আওয়ামী লীগের করুণ পরিণতির পোস্টমর্টেম-১
অতি দম্ভ-অতি কথন, একগুয়েমিতে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপন
দেশের রাজনীতিতে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বিপর্যয়ে রয়েছে আওয়ামী লীগ। অপশাসন, দুর্নীতি ও অতিমাত্রায় দলীয়করণের নীতি গ্রহণের কারণে তীব্র গণরোষের মুখে দলটির সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এক অর্থে দিশেহারা অবস্থায় রয়েছেন। দলটির সামনে সৃষ্টি হয়েছে দীর্ঘ অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
অথচ বাংলাদেশের জন্ম ও রাজনৈতিক পথ-পরিক্রমার পরতে পরতে আওয়ামী লীগের সম্পৃক্ততা রয়েছে। জনতার কাতার থেকে জন্ম নেয়া দলটি কখনো আওয়ামী মুসলিম লীগ, কখনো পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, কখনোবা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ হিসেবে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়েছে। বাঙালি ও বাংলাদেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে দলটির গণমুখী লড়াই-সংগ্রামের অধ্যায় রয়েছে। আর গণমানুষের প্রত্যাশার সব লড়াইয়ে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়েছে। অর্জন করেছে বাঙালি জাতি তথা বাংলাদেশের মানুষের কাছ থেকে অতল ভালোবাসা ও সম্মান। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সে দলটিই এখন অত্যন্ত বিতর্কিত এবং পরাজিত।
কেন এই পরাজয়, কেনইবা অস্বাভাবিক জনরোষের শিকার হলো আওয়ামী লীগের মতো একটি দল- এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা ও বিতর্ক চলছে। নানাজন নানা মত প্রকাশ করছেন। নানা বিচার-বিশ্লেষণ চলছে হরহামেশা। তবে মোটা দাগে পর্যালোচনা করলে অগুনতি বিষয় সামনে উঠে আসবে। তার মধ্যে কয়েকটি হলো অতি দম্ভ, অতি কথন বা লাগামহীন বচন, অসহনীয় একগুয়েমি, অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস, আমিত্ব ফোবিয়া। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে দলটির প্রায় অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতার মধ্যে এই বিষয়গুলো লক্ষ করা গেছে ক্ষমতায় থাকাকালে। এর প্রভাব পড়েছিল বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের একাংশের মধ্যে। মন্ত্রী-এমপিদের প্রায় সবাই ছিলেন এই দোষে দুষ্ট। ফলে সংকট বেড়েছে দিনে দিনে। এসব কারণেই প্রাথমিকভাবে বিচ্ছিন্নতার বীজ বপিত হয়েছিল।
একটানা প্রায় ১৬ বছর ক্ষমতায় থাকায় দলটির নেতাকর্মীদের অধিকাংশের মধ্যে অহমিকা জন্ম নিয়েছিল। সেই অহমিকা পরিণত হয়েছিল অব্যাহত একগুয়েমিতে। এর সঙ্গে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস মিলে অবারিত ক্ষতির দ্বার উন্মোচন করেছিল। একগুয়ে মনোভাব থেকে শেখ হাসিনা দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের কটু বাক্যবাণে ঘায়েল করতেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে রাজনীতি করেছেন এমন কয়েকজন সিনিয়র নেতাকে শেখ হাসিনার অপমান নীরবে হজম করতে হয়েছে। অনেক যোগ্যতা থাকার পরও সিনিয়র অনেকে তার নেকনজরের বাইরে ছিলেন। আবার অযোগ্য হওয়ার পরও অনেকে শেখ হাসিনা বা তার পরিবারের স্তুতি করে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। সরকার বা দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও সেগুলোর তেমন একটা ব্যবস্থা নেয়া হতো না। পাশাপাশি অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার ‘কচি-কাঁচারা’ বিপজ্জনক সময়ে নিজেদের রক্ষায় ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। তখন দল বা সরকারের বিষয়টি তারা বেমালুম ভুলে যেতেন।
পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ভালো-মন্দ বিচার-বিশ্লেষণ বা পর্যালোচনা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গিয়েছিল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। এমনকি তৃণমূলেও সৃষ্টি হয়েছিল এই পরিস্থিতি। যার ফলে রাজপথ থেকে জনপদে আওয়ামীবিরোধী সেন্টিমেন্ট বিস্তৃত হতে থাকে। বিরোধী পক্ষের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সেই সেন্টিমেন্ট সাধারণের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। দলীয় নেতাকর্মীদের একটি বড় অংশের মধ্যেও তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে একসময়। বারবার তৃণমূলের প্রত্যাশার বিপরীতে শেখ হাসিনাকে ঘিরে থাকা একদল ধান্দাবাজ, চাটুকার দলের নীতিনির্ধারক হওয়ার ফলশ্রুতিতে ত্যাগী ও দলদরদি নেতাকর্মীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। ফলে গত ১৫ বছরে তৃণমূলে আওয়ামী লীগ কার্যত নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছিল। মূলত দীর্ঘ ঐতিহ্যের আওয়ামী লীগ হয়ে যায় ‘শেখ হাসিনা লীগ’। এই অবস্থাটিই আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলের বড় বিপদ ডেকে এনেছে।
প্রকাশ্যে শেখ হাসিনার দম্ভ ও অতিকথন তার জন্য দীর্ঘতম ক্ষতি বয়ে এনেছে। তিনি এবং তার দলের বহু নেতা হালকা বোল বা চালে অনেক কথা বলেছেন, যেগুলো জনগণ ভালোভাবে নেননি। তাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হলেও সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। সেই সুযোগ এনে দিয়েছে জুলাই আন্দোলন। এ কারণেই ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন হয়ে ওঠে জনতার আন্দোলন। এই আন্দোলনে কী ধরনের পরিকল্পনা ছিল, ষড়যন্ত্র ছিল কি ছিল না অথবা রাজনৈতিক দলগুলো কীভাবে যুক্ত হয়েছে; সেটি নিয়ে বিতর্কের সুযোগ থাকলেও জনগণ আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার পতনে জনতা একাট্টা ছিল সেটি নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
শেখ হাসিনা তার দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ক্ষমতাকালে অসংখ্য লাগামহীন কথা বলেছেন। ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় সেসব কথার অনেকগুলো মানায় না বলে পর্যবেক্ষক মহল বারবার মত প্রকাশ করেছে। সেসব সমালোচনা আমলে নেয়া হয়নি অধিকাংশ সময়। উল্টো সমালোচকদের কাউকে কাউকে নাজেহাল হতে হয়েছে। অনেকেই বিশেষ মহলের চাপের শিকার হয়েছেন। কাউকে কাউকে বিশেষ গোষ্ঠী দিয়ে হুমকি-ধমকি দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, ক্ষমতা বা দায়িত্বে থেকেও শেখ হাসিনা বা তার পারিষদের অনেক কথায় ক্ষমতার দম্ভ ও দায়িত্বে অবমাননার চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেছে।
‘আমার দয়ায় তিনি (খালেদা জিয়া) সাজাপ্রাপ্ত হয়েও আরাম-আয়েশে বাইরে রয়েছেন’, ‘আমার পিয়নও ৪শ’ কোটি টাকার মালিক, হেলিকপ্টার ছাড়া চলে না’, বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতি ও লুটপাটের সমালোচনা করায় জনগণের বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার হুমকি, খালেদা জিয়া ও ড. ইউনূসকে পদ্মা সেতু থেকে টুক করে ফেলে দেয়ার কথা বলা, প্রথম দফায় কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীদের ওপর ক্ষিপ্ত হয়ে সরকারি চাকরিতে সব ধরনের কোটা প্রথা বিলুপ্ত করা, জুলাই ২০২৪-এর কোটা আন্দোলনকে অবজ্ঞা করা অথবা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের দম্ভোক্তি ‘খেলা হবে’ বা ‘আন্দোলনকারীদের (কোটা আন্দোলন) দমন করতে ছাত্রলীগই যথেষ্ট’- এমন কথা জনগণ ভালোভাবে নেয়নি। বরং এ ধরনের বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরকে জনগণের সামনে বিরক্তির ও অগ্রহণযোগ্য চরিত্রে পরিণত করেছিল।
এছাড়া প্রতিদ্বন্দ্বী রাজনৈতিক দলগুলোকে নানাভাবে কোণঠাসা করার পাশাপাশি দলগুলোর নেতাদের হেয়প্রতিপন্ন করা, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান ও তার সন্তানদের অব্যাহতভাবে খুনি বলা, হাস্যকর মামলার অজুহাতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে এতিমের টাকা আত্মসাৎকারী বলে বারবার হেয় করার ঘটনাও বুমেরাং হয়েছে আওয়ামী লীগের জন্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে একদিকে অশোভন মন্তব্য অন্যদিকে পুলিশি হয়রানি একসময় সাধারণ জনগণের মাঝে বিরূপ প্রভাব ফেলেছিল।
টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে আওয়ামী লীগ ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনা অনেক বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছিলেন। সব ক্ষেত্রেই তিনি আমিত্বকে গুরুত্ব দিতেন। দু-একবার সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘যদি দায়িত্বশীলরা সবাই সবকিছুতে প্রধানমন্ত্রীর মতের অপেক্ষায় থাকেন, তবে সংকট তৈরি হয় কি-না’- জবাবে শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন, তিনি নির্বাহী প্রধান। তার সিদ্ধান্ত নিয়েই তো সবাইকে কাজ করতে হবে। ফলে অনেক ছোটখাটো বিষয়কেও জটিল করে ফেলতেন মন্ত্রীদের অনেকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বের মধ্যে যে কাজ পড়ে সেটাতেও কারণে-অকারণে শেখ হাসিনাকে টেনে আনা হতো। পাশাপাশি যেখানে প্রয়োজন নেই, সেখানেও শেখ হাসিনার স্তুতিতে মেতে উঠতেন সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা।
এর ধারাবাহিকতায় দলের নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা সবকিছুর সঙ্গে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে জুড়ে দিতেন। শেখ হাসিনা ও তার পরিবারের সদস্যদের নেকনজরে থাকার জন্য বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নিহত সদস্যদের নামে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে প্রকল্প নেয়া হতো। এসব প্রকল্পে শেখ হাসিনা খুশি হলেও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা এমপি কোটি কোটি টাকা লুটপাটের সুযোগ তৈরি করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এর পাশাপাশি সমালোচনা হলেই বিরক্তি প্রকাশ বা ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনাকে বিপদাপন্ন করেছে। শেখ হাসিনার একগুয়েমি দল হিসেবে যেমন আওয়ামী লীগকে ভীষণভাবে দুর্বল করেছিল, তেমনি দেশের রাজনীতিতেও শূন্যতা তৈরি করেছিল। এই শূন্যতা রাজনীতিতে শেখ হাসিনার বন্ধুর চেয়ে শত্রু বেশি তৈরি করেছিল। সেটা তিনি আঁচ করতে পারেননি। কেউ কেউ এসব বিষয়ে সতর্ক করার চেষ্টা করলেও পাল্টা প্রশ্নবানের কারণে হাল ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তোষামাদকারীদের সংখ্যা বেড়ে গিযেছিল। একপর্যায়ে সামরিক-অসামরিক ও তোষামোদকারী ব্যুহে আবদ্ধ হয়ে পড়েন শেখ হাসিনা। এ কারণেই বিচ্ছিন্নতার খাদের কিনারে গিয়ে পৌঁছে যান তিনি।
(চলবে)
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে