অকুতোভয় কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ
আমরা পাঁচ ভাই-দুই বোনের মধ্যে কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ দ্বিতীয়, আমাদের মেজো ভাই। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির ছাত্র ছিলেন, ইন্টারউয়িং স্কলারশিপ নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি যান মাস্টার্স করতে। ১৯৬৫ সালে মাস্টার্স শেষ করে ওখানে পাকিস্তান রেডিওতে অনুবাদকের চাকরি নেন, মাসিক বেতন দুইশ টাকা। আমরা তখন তিন ভাই-এক বোন স্কুল, কলেজের শিক্ষার্থী। আমাদের বাবা আবদুর রশীদ মাস্টার ১৯২৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফেনীর জি এ একাডেমি স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন; ১৯২৬ সালে ফেনীর জিএম হাট এলাকার জমিদার গঙ্গাধর মজুমদারদের প্রদত্ত জমিতে একটি মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেই স্কুলের তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক। ষষ্ঠ শ্রেণিবিশিষ্ট ইংরেজি মিডিয়াম স্কুলকে তখন মাইনর স্কুল বলা হতো।
আর্থিক অনটন ছিল বলে আমাদের বড় ভাই ১৯৫৪ সালে মেট্রিক পাস করে একই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন। আমরা ভাই-বোনেরা বৃত্তি নিয়ে পড়লেও আমার বড় ভাই মুহাম্মদ সাহাব উদ্দিন এবং মেজো ভাই মহিউদ্দিনের সহায়তা না থাকলে আমাদের হয়তো প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব হতো না। বাবার নির্দেশে মহিউদ্দিন আহমদ রেডিও পাকিস্তানের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফেনী কলেজে প্রভাষকের চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ফেনী কলেজেরই ছাত্র ছিলেন। ফেনী কলেজে ছাত্র থাকাকালে পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন জনপ্রিয় গভর্নর আজম খান ফেনী কলেজ পরিদর্শনে এলে ছাত্র প্রতিনিধি হিসেবে মহিউদ্দিন আহমদ তার সঙ্গে কলেজ নিয়ে কথা বলেন, মহিউদ্দিন আহমদের ইংরেজিতে কথোপকথন আজম খানকে চমৎকৃত করে, মফস্বলের কোনো ছাত্র ইংরেজিতে অনর্গল কথা বলতে পারে তার ধারণাতীত ছিল। মহিউদ্দিন কলেজ থেকে বেতন পেয়েই প্রায় সব টাকা বাবাকে দিয়ে দিতেন।
পাকিস্তান সেন্ট্রাল সুপারিয়র সার্ভিস বা সিএসএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে তিনি ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। সিএসএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ তার ব্যাচমেটদের মধ্যে ছিলেন মীজানূর রহমান শেলী, ড. আকবর আলি খান, ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী, বীরবিক্রম, নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবুদ্দিন আহমদ প্রমুখ। প্রশিক্ষণের জন্য তাকে নেয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। মাস্টার্স পড়াকালে এবং সিএসএস প্রশিক্ষণে তিনি প্রচুর সময় কাটিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানে; তখন তিনি লক্ষ্য করেছিলেন পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যের বিরাট পাহাড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সলিমুল্লাহ হলের ছাত্রলীগ সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি, তাই রাজনীতির মাঠেও তিনি ছিলেন সক্রিয়। তার চাকরিজীবনে তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানকে তার বাসায় অনেকবার দেখেছি। প্রশিক্ষণ শেষে তৃতীয় সচিব পদে তার প্রথম পোস্টিং হয় লন্ডনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসে। ১৯৭১ সালে পদোন্নতি পেয়ে তিনি হন দ্বিতীয় সচিব।
দ্বিতীয় সচিব পদ থেকেই তিনি পাকিস্তানের লন্ডন দূতাবাস ত্যাগ করে পহেলা আগস্টে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেন। পহেলা আগস্টে প্রায় ৩০ হাজার বাঙালি লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারে জড়ো হয়েছিলেন; পাকিস্তান দূতাবাস থেকে বেরিয়েই মহিউদ্দিন আহমদ সরাসরি চলে যান বাঙালির এই জনসমুদ্রে, মঞ্চে ওঠে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেন, উল্লাসে ফেটে পড়ে ৩০ হাজার বাঙালি, সম্মিলিত কণ্ঠে স্লোগান ওঠে ‘জয় বাংলা’। যুদ্ধের শুরুতেই মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু মুজিবনগরের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সম্মতি না থাকায় পারেননি, আবু সাঈদ চৌধুরী বলতেন, ‘সময় হলে আমি বলব’।
মহিউদ্দিন আহমদই প্রথম কূটনৈতিক যিনি পশ্চিমা দুনিয়ায় প্রথম বাংলাদেশের আনুগত্য স্বীকার করেন। তখন তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা, তার আনুগত্য ঘোষণার ২২ দিন পর তাদের প্রথম সন্তান মেয়ে অরু মহিউদ্দিনের জন্ম হয়, দ্বিতীয় মেয়ে লোরা মহিউদ্দিনের জন্ম বাংলাদেশের মাটিতে। পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করার পর তার যাওয়ার কোনো ঠিকানা ছিল না, খাওয়ার কোনো পয়সা ছিল না, তবুও তিনি মাসিক ৩৬০ পাউন্ডের অভিজাতপূর্ণ চাকরি ছাড়তে একটুও ইতঃস্তত করেননি। পাকিস্তানে অবস্থানকারী বাঙালিরা চিঠি পাঠাত লন্ডনে, সেই চিঠি মহিউদ্দিন আহমদ বাংলাদেশে তাদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করতেন। তার কাছে শুনেছিলাম শিল্পপতি জহরুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধের জন্য ৫ হাজার পাউন্ড বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালের জানুয়ারির ৮ তারিখ মহিউদ্দিনের জীবনে একটি ঐতিহাসিক স্মরণীয় দিন; ওই দিনে তিনি পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়া জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে লণ্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে রিসিভ করার বিরল সৌভাগ্য অর্জন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনো জীবিত কি না সে ব্যাপারে কেউ নিশ্চিত ছিল না; কারণ বিচারে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছে, কবরও খোঁড়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত- এই সংবাদ প্রথম পেয়েছিলেন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যাণ্ড; বঙ্গবন্ধুকে বহন করা বিমানটির লণ্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণের মাত্র এক ঘণ্টা পূর্বে পাকিস্তানের তরফ থেকে তাকে বিষয়টি অবহিত করা হয়। সাদারল্যান্ডের কাছ থেকে বঙ্গবন্ধুর আগমনের বার্তা পান বাংলাদেশ মিশনের প্রধান এম এম রেজাউল করিম, রেজাউল করিম ফোন করেন মহিউদ্দিন আহমদকে, মহিউদ্দিন বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে তুলে নেন আরেক কূটনীতিক মহিউদ্দিন জায়গীরদারকে। তখন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশে ছিলেন। কনকনে শীতের মধ্যে ভোর ৫টার সময় বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানান উক্ত তিন কূটনীতিক।
বঙ্গবন্ধুকে দেখেই মহিউদ্দিন আহমদ কেঁদে ফেলেন, বঙ্গবন্ধু তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘ভয় নেই, আমি এসে গেছি।’ স্বাধীনতা লাভের পর মহিউদ্দিনকে বদলি করা হয় বাংলাদেশ মিশন ভারতে। সেখানে তার অন্যতম দায়িত্ব ছিল পাকিস্তান ফেরত বাঙালিদের বিমানবন্দরে রিসিভ করে বাংলাদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা। একদিন বিমানবন্দরে মিশনের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা হঠাৎ পাকিস্তান ফেরত এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে বসে, মেজো ভাই মহিউদ্দিন আহমদ দ্রুত ঘটনাস্থলে গিয়ে তাদের নিবৃত করে ভিকটিম রিয়াজ রহমানকে উদ্ধার করেন। জনশ্রুতি আছে যে, রিয়াজ রহমানকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ একটি চিরকুট পাঠিয়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করার অনুরোধ করেছিলেন, রিয়াজ রহমান সেই চিরকুটে থুতু দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। রিয়াজ রহমান ছিলেন দৈনিক অবজারভার পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরীর জামাতা। যে রিয়াজ রহমানকে মহিউদ্দিন আহমদ ভারতের বিমানবন্দরে ১৯৭৩ সালে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আক্রোশ থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই রিয়াজ রহমান তার পররাষ্ট্র সচিব থাকাকালীন ১৯৯২ সালে মহিউদ্দিন আহমদের চাকরিচ্যুতি নিশ্চিত করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনের অফিসে বুকেপিঠে লেখা নূর হোসেনের ছবি টাঙিয়ে রেখে মহিউদ্দিন অপরাধ করেছেন; অফিসে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ, খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার একাট্টা আরেকটি ছবিও ছিল।
বিএনপি সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মহিউদ্দিন মামলা করেন এবং রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদ তাকে ১৯৯৬ সালে চাকুরিতে পুনর্বহাল করেন। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ শুধু দেশের মাটিতেই হয়নি, বিদেশের মাটিতে কূটনৈতিক ফ্রন্টেও হয়েছিল। পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে অনেক বাঙালি কূটনৈতিক বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করায় সারা বিশ্বে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল; এই আলোড়ন সৃষ্টির একজন ছিলেন অকুতোভয় কূটনীতিক মহিউদ্দিন আহমদ। কূটনৈতিক ফ্রন্টের যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেও তিনি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট গ্রহণ করার তাগিদ বোধ করেননি, তিনি সরকার ঘোষিত দুই বছরের এন্টি ডেইটেড সিনিয়রিটিও নেননি। মুক্তিযোদ্ধার ভাতা গরিব ও নিঃস্বদের মধ্যে বিলিয়ে দেয়ার তাগিদেই তিনি মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট নিতে উদ্বুদ্ধ হন। তিনি নিঃস্ব-গরিব আত্মীয়স্বজনদের তালিকা করে প্রতি মাসে অর্থ সহায়তা করতেন, এমন কী মৃত্যুর পরও যাতে তারা আর্থিক সহায়তা পায় তার ব্যবস্থা করে গেছেন। তিনি নির্যাতিত শিশু গৃহকর্মীদের দেখার জন্য হাসপাতালে ছুটে যেতেন, তাদের আর্থিক সহায়তা দিতেন। শিশু গৃহকর্মীদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে তিনি পত্রিকায় বহু কলাম লিখেছেন। চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর বিভিন্ন পত্রিকায় তিনি প্রায় পনেরশ কলাম লিখেন। তার কিছু কলাম নিয়ে গত বই মেলায় পুঁথি নিলয় থেকে ‘রাষ্ট্র-পররাষ্ট্র’ নামে একটি বই বেরিয়েছে। তিনি তার পরিচিত ও বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে নিয়মিত তার বাসায় গেট টুগেদার করতেন- এই প্রীতি সম্মিলনে নিয়মিত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। এসব অনুষ্ঠানে বিশিষ্ট কলাম লেখক সাদ উল্লাহ নিয়মিত রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন, গিটার বাজাতেন দেশের প্রবীণ গিটারিস্ট ও গিটার প্রশিক্ষক এনামুল কবির, আরও গান গাইতেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের স্ত্রী শেরীফা কাদের এবং বিলকিস মহিউদ্দিন প্রমুখ।
মহিউদ্দিন ছিলেন রবীন্দ্রসংগীতের একনিষ্ঠ অনুরাগী, শুধু রবীন্দ্রসংগীত শোনার জন্য তিনি আরও বেশি দিন বাঁচতে চেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ ভক্ত মহিউদ্দিন আহমদ ২০১৮ সালের নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকায় মারাত্মক ক্ষুব্ধ ছিলেন। বর্তমান নির্বাচন কমিশন ক্ষমতায় আসার পর মত বিনিময়ের জন্য দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে মহিউদ্দিনকেও ডেকেছিল, ২০১৮ সালের মতো পরবর্তী নির্বাচনে নির্বাচন কমিশন নির্লিপ্ত থাকলে নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে তিনি মামলা করার হুমকি দিয়েছিলেন; কিন্তু ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদের নির্বাচন তিনি দেখে যেতে পারেননি। অবশেষে তিনি ভুল চিকিৎসায় ২০২২ সালের জুন মাসের ২০ তারিখে পৃথিবীর ছেড়ে চলে যান, তার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি একজন সৎ, নির্লোভ, জ্ঞানী, মানবতাবাদী লোককে হারাল, আর আমরা পরিবারের সদস্যরা হারালাম একজন দরদী ও পরার্থে আত্মোৎসর্গে বলীয়ান আপনজনকে।
লেখক: বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক ও টাকশালের সাবেক এমডি
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে