মূল্য বৃদ্ধি না করে জ্বালানির বিকল্প সমাধান খোঁজার সুযোগ ছিল
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে ধরনের সংকট এবং চাপের মধ্যে, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। অধিকাংশ মানুষ, বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না; কিন্তু ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে চলেছে। আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে সমন্বয় সাধনে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। বিশেষ করে করোনার পর থেকেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির অজুহাতে অভ্যন্তরীণ বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর পর থেকে অন্য সবক্ষেত্রের ব্যয় বৃদ্ধি পায়। পরে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমে এলেও স্থানীয় বাজারে জ্বালানি তেলের মূল্য কমানো হয়নি।
মূল্যস্ফীতির ঊধ্বমুখী প্রবণতার মধ্যে আবারও গ্যাস এবং বিদ্যুতের মূল্য একই সঙ্গে বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ফলে আগামীতে অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে- এটা নিশ্চিত বলা যায়। এর ওপর কিছু দিনের মধ্যেই পবিত্র রমজান মাস শুরু হচ্ছে। প্রতি বছরই রমজান মাসে আমাদের দেশের বাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। এবার রমজান মাসে পণ্যমূল্য আরও বেশি হারে বৃদ্ধির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সব মিলিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে সৃষ্ট মূল্যস্ফীতি আরও খারাপ হবার আশঙ্কা রয়েছে, যারা দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী, যারা এর মাধ্যমে বিপুল মুনাফা লুটে নিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ সরকারের তরফ থেকে দেখা যায় না, তারা সরকারের খুবই ঘনিষ্ঠজন। আর এর পুরো চাপটা বহন করতে হচ্ছে সর্বজনকে।
এখন বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে সব শ্রেণি পেশার মানুষকে শুধু বিদ্যুতের বেশি দাম দিলেই হবে না। বিদ্যুৎ সব ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদনের কাজে প্রয়োজন হয়। কাজেই সবকিছুরই দাম বাড়বে। সরকার প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে যদি এক টাকা বেশি আয় করে জনগণকে অন্তত অতিরিক্ত ৫ টাকা বা তারও বেশি বোঝা টানতে হবে। শুধু ভোক্তা নয় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধিতে ছোট ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদনশীলতা এবং প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমে যাবে। যারা বড় শিল্প, তারা তো নানাভাবে সরকারের কাছে থেকে প্রণোদনা পেয়ে থাকে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা তাদের শোধ না করলেও চলে। কাজেই যারা বড় উদ্যোক্তা তাদের হয়তো ততটা ক্ষতি হবে না কিন্তু যারা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী তারা বিপদে পড়বেন। অনেকেই তাদের কারখানা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। তারা যদি ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করে থাকেন তাহলে সেই ঋণের কিস্তি পরিশোধের ক্ষমতাও তাদের কমে যাবে। অর্থাৎ সার্বিক বিবেচনায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা চরম বিপাকে পতিত হবেন। একই সঙ্গে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে তাদের বিক্রিও কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ তারা সব দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীরা আন্তর্জাতিক বাজারে অন্য দেশের পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। এমনকি অভ্যন্তরীণ বাজারেও তারা বিদেশি পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার কুলিয়ে উঠতে পারবেন না। বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি সামগ্রিকভাবে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থানের সুযোগও কমে যেতে পারে। ফলে দরিদ্র্সীমার নিচে মানুষের সংখ্যা বাড়বে।
প্রশ্ন হলো, সরকার যে বারবার গ্যাস, বিদ্যুৎ, জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধি করছে, এর কি কোনো বিকল্প ছিল না? ছিল, অনেক ছিল। জ্বালানি সক্ষমতা গড়ে তোলার জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হয়। ২০১০ সালে দায়মুক্তি আইন করা হয়। সেই সময়ই আমরা আশঙ্কা করেছিলাম, এ খাত নিয়ে এমন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হতে পারে, যেটা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতে পারে। যে কারণে আগে থেকেই দায়মুক্তি দিয়ে রাখা হয়। বাস্তবে আমরা দেখলাম, এর চেয়েও ভয়াবহ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ খুব সহজ ছিল, তা করা হয়নি। আমরা জাতীয় সক্ষমতা বিকাশের মাধ্যমে স্থলভাগে ও সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা করতে পারতাম। এর জন্য হয়তো আমাদের কয়েক শত কোটি টাকা ব্যয় করার প্রয়োজন হতো; কিন্তু তা না করার কারণে কয়েক লাখ কোটি টাকা বাড়তি খরচ করতে হয়েছে। একই সঙ্গে নবায়ণযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া যেত। বাংলাদেশের জন্য টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তা গড়ে তোলার জন্য গ্যাস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির সমন্বিত ব্যবস্থাই হতো সর্বোত্তম সমাধান।
আমরা ২০১৭ সালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য একটি নিরাপদ, সুলভ ও পরিবেশবান্ধব পাল্টা মহাপরিকল্পনা প্রকাশ করেছিলাম। সেখানে আমরা পরিষ্কার দেখিয়েছি যে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ ও পারমাণবিক বিদ্যুৎ সারা দেশের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর এবং আর্থিকভাবেও অযৌক্তিক। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ চাহিদা পূরণের জন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ এবং পারমাণবিক বিদ্যুতের কোনো প্রয়োজন নেই। এগুলোতে ব্যয় বেশি হবে, পরিবেশের জন্য ক্ষতি হবে, বিদেশি ঋণগ্রস্ততা বাড়বে, উপকরণ আমদানি নির্ভরতা বৃদ্ধি পাবে। সে জন্য আমরা প্রথম থেকেই বিদ্যুৎ ও গ্যাস উৎপাদনে জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানোর প্রতি জোর দিয়েছিলাম। আমাদের প্রস্তাব মোতাবেক যদি গ্যাস ও নবায়ণযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে এই খাতকে সাজানো হতো তাহলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যেত এবং তার মূল্যও ক্রমান্বয়ে কমে আসত। পরিবেশের ওপরও কোনো ক্ষতি হতো না। সরকার সে পথে না গিয়ে তিনটি জিনিস করল, তাহলো ঋণনির্ভরতা বৃদ্ধি, আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি এবং বিদেশি কোম্পানি নির্ভরতা বৃদ্ধি। বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হলো।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এলেও বাংলাদেশ সরকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি গুরুত্বারোপ করে চলেছে। অধিকাংশ বড় প্রকল্পই আন্তর্জাতিকভাবে যে খরচ হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যয় করা হলো। ফলে অপচয় হলো, দুর্নীতি হলো এবং ঋণগ্রস্ততা বাড়ল। দ্বিতীয়তা এসব প্রকল্পের কারণে আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। স্থানীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ব্যবস্থা না করার ফলে এলএনজি আমদানিনির্ভরতা বৃদ্ধি পায়। এক পর্যায়ে আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির মূল্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ফলে আমাদের উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানি করতে হয়। যে কোনো পণ্যের ওপর আমদানিনির্ভরতা থাকলে আপনাকে ধরে নিতে হবে যে কোনো সময় আমদানি ব্যয় বাড়তে পারে। কয়লা এবং এলএনজি আমদানির কারণে আমদানির ব্যয়ের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎ উপকরণ আমদানির বিষয় তো ছিলই। বিদ্যুৎ খাতের বেশির ভাগ উপকরণই আমদানিনির্ভর। এর সঙ্গে বিদেশি কোম্পানিগুলো যুক্ত। আর দেশীয় কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে যেসব কোম্পানি জ্বালানি নিয়ে ব্যবসা করছে, তাদের আয়ের পরিমাণ বিশ্বের যে কোনো দেশের জ্বালানি পণ্য নিয়ে ব্যবসায়রত কোম্পানিগুলোর চেয়ে অনেক গুণ বেশি।
সরকার ব্যক্তি খাতে একের পর এক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের অনুমতি দিয়ে গেছে। দেশে যে পরিমাণ বিদ্যুতের চাহিদা আছে, তার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা হয়ে গেছে অনেক বেশি। ফলে সব বিদ্যুৎকেন্দ্র তাদের উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারছে না। অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘ দিন ধরে অলস হয়ে বসে আছে। কম টাকায় যেখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, সেটাকে বন্ধ রেখে সরকার বেশি টাকা দিয়ে ব্যক্তি মালিকানাধীন পাওয়ার প্লান্ট থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় করছে। আবার কখনো কখনো ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ প্রতিষ্ঠানগুলোকে বসিয়ে রেখে তাদের ক্যাপাসিটি চার্জ দিচ্ছে।
গত ১০ বছরে ১০-১২টি কোম্পানিকে বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া হয়েছে ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। এর ফলে ব্যক্তি মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোর লাভ হয়েছে। উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানি, বিদেশি ঋণ গ্রহণ, ক্যাপাসিটি চার্জ প্রদান এসব কারণে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। সরকারর বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির কথা বলে থাকে; কিন্তু উৎপাদন ব্যয় কেন বাড়ল তা বলা হয় না। বিদ্যুৎ খাতের জন্য সরকারের যে মহাপরিকল্পনা জাপানি ঋণে ও তাদের দ্বারা করা হয়েছে, তা অনুসরণ করতে থাকলে আগামীতে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য আরও বৃদ্ধি পেতে থাকবে। গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধির সুবিধাভোগী হচ্ছে দেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এবং কমিশনভোগীরা। আর দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সাধারণ মানুষ। বিকল্প পথে সমস্যার সমাধানের খুব ভালো সুযোগ উপেক্ষা করে অর্থনীতির জন্য বোঝা এবং জনগণের জন্য দুর্ভোগ সৃষ্টি করা বড় অপরাধ।
আনু মুহাম্মদ: বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে