ভয় ও শঙ্কা: মাতৃভূমিতে ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছে রোহিঙ্গারা
মিয়ানমারে চলা গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশ সীমান্তেও। ফেব্রুয়ারি মাসের শুরু থেকে সীমান্তে থেমে থেমেই চলছে আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সেনা সরকারের যুদ্ধ। এর মধ্যে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় মিয়ানমারের ৩৩০ নাগরিক। যাদের গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সমুদ্রপথে মিয়ানমারে ফিরিয়ে নিয়ে গেছে দেশটির সরকার।
৩৩০ মিয়ানমার নাগরিক নিজ দেশে ফিরতে পারলেও নিজ দেশে ফেরার আশা ছেড়ে দিয়েছেন, ১৯৯২ ও ২০১৭ সালে জাতিগত নিপীড়ন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গা।
১৯৯২ সালে মাত্র এক বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে মিয়ানমার থেকে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন আবদু সালাম। নিজের দেশে ফেরার দিন গুনতে গুনতে বাংলাদেশের উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা রেজিস্ট্রার ক্যাম্পেই মারা গেছেন তার মা-বাবা। আর এখন মা-বাবার মতো সালামও স্বপ্ন দেখেন নিজের দেশে ফেরার। তবে সে স্বপ্নঘুড়ির সুতো যেন কেটে দিলো নতুন করে শুরু হওয়া মিয়ানমারের যুদ্ধ।
তিনি জানান, বাংলাদেশ অনেক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা চালিয়ে এলেও মিয়ানমার তাদের ফেরত নিচ্ছিল না। তবে গত বছর থেকে বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেছিল বলে জানতে পারেন তিনি। যে কারণে তিনিসহ অন্যান্য রোহিঙ্গারা দিন গুণতে শুরু করেছিলেন নিজ দেশে ফেরার। তবে সাম্প্রতিক এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমার আর রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবে না বলেই মনে করেন তিনি।
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে চলা সে দেশের বিদ্রোহীদের যুদ্ধের প্রভাব এসে পড়েছে বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতেও। কুতুপালং রেজিস্ট্রার ক্যাম্পের সলিম খান বলেন, মিয়ানমারের কোনো সরকার এখনো সে দেশের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের স্বীকৃতি দেয়নি। এবং বিদ্রোহীরা যে যুদ্ধ করছে সেখানেও রোহিঙ্গাদের নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি। তাই বিদ্রোহীরা যদি ক্ষমতায় আসেও, তারাও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেবে না বলে মনে করেন তিনি।
তিনি জানান, দুদিন আগে মংডুতে থাকা আত্মীয়ের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছেন, সেখানকার বাজার, দোকানপাট সব বন্ধ। চাল, আলু, নুন, তেল কিছুই নেই তাদের কাছে। সরকার বা অন্য কোনো সংস্থার কেউই এখনো তাদের নিরাপত্তা বা খাবারের সহায়তায় এগিয়ে আসেনি। আর সেখানে বাংলাদেশে থাকা রোহিঙ্গাদের দায় মিয়ানমার নেবে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ দেখেন না তিনি।
এদিকে, চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের মধ্যে বা ক্যাম্পগুলোতে কোনো উৎসাহ বা উত্তেজনা যেন কাজ না করে সেদিকে নজর রাখতে প্রতিটি ক্যাম্প ইনচার্জ ও ক্যাম্পে কাজ করা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান। মিয়ানমারে চলমান এই অস্থিরতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন থমকে গিয়েছে বলেও জানান তিনি।
মূলত ২০২১ সালে মিয়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশটিতে চলছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। এবং সাধারণ জনগণ ও সে দেশের জাতিগত নিপীড়নের শিকার মানুষ ও জান্তা সরকারবিরোধী বিদ্রোহী দলের সঙ্গেই সংঘাত চলছে সে দেশের সেনাবাহিনী সরকারের।গত তিন বছরে চলমান সংঘাত রূপ নিয়েছে ভয়াবহতায়।
যার ফলে, ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ৩০ জানুয়ারি ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৫৫৪ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এক বিজ্ঞপ্তিতে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন এমনই এক তথ্য দিয়েছে। বিজ্ঞপ্তিতে গত ২৬ জানুয়ারি সেখানে ২৩ রোহিঙ্গা নিহতের দাবিও করেছে সংস্থাটি। পাশাপাশি তাদের দাবি, মিয়ানমারে অসংখ্য সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে আসেন প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা। যে সংখ্যাটি গত সাত বছরে বেড়ে হয়েছে ১২ লাখেরও বেশি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে