চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে করা মামলার বৈধতা নিয়ে যা বললেন আইনজ্ঞরা
বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীর বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগে গত ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানায় রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেন বিএনপি নেতা ফিরোজ খান। মামলা করার পর চান্দগাঁও থানার মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খানকে গত ১ নভেম্বর দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এই মামলায় গত সোমবার রাতে ঢাকা বিমানবন্দর এলাকা গ্রেপ্তার করা হয় চিন্ময় দাসকে। আর গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তার জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। তবে আইনজ্ঞদের অভিমত, ‘কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এ মামলা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনও অনুমতি ছিল না। তাই মামলাটি যথাযথ হয়নি।’
অন্যদিকে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীরা বলেছেন, ‘চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে যথাযথ প্রমান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে মামলা করায় বাদী ফিরোজ খানকে দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তাই এর দায় এখন বিএনপির নেই।’
আইন অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। এ ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা যাবে না। এদিকে, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা বাতিল করে গত ৩০ অক্টোবর রায় দেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ। রায়ে আদালত বলেন, ‘কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এ মামলা করার ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের কোনো অনুমতি ছিল না।’
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জয়নুল আবেদীন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আইন অনুযায়ী কারও বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। ‘চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে করা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার ক্ষেত্রে তা হয়নি বলে জানি। এ জন্য বাদী বিএনপি নেতা ফিরোজ খানকে দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। অবশ্য এভাবে নিয়মবহির্ভূতভাবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। যা পরবর্তীতে বাতিল হয়েছে।’
বিএনপির চেয়ারপারসনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক সহায়ক কমিটির সদস্য ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা চাইলেই কেউ নিজে নিজে কারও বিরুদ্ধে করে ফেলতে পারে না। এর একটি প্রক্রিয়া আছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এর জন্য অনুমোদন নিতে হয়। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের ক্ষেত্রে সেটা হয়েছে কি না, তা বলতে পারছি না। না হয়ে থাকলে এই মামলা যাথাযথ হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘আপনারা জানেন যে ওই মামলার বাদীকে মামলা করার পরের দিনই দল থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।’
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা যায় না। চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে বাদী যে অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাটি করেছেন সেটা শতভাগ প্রমানিত কি না, সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। মামলার প্রক্রিয়াও সঠিক হয়নি।’ এদিকে ডিবি পুলিশ থেকে বলা হয়েছে, ‘মামলা নয়, একটি অভিযোগের রিক্যুইজিশনের ভিত্তিতে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের সাজা
বাংলাদেশে প্রচলিত দণ্ডবিধির ১২১ ধারা থেকে ১২৬ ধারা পর্যন্ত রাষ্ট্রবিরোধী অপরাধের প্রকৃতি ও শাস্তির বর্ণনা দেয়া হয়েছে। ১২৪(ক) ধারায় রাষ্ট্রদ্রোহের সংজ্ঞা দেয়া আছে। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি উচ্চারিত বা লিখিত কথা বা উক্তি দ্বারা, কিংবা চিহ্নাদি দ্বারা, কিংবা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কিংবা অন্য কোনোভাবে বাংলাদেশ বা আইনানুসারে প্রতিষ্ঠিত সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ সৃষ্টি করে বা করার চেষ্টা করে কিংবা বৈরিতা উদ্রেগ করে বা করার চেষ্টা করে, তাহলে সেই ব্যক্তি যাবজ্জীবন কিংবা যে কোনো কম মেয়াদের কারাদণ্ডে যার সঙ্গে জরিমানা যুক্ত করা যাবে, কিংবা ৩ বৎসর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তৎসহ তাকে জরিমানায়ও দণ্ডিত করা যাবে।’
দণ্ডবিধির ১২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা বা যুদ্ধ ঘোষণার উদ্যোগ বা যুদ্ধ ঘোষণায় সহায়তা করলে সেই ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং তদুপরি অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। ১২১(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ১২১ ধারায় দণ্ডিত অপরাধ সংগঠনের ষড়যন্ত্র করলে উক্ত ব্যক্তি যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। ১২২ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধের উদ্দেশ্যে অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করলে সেই ব্যক্তিও যাবজ্জীবন পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে।’ ১২৩ ধারায় এ ধরনের অপরাধ সুগম করার অভিপ্রায়ে ষড়যন্ত্র গোপন করলে ১০ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ড ভোগ করবে।
দণ্ডবিধির ১২৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র সৃষ্টির নিন্দা করা ও উহার সার্বভৌমত্ব বিলোপ সমর্থন করলে বা সেই মর্মে প্রচারণা চালালে দশ বৎসর পর্যন্ত সেই ব্যক্তিকে কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে।’ দণ্ডবিধির ১২৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো আইনানুগ ক্ষমতা প্রয়োগে বাধ্য করা বা বাধাদান করার অভিপ্রায়ে রাষ্ট্রপতি, গর্ভনর প্রমুখ ব্যক্তিকে আক্রমণ করলে সেই ব্যক্তি সাত বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইবে। আর ১২৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে মৈত্রীসূত্রে আবদ্ধ কোন এশীয় শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেষ্টা করলে সেই ব্যক্তিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।’ ১২৬ ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বিদ্যমান কোন শক্তির রাষ্ট্রীয় এলাকার ওপর হামলা বা লুণ্ঠন অনুষ্ঠান করলে উক্ত ব্যক্তি ৭ বৎসর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে