টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে মনোমুগ্ধকর কয়েকটি দিন
মহামারির প্রতিক্রিয়া বুকে নিয়ে, হলিউডের চলচ্চিত্র কর্মীদের চলমান ধর্মঘট সত্ত্বেও, ৪৮তম টরেন্টো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (টিআইএফএফ) অনুষ্ঠিত হলো ২০২৩ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। এই এগারো দিনে আমি মোট ২৬টি ছবি দেখেছিলাম। ‘স্বপ্নদর্শী’ শিরোনামে একটি আলোচনাচক্রেও অংশ নিয়েছিলাম। আমার মূল আগ্রহের জায়গা ছিল এশিয়া অঞ্চল নিয়ে। অন্য দেশেরও দুটি ছবি দেখেছিলাম।
উৎসবে আমি যেসব ছবি দেখেছি এবং অন্যান্য ছবিগুলোর তালিকা দেখে পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি যে, বিশ্বের অন্যান্য মর্যাদাপূর্ণ উৎসব থেকে সর্বাধিক আলোচিত এবং প্রশংসিত চলচ্চিত্রগুলোই টিআইএফএফে প্রদর্শিত হতে চলেছে। এ দিক থেকে দেখলে, এই উৎসবের একটা আলাদা গুরুত্ব আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তাদের মূল বিভাগগুলোর মধ্যে একটি হলো সমসাময়িক বিশ্ব সিনেমা, যদিও এবার বিভাগটির নামকরণ করা হয়েছে সেন্টারপিস। এই বিভাগটিই ছিল তাদের মূল আকর্ষণ। তাই সেন্টারপিস বিভাগের ৪৫টি দেশের ৪৭টি ছবির মধ্যে আমি ৯টি দেখেছি। এগুলোর মধ্যে নুরি বিলগে সিলানের ‘এবাউট ড্রাই গ্রাসেস’ ছবিটিই সবচেয়ে ওপরে রাখব। ন্যায়-অন্যায়, মতাদর্শের প্রয়োজনীয়তা-অপ্রযোজনীয়তা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সম্পর্কের ট্যাবু নিয়ে পরিচালক এই ছবিতে ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব দেখিয়েছেন। সিলানের অন্যান্য ছবি যারা দেখেছেন, তারা জানেন এই পরিচালক কীভাবে তার ছবিতে অন্যরকম এক আবহ সৃষ্টি করেন। ‘সেন্টারপিস’-এর আরও দুটি ছবির কথা যদি আমি বলতে চাই, তাহলে সেমিল আগাকোগ্লু পরিচালিত ‘দ্য রিডস’ এবং অ্যান্থনি চেনের 'দ্য ব্রেকিং আইস' ছবি দুটোর কথা বলব।
টিআইএফএফ-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের হলো ডিসকোভারি। যেসব তরুণ পরিচালক মনে করেন তারা বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসে নাম লেখাতে পারবেন তাদের জন্য এই বিভাগ। ডিসকোভারি বিভাগ থেকে আমি পাঁচটি সিনেমা দেখেছি। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো লেগেছে ইরানি চলচ্চিত্র ‘অ্যাকিলিজ’। ফরহাদ দেলরামের প্রথম চলচ্চিত্র এটা। ছবিটি অত্যন্ত রাজনৈতিক এবং রূপকধর্মী। আরেকটি দারুণ ছবি ছিল সৌদি আরবের চলচ্চিত্র পরিচালক আলী কালথামির প্রথম ছবি ‘মন্ডব’। মধ্যপ্রাচ্য বা পশ্চিম এশিয়ার দেশ হিসেবে সৌদি আরবের ছবি আগে খুব একটা দেখা যায়নি। যদিও আমি টেলিভিশনে ও চলচ্চিত্র উৎসবে ইরানের প্রচুর ছবি দেখেছি। এর জন্য বাংলাদেশে অবস্থিত ইরান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। বহু বছর ধরে ইরানের ছবি দেখার সৌভাগ্য আমাদের হয়েছে তাদের কল্যাণে। যা হোক, সৌদি আরবের চলচ্চিত্রের ডিস্ট্রিবিউশন দুনিয়াজুড়েই কম হয়।
সেন্টারপিস এবং ডিসকভারি ছাড়াও, আমি টিআইএফএফের গালা, প্ল্যাটফর্ম, বিশেষ উপস্থাপনা, ডক্স এবং লুমিনারি, প্রাইম টাইম, ওয়েভ লেংথ, এবং প্রিমিয়াম বিভাগের চলচ্চিত্রগুলোও দেখেছি। দক্ষিণ কোরিয়ার চলচ্চিত্র ছিল মধ্যম সিনেমার নিখুঁত উদাহরণ। তবে, ওপরের ক্যাটাগরি থেকে আমি যেসব ছবি দেখেছি তার মধ্যে সেরা তিনটি ছবি হচ্ছে: ‘এভিল ডাজ নট এক্সিস্ট’, ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্যামেলি’, এবং ‘এনওয়াইএডি’। এই তিনজনের মধ্যে 'দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্যামিলি' তথ্যচিত্রের পরিচালক আনন্দ পটবর্ধনের সঙ্গে প্রথমবারের মতো আলাপ করলাম। তার কাজ সম্পর্কে আমার আগেরই কিছু ধারণা ছিল। তাই কথা বলতে অসুবিধা হয়নি। তা ছাড়া, বাংলাদেশ সম্পর্কে আনন্দেরও বেশ আগ্রহ ছিল, এটা আমাদের দুজনকে অনেক কাছাকাছি নিয়ে আসে। উৎসব চলাকালীন তার সঙ্গে কয়েকবারই কথা বলার সুযোগ হয়েছে। আমি বলতে চাই, তিনি শুধু উপমহাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্বের অন্যতম উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক তথ্যচিত্র নির্মাতা।
চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু
আনন্দের তথ্যচিত্র ছাড়া, ভারতের আর যে চলচ্চিত্র দেখেছি তা মনে তেমন দাগ কাটেনি। যদিও 'ডিয়ার জ্যাসি' ছবিটি প্ল্যাটফর্ম পুরস্কার পেয়েছে। ছবির নায়ক যুগম সুদ পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে পরিচালক তারসেম সিং ধন্দওয়ারের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন। সুদ আমার পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন; কিন্তু পুরস্কার পেয়ে পরিচালক তারসেম সিং এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন যে, বেচারা সুগমকে মঞ্চে ডাকতে ভুলে যান। যাই হোক, পরে আমি সুদকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলাম। একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই ছবিতে 'অনার কিলিং'-এর বিষয়টি উঠে এসেছে। যদিও পরিচালক পুরস্কার নেন এবং অনুরোধ করেন ছবিটিকে কেউ যেন অনার কিলিং ফিল্ম না বলেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি হত্যার বর্বরতা ঢাকতে চেয়েছেন। তবে ধারণাগত দৃষ্টিকোণ থেকে হত্যার ধরন বর্ণনা করতে ‘অনার কিলিং’ বললে খুব একটা ক্ষতি নেই বলে আমি মনে করি।
এই ছবিটি ছাড়াও, টিআইএফএফ-এর শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে কর্ড জেফারসনের ছবি ‘আমেরিকান ফিকশন। এশিয়ান চলচ্চিত্রের মধ্যে আমার তালিকা সীমাবদ্ধ করে রেখেছি বলে, মার্কিন ছবিটি আর আমার দেখা হয়নি। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ঔপন্যাসিকের হতাশা অবলম্বনে নির্মিত ছবিটি দর্শক পছন্দ করেছিল। অন্যদিকে, রবার্ট ম্যাককালামের তথ্যচিত্র ‘মি. ড্রেসআপ: দ্য ম্যাজিক অব মেক-বিলিভ’ সেরা ডকুমেন্টারি বিভাগে পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড জিতেছে। এই দুটি পুরস্কারই টিআইএফএফ-এর প্রধান পুরস্কার। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়া চলচ্চিত্রগুলো দর্শকদের ভোটে সেরা নির্বাচিত হয়। টিআইএফএফ তার দর্শকদের সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়। তাই প্রতিটি ছবি প্রদর্শন শুরুর আগে দর্শকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন বার্তা ছিল।
টিআইএফএফের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ ক্যাটাগরি আছে: টিআইএফএফ ক্ল্যাসিক। টিআইএফএফ ক্ল্যাসিকে এবার আমার খুব প্রিয় পরিচালক উসমানে সেমবেনের ‘ক্ষালা’ দেখানো হয়েছে। সেনেগালের আরেকজন পরিচালক জিব্রিল ডিওপ মাম্বেটির ‘তুকি বউকি’ও দেখানো হয়েছিল এই উৎসবে। এ ছাড়াও, জ্যাক রিভেটের ‘ল’আমোর ফাউ’, ব্রিজিট বার্ম্যানের ‘আর্টিশ: টাইম ইজ অল ইউ হ্যাভ গট’ এবং চেন কাইজের ‘ফেয়ারওয়েল মাই কনকুবাইন’ও এই বিভাগে ছিল।
মানুষ কি শুধু ছবি দেখতেই উৎসবে আসে? অনেকেই দেখেছি কেবল মানুষের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছে। যোগাযোগ রক্ষার্থে। উৎসবে বাজার যে বড় ভূমিকা রাখে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অনেক বড় বড় পরিবেশক টিআইএফএফে নতুন ছবি দেখতে আসেন, ছবিটি পছন্দ হলে তারা প্রযোজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তারা বিভিন্ন দেশে ছবি মুক্তির বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। ফিল্মের এই বাণিজ্যের জন্য টিআইএফএফের অবশ্য একটি আলাদা শাখা রয়েছে, নাম মার্কেট স্ক্রিনিং। বাণিজ্য একদিকে, উৎসবের আমেজ অরেকদিকে।
উৎসবে চলচ্চিত্র প্রেমীদের মধ্যে বন্ধুত্ব অতুলনীয়। বিশেষ করে ছবি শুরুর আগে ও পরে তাদের মধ্যে যে গল্প শুরু হয় তা দেখার মতো। চলচ্চিত্রপ্রেমীরা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে ছবিটি সম্পর্কে নিজেদের মতামত জানাতে ভালোবাসেন। টিআইএফএফের বিভিন্ন থিয়েটারের আশপাশে অনেক রেস্তোরাঁ। চলচ্চিত্রপাগলরা রেস্তোরাঁয় বসে চলচ্চিত্র নিয়ে আলাপে বুঁদ হয়ে থাকেন। তবে সাংবাদিকদের জন্য টিআইএফএফের লাউঞ্জের প্রশংসা করতে হয়। এমন নিবিড় কাজের পরিবেশ সত্যিই বিরল। সমস্তরকম সুযোগ-সুবিধা সেখানে তৈরি ছিল। যারা মন দিয়ে কাজ করতে চান, নিবিষ্ট সাংবাদিক ও লেখকদের জন্য টিআইএফএফের লাউঞ্জ একটি দারুণ জায়গা। দুঃখের বিষয়, আমি লক্ষ্য করেছি অনেকেই মিডিয়া স্বীকৃত কার্ড নেন; কিন্তু যে কাজটির জন্য উৎসব তাদের অনুমোদন দিয়েছে তা করেন না। কেউ আসেন পরিবেশের টানে, কেউ এমনিতেই অলস সময় কাটাতে। উৎসবের পরিবেশ অনেককে এমনিতেই টানে; কিন্তু, ছবি দেখায় যেমন তাদের তেমন উৎসাহ নেই, তা নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা বা যোগ্যতাও বোধহয় তাদের নেই। করুণা ছাড়া তাদের আর কী জানাতে পারি।
টিআইএফএফের মূল বিল্ডিং লাইটবক্সের নিচতলায় একটি দোকান আছে, সুযোগ পেলেই আমি গিয়ে বইয়ে বইয়ের ছোট সংগ্রহে নিমগ্ন হয়ে থাকতাম। চলচ্চিত্র-বিষয় বিভিন্ন বইয়ের সম্ভার, বিশাল সংগ্রহ চলচ্চিত্র-পরিচালকদের সাক্ষাৎকারের। দর্শনবিষয়ক কয়েকটি বইও আমার দৃষ্টি এড়ায়নি; কিন্তু বইয়ের চেয়ে বেশি মানুষদের দেখেছি উৎসবের স্মারক সংগ্রহ করতেই বেশি আগ্রহ। এই প্রবণতা অনেকটাই বৈশ্বিক।
টিআইএফএফের আরও দুটি দিক না বললে এই লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। একটি হচ্ছে টিআইএফএফ কেন্দ্রে প্রথম চার দিন বিকেলে সংগীত সম্মেলনের কথা। আরেকটি হচ্ছে সড়ক উৎসবের কথা, যেখানে ছোট ছোট দোকান বসতো নানা মনোহারী জিনিসপত্র আর মজাদার খাবার নিয়ে।
আরেক দল মানুষ ছাড়া, উৎসবটি শূন্য মনে হতো। তারা হলেন হকার; কিন্তু তারা বাংলাদেশের হকারদের মতো না। উত্সব কেন্দ্র করে তারা বিশেষ ইস্যুগুলো নিয়ে আসেন। ভ্যারাইটি, স্ক্রিন, হলিউড রিপোর্ট এবং ব্যাকস্টেজের মতো ম্যাগাজিনগুলো। উত্সবে আসা লোকেদের কাছে তারা সেগুলো বিতরণ করেন। তাদের হাকডাক ছাড়া উৎসবের আমেজ ঠিক মতো ফুটে উঠত না। শুধু পড়ার জন্য না, স্যুভেনির হিসেবেও আমি এগুলো সংগ্রহ করেছি।
বিশ্বব্যাপী যত চলচ্চিত্র উৎসবের আয়োজন হয়, তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য চতুর্থ চলচ্চিত্র উৎসব হওয়ার মর্যাদা রাখে টিআইএফএফ। প্রথাগত রেড কার্পেট, সেলিব্রিটিদের উপস্থিতি এবং পুরস্কার প্রাপ্তির তীব্র প্রত্যাশা থাকা সত্ত্বেও টিআইএফএফ তার আন্তরিকতার কারণে আলাদা। সারা বিশ্ব থেকে আগত সাংবাদিক, চলচ্চিত্র লেখক এবং সমালোচকদের প্রতি উৎসবের আয়োজকদের অসামান্য আতিথেয়তা সিনেমা-সংক্রান্ত যোগাযোগের জন্য প্রকৃত সুযোগ তৈরি করে। যদিও এটি উত্তর আমেরিকার ইভেন্ট; কিন্তু ইউরোপ এবং এশিয়ারও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক লোকজনের অংশগ্রহণ এখানে আছে, বিশেষেত উত্তর আমেরিকায় স্থায়ীভাবে বসবাসকারী এই অঞ্চলের অনেক সাংবাদিকের কাছে। আমার মতো আরও অনেকেই কেবল টিআইএফএফে অংশ নেওয়ার জন্য দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। এই উৎসবের মূল প্রকৃতি হলো চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবাকিছুকে একজোট করা, চলচ্চিত্রের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদের এক কাতারে নিয়ে আসা। এই আন্তরিকতাই উৎসবটিকে বহুবর্ণিল উদযাপনে পরিণত করেছে।
লেখক: চলচ্চিত্র সমালোচক; বিচারক, ফিপ্রেসি, কান চলচ্চিত্র ৭৫তম উৎসব
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে