Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

প্রত্যাশা-প্রাপ্তির হিসাব মিলছে না ক্রিকেটে

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

বুধবার, ১৯ জুন ২০২৪

কেশব মহারাজের ফুলটস বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে বাউন্ডারিতে এইডেন মার্করামের হাতে ধরা খান মাহমুদউল্লাহ। ম্যাচ সেখানে ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’! মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। ‘ক্লিনিক্যালি ডেড’ অবস্থা থেকে বাংলাদেশ ফিরে আসতে পারত যদি কেশব মহারাজের ফুলটস বলে ছক্কা হাঁকাতে পারতেন তাসকিন আহমেদ; কিন্তু পারেননি এ পেসার, পারেনি বাংলাদেশও।

ওই না পারার ম্যাচ নিয়ে কত-শত বিশ্লেষণ হয়েছে। এখনো হচ্ছে। ভবিষ্যতেও নানা ঘটনার রেফারেন্স হিসেবে ম্যাচের প্রসঙ্গ টানা হবে। সে বিশ্লেষণ কিংবা রেফারেন্সে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সামর্থ্যর প্রসঙ্গ কিন্তু যত্নের সঙ্গেই আড়ালে রাখা হচ্ছে। অতীতের নানা ঘটনায় সেটাই প্রতিষ্ঠিত সত্য। নিজেদের দোষ আড়াল করার ইস্যুতে আমাদের জাতীয় অভ্যাসের কারণেই বোধ করি এমনটা হয়ে আসছে বছরের পর বছর।

অতীতে যেভাবে ৯ রান তুলতে মিডল-অর্ডারের চার ব্যাটারের আউট হওয়ার ব্যর্থতা আড়াল করা হয়েছিল ভিরাট কোহলির ফেইক-ফিল্ডিং প্রসঙ্গ দিয়ে। ঘটনা ২০২২ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের। ফেইক ফিল্ডিংয়ের জন্য ক্রিকেটে ৫ রান পেনাল্টি হয়; কিন্তু ভিরাট কোহলির ওই ঘটনা আম্পায়ারদের দৃষ্টি এড়িয়ে গেছে। যে কারণে ৫ রানের পেনাল্টি থেকে বেঁচে যায় ভারত। বৃষ্টি বিঘ্নিত ওই ম্যাচ ডাকওয়ার্থ লুইসের জটিল অঙ্কে বাংলাদেশের হার ৫ রানেই! ম্যাচের পর থেকে শুরু হওয়া ওই ৫ রান সংক্রান্ত রোনাজারি যেন এখনও থামেনি! অথচ ৯৯ থেকে ১০৮ রানের মধ্যে ১০ বলের ব্যবধানে আফিফ হোসেন, সাকিব আল হাসান, ইয়াসির আলী রাব্বি ও মোসাদ্দেক হোসেনের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার প্রসঙ্গ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি আমরা।

এডিলেইডের সে ম্যাচের ৫৮৬ দিনের ব্যবধানে নাসাউ কাউন্টি স্টেডিয়ামের ম্যাচের চিত্রটা প্রায় একই। এ যাত্রায় তৌহিদ হৃদয়ের আম্পায়ার্স কলে আউট হওয়া নিয়ে কথা হচ্ছে। তার চেয়ে বেশি ফোকাস করা হচ্ছে মাহমুদউল্লাহর বিরুদ্ধে দেয়া আউটের সিদ্ধান্তের কারণে আইনের ফাঁক গলে বাংলাদেশের ৪ রান বঞ্চিত হওয়ার প্রসঙ্গে। প্রায় ১৮ হাজার কিলোমিটার দূরের দুই ভেন্যুর ম্যাচে কি অদ্ভুত মিল- এখানে বাংলাদেশ হারল সেই ৪ রানেই!

আইসিসির নিয়মের যে ফাঁক, সেটা রীতিমতো হাস্যকর- অনেকটা পাড়া-মহল্লার খেলার মতো! সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। প্রথমে বাংলাদেশের ব্যর্থতার প্রসঙ্গ ঘেটে দেখা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার সবচেয়ে বিপজ্জনক বোলার এনরিচ নর্টজে। ৩৭ রানে ২ উইকেট হারিয়ে চাপে থাকা অবস্থায় শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে তাকে পুল করতে যাওয়া বিলাসিতাই বটে। সাকিব আল হাসান সে বিলাসিতার পথে হাঁটেন। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে একই কায়দায় উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন অধিনায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত। দল চাপে থাকুক আর ছন্দে, বাংলাদেশি ব্যাটারদের উইকেট বিলিয়ে দিয়ে আসার রোগ কিছুতেই সারানো যাচ্ছে না। পুরো পেশাদার একটি দলের বিপক্ষে মিডল অর্ডার ব্যাটাররা ওভাবে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এলে তা দলের ওপর চাপ তৈরি করবেই। সেটাই করেছে ২০২২ সালে ভারত এবং সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে, যা বাংলাদেশের কাজটা জটিল করে তুলেছিল।

সর্বশেষ ঘটনায় মাহমুদউল্লাহ ও তৌহিদ হৃদয় সে জটিলতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছেন বটে। তাদের প্রচেষ্টার সঙ্গে জাকের আলী অনিক-রিশাদ হোসেনদের ভূমিকা রাখতে পারলেই কাজ হয়ে যায়; কিন্তু সেটা না হওয়ার দায়টা আপনি কোনোভাবেই জাকের আলী কিংবা রিশাদ হোসেনদের ওপর চাপাতে পারবেন না। দায়টা অবশ্যই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সিস্টেমের। যে সিস্টেম প্রতিকূল অবস্থা থেকে উত্তরণের বড় পরীক্ষা দেয়ার আগেই দুই তরুণকে জাতীয় দলে নিয়ে এসেছে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারত কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দলের দিকে তাকান- একজন ক্রিকেটার অনেক কাঠ-খড় পোড়ানোর পর জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার সুযোগ পান।

মজবুত কাঠামোর কারণে ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগে (আইপিএল) রীতিমতো তাণ্ডব চালানোর পরও ফ্রেজার ম্যাকগ্রার্ক অস্ট্রেলিয়া দলে জায়গা পাননি। এ উপেক্ষার জ্বালা ২২ বছর বয়সী হার্ড হিটারকে আরও পরিণত করবে নিশ্চিত। যখন জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলবেন, তখন হয়তো জায়গা ধরে রাখতে নিজেকে উজাড় করে দেবেন। এটিই তাদের শক্তির জায়গা, পেশাদারি সিস্টেম। বিপরীতে বাংলাদেশে পেশাদার মোড়কে চলছে সৌখিন ক্রিকেট প্রদর্শনী। যে প্রদর্শনী অপরিণত একজনকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলে দিচ্ছে। দিনের পর দিন, ম্যাচের পর ম্যাচ ব্যর্থতার পরও বিভিন্ন ক্রিকেটারকে দলে থাকার নিশ্চয়তা দিচ্ছে।

১৯৯৭ সালে ক্রিকেটের বাঁক বদলের ২৭ বছর পরও প্রত্যাশিতভাবে পরিণত হয়নি দেশের ক্রিকেট। এ পর্যায়ে এমনটা অবশ্যই অগ্রহণযোগ্য। আপনি তৌহিদ হৃদয়ের আম্পয়ার্স কলে আউট হওয়াকে দুর্ভাগ্য হিসেবে উল্লেখ করতে পারেন। আইনের মারপ্যাঁচে ৪ রান বঞ্চিত হওয়াকে অবিচার বলতে পারেন। তাতে বাংলাদেশের ব্যর্থতা আড়াল করতে পারবেন না। ৬ উইকেট হাতে রেখে ১৮ বলে ২০ রান তুলতে না পারাটা রীতিমতো অপরাধের পর্যায়ে!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে সবচেয়ে দৃষ্টিকটু বিষয় হচ্ছে, নির্দিষ্ট প্রতিযোগিতাকে ঘিরে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই। যে কারণে আইসিসি ওয়ানডে বিশ্বকাপের আগে তামিম ইকবালকে নিয়ে একাধিক নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। গুঞ্জন আছে- সে নাটকের কুশীলব দলের অভ্যন্তরেই ছিলেন, এখনো আছেন। যার অর্থ পরিষ্কার, বোর্ড কর্তাদের পরোক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ মদদ ছিল ওই ঘটনায়। তাই যদি হয়ে থাকে, তবে জেনে রাখুন বোর্ড কর্তাদের অতীতের কোনো এক ঘটনার ঝাল মেটানোর মিশন ছিল সেই নাটক। এই যদি হয় একটি দেশের ক্রিকেট প্রশাসনের হালচিত্র, তাদের অধীনে চলা দলের কাছে বড় প্রত্যাশা করা নিশ্চই বুদ্ধিমানের কাজ নয়!

বাংলাদেশ ক্রিকেটে বিবেকের চেয়ে আবেগের প্রয়োগ বেশি- কথাটা এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। সে আবেগ একদিকে নাটক মঞ্চস্থ করছে, অন্যদিকে দলকে ঘিরে ‘ফলস-কনফিডেন্স’ তৈরি করছে। এ জায়গায় ক্রিকেটামোদিদের আবেগ নিয়ে খেলছেন খোদ দেশের ক্রিকেট প্রশাসকরা। সে খেলার অংশ হিসেবে ‘গৃহপালিত দল’ বলে স্বীকৃতি জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে আনা হচ্ছে। ঘরের মাঠের চেনা কন্ডিশনে পুচকে দলটিকে উড়িয়ে সাধারণ ক্রিকেটামোদিদের আশায় বুক বাঁধার মঞ্চ তৈরি করাটা বিস্ময়কর ধারাবাহিক! মে মাসে যেমন জিম্বাবুয়েকে উড়িয়ে আনা হলো। ৫ ম্যাচ সিরিজের প্রথম চারটি টানা জিতল বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচে হেরে সিরিজের ফল ৪-১। সিরিজ জয়ের পরও এ নিয়ে একটা শ্রেণি সমালোচনায় মাতলেন; অন্যরা ‘ফলস-কনফিডেন্স’-এর বড়ি গিলেছেন।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গিয়ে শ্রীলঙ্কা হারানোর পর শক্তি-সামর্থ্য, বাস্তবতা সর্বোপরি অতীতে ইতিহাস ভুলে আবারও গণহারে প্রত্যাশার বেলুন ফোলানো শুরু। সেটা চুপসে যাওয়ার উপক্রম দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ হারের পর। ওই এক হারেই সর্বশেষ- বিষয়টি এমন নয়। বাংলাদেশ কোন পর্যন্ত যেতে পারবে, সেটাও নিশ্চিত নয়; কিন্তু ‘ফলস কনফিডেন্স’ দিয়ে আশার ভেলা ভাসানো, দারুণ এক জয়ের পর পা হড়কানো; শেষ পর্যন্ত প্রত্যাশা-প্রাপ্তির মাঝে বিস্তর ফারাক রেখে ‘পরের বিশ্বকাপ’ তত্ত্ব দিয়ে চলছে বাংলাদেশ ক্রিকেট। ভিন্ন ভিন্ন আসরে একই চিত্রনাট্য দিয়ে এগিয়ে চলা। মার্কিন মুলুক ও ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের যৌথ আয়োজনের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে সে ধারায় ছেদ টানুক বাংলাদেশ।

আইসিসির নিয়মের ফাঁক-ফোকরের প্রসঙ্গটা বর্ণনা করে ইতি টানা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচের সপ্তদশ ওভারে ওটনিল বার্টম্যানের একটি বল মাহমুদউল্লাহর প্যাডে লেগে বাউন্ডারির বাইরে চলে যায়। বল সীমানা পার হওয়ার আগেই আম্পায়ার লেগবিফোর উইকেটের সংকেত দেন। ক্রিকেটের আইন বলছে, আম্পায়ার আউট দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বল ‘ডেড’ বলে বিবেচিত। ‘ডেড’ বল কোথায় গেল সেটা মোটেও বিবেচ্য নয়। এ পর্যন্ত সবই ঠিক আছে; কিন্তু ওই ঘটনায় রিভিউ নিয়েছিল বাংলাদেশ। তাতে দেখা গেছে, বল মাহমুদউল্লাহর প্যাডে আঘাত না করলেও স্ট্যাম্পে লাগত না, যার অর্থ আম্পায়ারের সিদ্ধান্তটা ভুল।

সংকেত দিয়ে আউটের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেন; কিন্তু বল যে মাহমুদউল্লাহর প্যাডে লেগে সীমানার বাইরে গেল, সে প্রসঙ্গটা হাওয়ায় মিলিয়ে গেল কেন? আইনের ত্রুটি এখানেই। রিভিউ যখন দেখিয়ে দিল আম্পায়ারের সিদ্ধান্তটা বৈধ ছিল না। বৈধ নয়- এমন সিদ্ধান্ত রিভিউ নেওয়ার পর বাতিল হলো; অথচ ওই সিদ্ধান্তের কারণে ‘ডেড’ বল বহাল রাখা হচ্ছে কোন যুক্তিতে! ক্রিকেটের এ আইনটা অবশ্যই সাংঘর্ষিক, হাস্যকর!

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও ক্রীড়া বিশ্লেষক

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ