সকালে বহিষ্কার, বিকেলে বিরোধীদলীয় নেতা!
জাতীয় পার্টিকে আমি সবসময় জাতীয় সার্কাস পার্টি বলি। স্বৈরাচারী এরশাদের হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দুষ্টক্ষত। ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি এরশাদ ক্ষমতায় থাকতে জন্ম নেয়া জাতীয় পার্টির কোনো আদর্শিক চরিত্র নেই। পুরোটাই সুবিধাবাদিতায় ঠাসা। ক্ষমতার হালুয়া-রুটির লোভে জড়ো হওয়া নেতাদের নিয়ে জন্ম নেয়া দলটির আসল চরিত্র উন্মোচিত হয় ১৯৯০ সালে গণআন্দোলনে স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের মাধ্যমে। এরশাদ পতনের পর থেকে জাতীয় পার্টি কতবার ভেঙেছে, এখন ‘জাতীয় পার্টি’ নামে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত কয়টি সংগঠন আছে; তা একটি দারুণ গবেষণার বিষয়। জাতীয় পার্টি এবার আরেকটি ভাঙনের মুখে দাঁড়িয়ে। এবারের লড়াই দেবর-ভাবির।
বর্তমানে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন এরশাদের ছোট ভাই জি এম কাদের। তবে গত রোববার এরশাদের স্ত্রী রওশন এরশাদ জি এম কাদেরকে বহিষ্কার করে নিজেকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করেছেন। তবে মজাটা হলো, সকালে বহিষ্কার হওয়া জি এম কাদেরই রোববার বিকেলে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার মর্যাদা পেয়েছেন। এমন সার্কাস শুধু জাতীয় পার্টিতেই সম্ভব। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টির দ্বন্দ্ব প্রবল হয়েছে বটে, তবে এ দ্বন্দ্ব অনেক পুরোনো। এবারই প্রথম নয়, জাতীয় পার্টিতে এ ধরনের পাল্টাপাল্টি খুবই পরিচিত দৃশ্য। সব দলেই অন্তর্কোন্দল থাকে; কিন্তু জাতীয় পার্টির মতো এমন প্রকাশ্য ও সুস্পষ্ট দ্বন্দ্ব খুব বেশি নেই। জাতীয় পার্টির জন্ম ক্যুয়ের মাধ্যমে। তাই ক্যুয়ের বিষয়টি দলের নেতাদের মাথায় গেঁথে আছে। ক্যু তাদের খুবই পছন্দ।
মাঠের বিবেচনায় তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল হলেও বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কাগজে-কলমে প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। দশম ও একাদশ সংসদেও জাতীয় পার্টিই প্রধান বিরোধী দল ছিল। তবে সমস্যা হলো জাতীয় পার্টি যে সংসদে প্রধান বিরোধী দল, এটা মানুষ তো বিশ্বাস করেই না, আমার ধারণা জাতীয় পার্টি নিজেরাও নিজেদের বিরোধী দল বলতে লজ্জা পায়। এমন অদ্ভুত বিরোধী দল অবশ্য বিশ্বের ইতিহাসেই বিরল। ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকে জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নির্বাচনি জোটের অংশীদার। নির্বাচনের পর সেই জোটের অংশীদাররাই প্রধান বিরোধী দল হয়ে যায়।
২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি একই সঙ্গে প্রধান বিরোধী দলও ছিল, আবার মন্ত্রিসভায়ও ছিল। একই সঙ্গে সরকারে ও বিরোধী দলে থাকার অতীত কোনো উদাহরণ নেই। জাতীয় পার্টিকে সবাই আদর করে গৃহপালিত বিরোধী দল বলে। তবে গৃহপালিত বিরোধী দলের কীর্তিটি জাতীয় পার্টিরই গড়া। ১৯৮৮ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বাংলাদেশের মূলধারার সব রাজনৈতিক দল। তখন আ স ম আব্দুর রব কাগুজে ৭২ দল নিয়ে একটি সম্মিলিত বিরোধী দল (কপ) বানিয়ে এরশাদের সেই নির্বাচনকে বৈধতা দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। সে নির্বাচনে আ স ম আব্দুর রব ছিলেন গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা। গত দুই সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা ছিলেন রওশন এরশাদ। দেবরের সঙ্গে অভিমান করে রওশন এরশাদ এবার নির্বাচনেই অংশ নেননি। এবার তাই বিরোধী দলের নেতার আসনে বসবেন জি এম কাদের।
সমালোচনা যতই করি, আওয়ামী লীগ-বিএনপির বাইরে জাতীয় পার্টিরই কিছু জনসমর্থন ছিল। আর এই জনসমর্থনকে পুঁজি করেই দলটি আজ এ ঘাটে তো কাল ও ঘাটে নৌকা ভেড়ায়। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণআন্দোলনের মুখে পতনের পর কেউ ভাবেনি এরশাদ আবার এ দেশে রাজনীতি করার সুযোগ পাবেন; কিন্তু ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’ এই আপ্তবাক্যকে পুঁজি করে জাতীয় পার্টি বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিজেদের জায়েজ করে নিয়েছে। প্রথমে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন এরশাদ। এরপর বিএনপির সঙ্গে চারদলীয় জোট করে আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামে জাতীয় পার্টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোটের সাফল্যে আওয়ামী লীগ বুঝে যায়, তারা একা বিএনপির সঙ্গে পারবে না। তাই জাতীয় পার্টিকে কাছে টেনে নেয় আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচন থেকেই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের শরিক। তবে জাতীয় পার্টিতে বরাবরই দুটি ধারা বিদ্যমান- একটি আওয়ামীপন্থি, অন্যটি আওয়ামী বিরোধী। রওশন এরশাদ বরাবরই আওয়ামীপন্থি হিসেবে পরিচিত। এরশাদ বিভিন্ন সময়ে সরকারবিরোধী অবস্থান নেয়ার চেষ্টা করলেও নানা কারণে পারেননি। বিশেষ করে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে এরশাদ নির্বাচনে অংশ নিতে চাননি। এমনকি জোর করলে তিনি আত্মহত্যারও হুমকি দিয়েছিলেন; কিন্তু এরশাদকে অসুস্থ সাজিয়ে চিকিৎসার নামে সিএমএইচে আটকে রেখে আওয়ামী লীগ সেবার নির্বাচনি বৈতরণী পার হয়ে যায়। এরশাদ সিএমএইচ থেকে সরাসরি বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখান থেকে বের হন প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে। এরশাদের মতো তার ভাই জি এম কাদেরও বিভিন্ন সময়ে সরকারের সমালোচনা করেন।
এবারের নির্বাচনের আগেও তারা নির্বাচন থেকে পিছিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সরকার নানা কৌশলে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টিকে নির্বাচনে নিয়ে আসে। নিন্দুকেরা বলেন, স্ত্রী শেরিফা কাদেরের আসনে সমঝোতা নিশ্চিত হওয়ার পরই জি এম কাদের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সমস্যাটা হয় সেখানেই। সরকারের সঙ্গে জাতীয় পার্টির সমঝোতা হয়েছিল ২৬টি আসনে। এসব আসনে আওয়ামী লীগ তাদের প্রার্থী সরিয়ে নেয়। তবে স্বতন্ত্ররা ঠিকই মাঠে ছিলেন। তাতে জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরসহ ১৫ জনই পরাজিত হয়েছেন। মাত্র ১১ আসন নিয়ে সরকারের আনুকূল্যে বিরোধী দলের আসনে বসার সুযোগ পাচ্ছে জাতীয় পার্টি।
দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ ছিল আগে থেকেই। রওশন এরশাদ, তার ছেলে সাদ এরশাদসহ রওশনপন্থিরা এবারের নির্বাচনে অংশই নেননি। নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটার পর ক্ষোভের আগুনে ঘি পরে। স্ত্রীর আসনে সমঝোতার বিনিময়ে জাতীয় পার্টিকে বিক্রি করে দেয়া, নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিনিময়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে আত্মসাৎ করা, দলীয় প্রার্থীদের পাশে না দাঁড়ানোর অভিযোগে শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হয় দলীয় কার্যালয়ে। তারপর থেকে বিক্ষোভ, বহিষ্কার, পাল্টা বহিষ্কার, গণপদত্যাগ- নানান নাটকে বিপর্যস্ত জাতীয় পার্টি। দেবর-ভাবির দ্বন্দ্ব এখন বাংলাদেশের রাজনীতির রসালো আলোচনার বিষয়।
এরশাদের পতনের আগ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি একটাই ছিল; কিন্তু এরশাদ পতনের পর থেকে সুবিধাবাদীরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ে। জাতীয় পার্টি কতবার কতভাবে ভেঙ্গেছে তার হিসাব রাখা কোনো গবেষকের পক্ষেই সম্ভব নয়। এখনো নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পাওয়া তিনটি জাতীয় পার্টি আছে। জি এম কাদেরের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-জাপা, আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি-জেপি, নাজিউর রহমান মঞ্জুরের ছেলে আন্দালিব রহমান পার্থর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি বিজেপি। এ ছাড়া প্রয়াত কাজী জাফরের নামে একটি জাতীয় পার্টির আওয়াজ পাওয়া যায় মাঝে মধ্যে। আরও অনেক হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে। তবে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টির মাঠে নামা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
বিএনপি বর্জন করায় এবার জাতীয় পার্টির সামনে বড় সুযোগ ছিল। তারা চাইলে নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়ে সত্যিকারের বিরোধী দল হওয়ার চেষ্টা করতে পারতো; কিন্তু আওয়ামী লীগের সঙ্গে আসন সমঝোতায় জাতীয় পার্টির আমও গেছে, ছালাও গেছে। সমঝোতার পরও মাত্র ১১টি আসন জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকেই অনিশ্চিত করে দিয়েছে। শুধু আসন নয়, তাদের জনপ্রিয়তাও এখন তলানিতে। আসলেই জাতীয় পার্টি এক সার্কাসের নাম। চলিতেছে সার্কাস।
লেখক: লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে