চাকরিচ্যুতির ভয়ে এস আলমের নিয়োগ দেওয়া কয়েক হাজার ব্যাংকার
চট্টগ্রামের বাশখালী উপজেলার আনোয়ার সা'দাত (ছদ্মনাম) ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশে প্রবেশনারি অফিসার পদে দুই বছর আগে যোগ দিয়েছেন। দেশের শীর্ষ স্থানীয় এই ব্যাংকে চাকরি পেতে তাকে কোনো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়নি। শুধু সিভি জমা দিয়ে 'মৌখিক পরীক্ষায়' উত্তীর্ণ হয়েই মিলেছে চাকরি। ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর নির্বিঘ্নেই চাকরি করছিলেন তিনি। তবে সরকার পরিবর্তনের পর তিনি আর স্বস্তিতে নেই। তার দিন কাটছে চাকরি হারানোর ভয় নিয়ে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে ফিরোজ হোসাইন (ছদ্মনাম) চলতি বছরের শুরুর দিকে যোগ দেন গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকে। তাকেও চাকরি পেতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়নি। সিভি জমা দিয়েই মিলেছে চাকরি। সরকার পরিবর্তনের পর থেকে চাকরিচ্যুতির আতঙ্কে দিন কাটছে তারও।
শুধু আনোয়ার সা'দাত বা ফিরোজ হোসাইন নয়, এক সময়ে এস আলমের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্তত ৭ ব্যাংকে নিয়োগ পাওয়া কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী চাকরি হারানের ভয়ে আছেন।
এমন অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে ভিউজ বাংলাদেশ। তারা বলছেন, ২০১৭ সালের পর থেকে এস আলমের মাধ্যমে চট্টগ্রাম অঞ্চলের কয়েক হাজার মানুষের চাকরি হয় ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংকসহ কয়েকটি ব্যাংকে। অধিকাংশকেই কোনো পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়নি। মূলত এস আলমের বাড়ির সামনে রাখা 'চাকরির বক্সে' সিভি জমা দিয়ে তারা চাকরি পেয়েছেন। এখন ব্যাংকগুলো থেকে এস আলমের নিয়ন্ত্রণ চলে যাওয়ায় তার নিয়োগ করা কর্মীদের চাকরিচ্যুত করা হতে পারে এমন খবর ছড়িয়ে পড়েছে।
কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির ভয় আরও বেশি বেড়েছে গত ৩১ অক্টোবরের পর। ওইদিন একযোগে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫৮৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে; যাদের প্রায় সবার বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায়। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ও সনদ যাচাই ছাড়াই চলতি বছর তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক বলছে, 'শৃঙ্খলা ফেরাতে' প্রবেশনারি সময়কালে থাকা এসব কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এভাবে নিয়োগ পাওয়া অন্যদের বিষয়েও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে ব্যাংকটির একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, ব্যাংক কোম্পানি আইনে ভেঙে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলম ও তার পরিবারের সদস্যরা ২০১৭ সাল থেকে বিভিন্ন সময়ে নজিরবিহীনভাবে ইসলামী ব্যাংক, সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, আল আরাফাহ ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকসহ দুটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বড় অঙ্কের শেয়ার দখলে নেয়। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোর একক নিয়ন্ত্রণ যায় তাদের হাতে। নিয়ন্ত্রণ পেয়েই শীর্ষ পদসহ এন্ট্রি লেভেলের পদগুলোতে নজিরবিহীন অনিয়মের মাধ্যমে কয়েক হাজার জনবল নিয়োগ দেয়।
তবে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করার পর ব্যাংকগুলোর পর্ষদ এস আলম মুক্ত করা হয়। এরপর থেকে এস আলমের নিয়োগ করা ব্যাংকারদের চাকরিচ্যুত করা হবে এমন খবর ছড়িয়ে পড়ে। তার অংশ হিসেবেই একযোগে সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৫৮৯ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
চাকরি হারানোর ভয়ে থাকা আনোয়ার সা'দাত ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, এ বছর আমার বয়স ৩০ পূর্ণ হয়েছে। সরকারি চাকরির সময়ও শেষ। ব্যাংকে জয়েন করার পর বিয়েও করেছি। এখন চাকরি চলে গেলে পথে বসতে হবে।
প্রায় একই কথা বলেন ফিরোজ হোসাইন। তিনি বলেন, শুধু সিভি দিয়ে চাকরি নিলেও কর্মক্ষেত্রে ইতিমধ্যে দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছি। এখন চাকরি চলে গেলে নতুন করে চাকরি খোঁজা খুবই কঠিন হবে। জানি না কপালে কি আছে।
এস আলমের নিয়োগ করা কর্মকর্তাদের চাকরিচ্যুতির বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রবেশনারি অফিসারদের বিষয়ে ব্যাংক কী সিদ্ধান্ত নেবে এখনি তা বলা যাচ্ছে না। তবে বড় পদগুলোতে এস আলমের বসানো যেসব কর্মকর্তা এখনো রয়েছেন তারা যেকোনো সময় চাকরি হারাতে পারেন।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক জানিয়েছে, তাদের মোট জনবল ৪ হাজার ৭৫০ জন। এর মধ্যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয় ২ হাজার জনকে।২০১৭ সালে এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটি দখলে নেওয়ার পর এসব নিয়োগ হয়। এসব কর্মকর্তাকে ছাঁটাই করা হতে পারে।
সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ন্যূনতম যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই অপ্রয়োজনীয় অনেক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি এমন যে, অনেক শাখায় বসার জায়গা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না। নানাভাবে তারা বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে। শৃঙ্খলা ফেরাতে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১০ নম্বর শর্তের আলোকে তাদের ছাঁটাই করা হলো। এর মাধ্যমে ব্যাংকের ব্যয় সংকোচন হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে