ ও নিষ্ঠুর। সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষও সেই নিষ্ঠুরতাকেই অনুসরণ করছেন, যা নিন্দনীয়। একবিংশ শতকে এসে এমন আচরণ কারও কাছেই প্রত্যাশিত নয়।
বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা না করে কাউকে উচ্ছেদ করা কেবল অমানবিক নয়, বেআইনিও। সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত; কিন্তু ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গরিব হরিজনদের উচ্ছেদ করেই উন্নয়ন করতে চায়। এমনকি শত শত বছর ধরে যারা সেখানে আছেন, তাদের সঙ্গে আলোচনারও প্রয়োজন বোধ করেন না।
আমাদের দেশে বস্তিবাসীরা ভাসমান, সমস্যা সৃষ্টিকারী, অপরাধপ্রবণ, অবৈধ দখলকারী, পরিবেশ দূষণকারী, অর্থনীতি এবং উন্নয়নের প্রতি হুমকিস্বরূপ- এ ধরনের প্রচারণার রেওয়াজ এবং সমাধানের ব্যবস্থাপত্র হিসেবে বস্তি উচ্ছেদকে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে প্রচ্ছন্ন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, বস্তিবাসীরা সমস্যা সৃষ্টিকারী তো নয়ই বরং আমাদের এই আধুনিক শহুরে জীবনকে সুন্দর ও গতিশীল রাখার জন্য তাদের অবদান অনেক।
আন্তর্জাতিক চুক্তি, দেশের সংবিধান বা আইনকে বস্তি উচ্ছেদের ক্ষেত্রে বিবেচনায় আনা তো হয়ই না, খোদ উচ্ছেদ প্রক্রিয়াই অনেক বিতর্কের সূচনা করে। কারণ সেখানে মানবিকতা, বিবেচনাবোধ, মানবাধিকার, নাগরিক অধিকার এগুলোকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়। এদেশে সাধারণ প্রবণতাই হলো বস্তিতে আগুন দিয়ে, পুলিশ দিয়ে জোর করে, সন্ত্রাসীদের দিয়ে বস্তিবাসীদের পেটানোর মাধ্যমে বস্তি উচ্ছেদ করা হয়। মানবতা, নাগরিক অধিকার এক্ষেত্রে উপহাসের বিষয়ে পরিণত হয়।
কারা এসব বস্তিবাসী? এরা পেটের টানে বিভিন্ন এলাকা থেকে এসেছিলেন এক সময়। শহরটাকে সাফ-সুতরো রেখেছেন, অন্যের বাড়িতে গৃহশ্রম দিয়েছেন, রিকশা, বাসে টেনে নিয়ে গিয়েছেন অন্য নাগরিকদের, ফুটপাতে সস্তার দোকান দিয়েছেন, ট্রলি ঠেলেছেন হাসপাতালে। নানাভাবে মিটিয়ে চলেছেন নাগরিক জীবনের দৈনন্দিন প্রয়োজন; কিন্তু বাস করার জমির ওপর আইনি অধিকার না থাকায় পাকা বাড়ি তৈরি করতে পারেননি। ত্রিপল, পলিথিন, বাঁশ ইত্যাদি দিয়ে যে ধাঁচটা দাঁড়ায়, সেটা ভয়ানক দাহ্য। আলো-বাতাসহীন।
শহরের ‘উন্নয়ন’-এর পরিকল্পনা কি এতগুলো মানুষের এই জতুগৃহে বাসের রূঢ় বাস্তবকে অস্বীকার করে হতে পারে? যারা এই শহরটাকে গড়েপিটে তৈরি করছেন, টেনে নিয়ে চলেছেন রোজ, সস্তায় খাবার জোগাচ্ছেন, তাদের নিরাপদ, স্বাস্থ্যসম্মত বাসস্থানের প্রশ্নটিকে আর কত দিন এড়িয়ে যাব আমরা? বস্তি উন্নয়ন নিয়ে দেশে কোনো নীতি নেই, সুনির্দিষ্ট আইনও নেই। সরকারি বিভিন্ন সংস্থা হঠাৎ হঠাৎ তাদের বিরুদ্ধে খড়্গহস্ত হয়।
বস্তি মানে আসলে স্বল্প পরিসরে, স্বল্প রসদ নিয়ে বহু মানুষের জীবনযাপন, যা এমন এক পরিস্থিতিতে এই মানুষগুলোকে আটকে রাখে, যেখানে তারা প্রায় সর্বক্ষণ নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করেই টিকে থাকতে বাধ্য হন। ফলে পুঁজির সঙ্গে, প্রশাসনের সঙ্গে দরকষাকষিতে এই শ্রমবাহিনীর পাল্লা হয় দুর্বল, শ্রম হয় সস্তা। ন্যায্য মজুরি বা বৈধ বাসস্থান, কোনোটিই তারা পান না।
‘জীবনের অধিকার’ মানে যেমন সম্মান নিয়ে বাঁচার অধিকার, তেমনই ‘শহরের অধিকার’ মানে এই শহরে কাজ করে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকার। সুস্থ কাজের পরিবেশ, ন্যায্য মজুরি, কাজের শেষে একটা স্বাস্থ্যকর বিশ্রামের, অবসর যাপনের, গৃহকর্মের পরিবেশ। বস্তির পরিপন্থি। অনেক ঝুপড়ি বস্তিতে পানীয়জল, বিদ্যুৎ, শৌচাগারের মতো ন্যূনতম নাগরিক পরিষেবার ছিঁটেফোঁটাও নেই। যেখানে আছে, সেখানেও ঘিঞ্জি কর্দমাক্ত গলি, জলের কলের বা বাথরুমের লাইন মনুষত্যের একটা অবস্থা সৃষ্টি করেছে। শহরবাসী শ্রমিক হিসেবে তাদের স্বীকৃতি না দিলে অবস্থা বদলাবে না। তাদের বাসস্থানের বিষয়টি সব সময় উপেক্ষিত থাকে।
বস্তিবাসী মানুষের জন্য নিরাপদ ও বৈধ বাসস্থানের পরিকল্পনাকে স্থান না দিয়ে ‘স্মার্ট সিটি’, ‘গ্রিন সিটি’ বা শহর উন্নয়নের কোনো নীতি তৈরি করা অর্থহীন। বস্তি সমস্যার সমাধান প্রথম চিন্তার বিষয় হওয়া উচিত। নইলে এই শহরের এক-তৃতীয়াংশ মানুষ রোজ রাতে জতুগৃহে ঘুমোতে যাবেন। অপেক্ষা করবেন দহন পর্বের জন্য। অথবা বুলডোজার কিংবা সরকারি পেটোয়া বাহিনীর হাতে উচ্ছেদ হওয়ার আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকবেন।
সরকারের উচিত বস্তিতে বসবাসকারী মানুষদের প্রতি সহমর্মী ও সহানুভূতিশীল হওয়া। বস্তিবাসীর জন্য পরিকল্পিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। তাদের বিকল্প আবাসনের ব্যবস্থা করা। তা না করে গায়ের জোরে দুর্বলকে উচ্ছেদ করে, মেরে-পিটিয়ে তাদের শহর ছাড়া করলে সরকারের স্বৈরতান্ত্রিক চেহারাই প্রকাশিত হয়। সংবিধানে সব মানুষের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। সংবিধান রক্ষার শপথ নিয়ে সরকার ক্ষমতায় আছে। কারও অধিকার খর্ব করে অন্য কারও জন্য যদি ভালো কিছুও করা হয়, সেটাও সংবিধানসম্মত নয়। সবার অধিকার রক্ষা করাই সরকারের পবিত্র দায়িত্ব।
লেখক: কলামিস্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে