Views Bangladesh Logo

থামছেই না বিচারবহির্ভূত ও বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা

কোনোভাবেই থামছে না বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। একই সঙ্গে বেড়ে চলছে গণপিটুনিসহ বিনা বিচারে হত্যার ঘটনা। এমনকি এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যাদের জড়িত থাকার অভিযোগ, তাদের বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত হচ্ছে না। বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা ও আইনজ্ঞদের মতে, এমন ঘটনা অব্যাহত থাকাটা দেশে মানবাধিকার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সবচেয়ে বড় বাধা। তাদের মতে, বিগত সরকারের আমলের মতো এখনো অব্যাহত আছে বিচারবহির্ভূত ও বিনা বিচারে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। সর্বশেষ এমন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার কুমিল্লার যুবদল নেতা তৌহিদুল ইসলাম।

গত ৩০ ডিসেম্বর কুমিল্লায় যৌথ বাহিনী তুলে নেয়ার পরদিন হাসপাতালে তার মৃতদেহ শনাক্ত করেন পরিবার। তৌহিদুল ইসলাম কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের পাঁচথুবী গ্রামের মোখলেছুর রহমানের ছেলে। তিনি ইউনিয়ন যুবদলের আহ্বায়ক ছিলেন। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকারের’ গত নভেম্বরে এক প্রতিবেদনে বলেছেন, ‘ গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটটি ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের’ ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে বিনা বিচারে গণপিটুনিতে ১৭ এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন।

২০২৪ সালের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে এক পর্যবেক্ষণমূলক বার্ষিক প্রতিবেদনে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে (মব জাস্টিস) বিনা বিচারে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তা উদ্বেগজনক। প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪ সালে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১২৮ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে নিহত হয়েছেন ৫৭ জন, রাজশাহী বিভাগে ১৯ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ১৮ জন, খুলনা বিভাগে ১৪ জন, বরিশাল বিভাগে ৭জন, ময়মনসিংহ বিভাগে ৫ জন, রংপুর বিভাগে ৫ জন এবং সিলেট বিভাগে ৪ জন নিহত হয়েছেন। ২০২৩ সালে গণপিটুনিতে নিহত হয়েছিলেন ৫১ জন।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের ২১ জনের বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়া বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে পুলিশ হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে ছয়জন, পুলিশের গুলিতে তিনজন, পুলিশ হেফাজতে একজন আত্মহত্যা করেছে। র্যাবের হেফাজতে শারীরিক নির্যাতনে একজন, বিজিবির ক্রসফায়ারে একজন, যৌথ বাহিনীর হেফাজতে গ্রেপ্তারের পরে শারীরিক নির্যাতনে সাতজন, নৌবাহিনীর নির্যাতনে একজন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হেফাজতে একজনের মৃত্যু হয়েছে। এই ২১ জনের মধ্যে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পরে ১২ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে, আসকের প্রতিবেদনে ‘মব জাস্টিস’ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, বিনা বিচারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এক তরুণকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে। চলমান পরিস্থিতিতে পিটিয়ে হত্যা বা মব জাস্টিসের মতো ঘটনার সঙ্গে রাজনৈতিক দলের পদধারী নেতা ও কর্মীরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। ৭ সেপ্টেম্বর রাতে পিটিয়ে হত্যা করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আবদুল্লাহ আল মাসুদকে। বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন বিনোদপুর বাজারে তার ওপর হামলা হয়। পরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় থানায় সোপর্দ করা হয়। এরপর হাসপাতালে নেয়া হলে মধ্যরাতে তিনি মারা যান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে গত সেপ্টেম্বরে বিশ্ববিদ্যালয়টির ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক শামীম আহমেদ ওরফে মোল্লা শামীমকে পিটিয়ে আহত করা হয়। পরে পুলিশ হেফাজতে তার মৃত্যু হলে সারা দেশে আলোড়ন সৃষ্টি হয়।

এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না ভিউ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের সংবিধান ও প্রচলিত আইনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতন নিষিদ্ধ হলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা এমন কাজ করেই যাচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় প্রায় সবগুলো বাহিনীর বিরুদ্ধেই এমন কাজ করার অভিযোগ আছে। এটা খুবই দুঃখজনক। অন্যদিকে, সম্প্রতি বেড়ে গেছে উচ্ছৃঙ্খল জনতার হাতে (মব জাস্টিস) বিনা বিচারে মানুষকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা। যা দেশবাসীকে নিরাপত্তাহীন করে তুলছে।

মানবাধিকার নেত্রী ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ফাওজিয়া করিম ফিরোজ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হতে কথিত সন্ত্রাসী ও বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্যদের হত্যা বিগত বছরগুলোতে যেভাবে হয়েছে, এখনো হচ্ছে। অথচ স্বাধীন জবাবদিহির অভাব এক ধরনের দায়মুক্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এখন পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা রাষ্ট্রীয় কোনো বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনো বিচার হয়েছে এমন নজির নেই। এতেই বোঝা যায় আমরা মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় কতটা ব্যর্থ।

অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বহু বছর ধরেই বাংলাদেশে আইনের শাসনের ঘাটতি দেখা যায়। ২০০৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ৯৫৪ জন। অথচ বিগত সরকারগুলোর আমলে এর কোনো বিচার হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালিন সরকার ক্ষমতায় আসার পরে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়নি বললেই চলে। সম্প্রতি কুমিল্লায় তৌহিদুল ইসলাম নামের একজন এমন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এটা সরকার তদন্ত করছে।’ মব জাস্টিসের বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইনকর্মকর্তা বলেন, ‘এধরনের ঘটনা গত ৫ আগস্টের পরে কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে আমরা এ বিষয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেছি। এখন মব জাস্টিস থেমে গেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নে ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের আরও কাজ করতে হবে বলে আমি মনে করি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ