অমর একুশে বইমেলা ২০২৫
গোলাপ, তরুণ-তরুণীদের উল্লাস ও রং-বেরঙের সাজসজ্জায় মুখরিত ছিল মেলাপ্রাঙ্গণ
বইমেলার অন্যান্য দিনের তুলনায় সাধারণত ছুটির দিনে (শুক্রবার-শনিবার) লেখক, পাঠক ও দর্শনার্থীদের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠলেও মেলার সপ্তম দিন শুক্রবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল ছিল অনেকটা নিষ্প্রাণ; কিন্তু বিকাল ৪টার পর থেকে দর্শকদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠেছে মেলাপ্রাঙ্গণ।
বিকেল হতেই দর্শকদের বিশাল লাইন ছিল চোখে পড়ার মতো। তরুণ-তরুণীদের উল্লাস ও রং-বেরঙের সাজসজ্জা এক অন্যরকম আবহ সৃষ্টি করেছে। কমবেশি সবার হাতেই রং-বেরঙের ফুল। তাতে গোলাপের সংখ্যাই ছিল বেশি।
কারণ হিসেবে জানা যায়, ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু ‘ভ্যালেন্টাইন উইক’। সে হিসেবে আজ রোজ ডে। দিবসের মাহাত্ম্য কিংবা ছুটির দিন শুক্রবার হওয়ায় জনতার সব স্রোত যেন আজ বইমেলায় দেখা গিয়েছিল।
এদিকে, বেলা ১১টায় শুরু হওয়া শিশুপ্রহর জমে উঠেছিল। বাচ্চাদের নিয়ে অনেক পরিবারকে আসতে দেখা গেছে।
মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান সংলগ্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিশুরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে মেলায় এসেছে। কেউ শিশু চত্বরে ঘুরছে, কেউ বাবা-মায়ের সঙ্গে খেলছে। আবার কেউ নতুন খেলার সাথি পেয়ে আনন্দে ছোটাছুটি করছে। অনেকে ঘুরে ঘুরে বইও দেখছে।
অপরদিকে ছুটির দিনে বাংলা একাডেমির আয়োজনও ছিল চোখে পড়ার মতো। শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা, আবৃত্তি প্রতিযোগিতার ভিন্ন রকম আমেজ সৃষ্টি করেছিল মেলায়। এ ছাড়া নিয়মিত আলোচনা সভা, আবৃত্তি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, লেখক বলছি মঞ্চ, জুলাইর গল্প মঞ্চ- সব মিলিয়ে ছুটির দিনে পাঠক ও দর্শনার্থীর ব্যাপক উপস্থিতি আর নানান আয়োজনে জমজমাট ছিল বইমেলার পুরো চত্বর।
অপরদিকে মেলার সপ্তম দিনে আজ নতুন বই এসেছে ১৮৪টি। কবিতা ৬০, গল্প ২৬, উপন্যাস ৩৭, প্রবন্ধ ৫, গবেষণা ২, ছড়া ৪, শিশুসাহিত্য ৪, জীবনী ২, রচনাবলি ১, মুক্তিযুদ্ধ ১, নাটক ২, বিজ্ঞান ২, ভ্রমণ ৩, ইতিহাস ৫, রাজনীতি ২, ভাষা ১, গণঅভ্যুত্থান ৩, ধর্মীয় ৪, সায়েন্স ফিকশন ২ ও অন্যান্য ১৮।
শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা
অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে সকাল ৮.৩০ মিনিটে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় শিশু-কিশোর চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতা উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রাচ্যকলা বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুস সাত্তার। এতে ক-শাখায় ৩০৩, খ-শাখায় ৩২৫ এবং গ-শাখায় ১২২ জন সর্বমোট ৭৫০ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন।
শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতা
সকাল ১০টায় বাংলা একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে শিশু-কিশোর আবৃত্তি প্রতিযোগিতার প্রাথমিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক-শাখায় ১৪১ জন, খ-শাখায় ২০৭ জন এবং গ-শাখায় ৮৫ জন সর্বমোট ৪৩৩ জন প্রতিযোগী অংশগ্রহণ করেন। বিচারক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ড. তারিক মনজুর, অধ্যাপক শায়লা আহমেদ এবং বাচিকশিল্পী শফিকুর রহমান বাহার।
আলোচনা অনুষ্ঠান
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘সাংস্কৃতিক ইতিহাসের দর্পণে গোলাম মুরশিদ পাঠ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সামজীর আহমেদ। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন স্বরোচিষ সরকার এবং গাজী মো. মাহবুব মুর্শিদ। সভাপতিত্ব করেন মোরশেদ শফিউল হাসান।
প্রাবন্ধিক বলেন, গোলাম মুরশিদের ইতিহাসভিত্তিক আলোচনা বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস-চর্চায় পথিকৃৎ সমতুল্য। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রাতিষ্ঠানিকতা পেলে গোলাম মুরশিদ হবেন তার পুরোধা ব্যক্তি। তার ইতিহাস চর্চার প্রধানতম বৈশিষ্ট্যগুলো হলো উপেক্ষিতের প্রতি নজর, আন্তঃশৃঙ্খলাধর্মিতা এবং ব্যক্তিকে ইতিহাসের কর্তাসত্তায় অধিষ্ঠিত করা। বাংলাদেশে প্রথাগত ইতিহাস চর্চায় তার নাম যতটা উজ্জ্বল, এর চেয়ে সাংস্কৃতিক ইতিহাসে তিনি দারুণ শক্তিমান। বাংলা সাহিত্যের প্রত্যক্ষ ইতিহাস না লিখলেও তার ইতিহাস চর্চা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
আলোচকদ্বয় বলেন, গোলাম মুরশিদের গবেষণা ও লেখালেখির জগৎ ছিল বিস্তৃত এবং বৈচিত্র্যময়। তিনি ছিলেন গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন এবং প্রজ্ঞাময় একজন গবেষক। অত্যন্ত নির্মোহভাবে তিনি ইতিহাসকে দেখার চেষ্টা করেছেন। সাহিত্য বিশ্লেষণ করে ইতিহাস ও জীবনী অনুসন্ধানে আত্মনিয়োগ করেছিলেন গোলাম মুরশিদ। সমাজ-ভাষাবিজ্ঞানের ইতিহাস ও রাজনৈতিক ইতিহাস চর্চা ছাড়াও অভিধান চর্চার দিক থেকেও গোলাম মুরশিদ উজ্জ্বলতম নাম হয়ে থাকবেন।
সভাপতির বক্তব্যে মোরশেদ শফিউল হাসান বলেন, বৈচিত্র্যসন্ধানী, গভীরস্পর্শী ও পরিশ্রমী গবেষক গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশের গবেষণা জগতে শ্রেষ্ঠ গবেষকদের একজন। বিদ্যাচর্চা ও গবেষণার ক্ষেত্রে তিনি আমাদের ও ভবিষ্যৎ গবেষকদের জন্য বাতিঘর হয়ে থাকবেন।
জুলাইর গল্পমঞ্চ:
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এর শহীদদের স্মরণে আজকের অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। সঞ্চালনায় ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক জুবায়ের ইবনে কামাল।
লেখক বলছি মঞ্চে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন কবি ও কথাসাহিত্যিক ইকতিজা আহসান ও কবি মৃদুল মাহবুব।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন কবি মোসা. ইসমত আরা এবং কবি মুহাম্মদ ইসমাইল। আবৃত্তি পরিবেশন করেন আবৃত্তিশিল্পী আরিফুল হাসান এবং আফরোজা পারভীন।
আজ ছিল মো. ফরিদুল হকের পরিচালনায় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘মাটির সুর সংগীত পরিষদ’-এর পরিবেশনা। সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী জি এম জাকির হোসেন, তানজিনা করিম স্বরলিপি, মাকসুদুর রহমান মোহিত খান, চম্পা বণিক, মুর্শিদা নাহিদ এবং শাহনাজ রহমান স্বীকৃতি। যন্ত্রানুসঙ্গে ছিলেন কাজী মো. ইমতিয়াজ সুলতানা (তবলা), ডালিম কুমার বড়ুয়া (কীবোর্ড), সুমন কুমার সাহা (অক্টোপ্যাড) এবং রিচার্ড কিশোর (গিটার)।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে