নারী ক্রিকেটারদের সঠিক কাজগুলোও করা দরকার
‘পরাজয়ই শেষ কথা’, ‘পরাজয়ের বৃত্ত থেকে বের হতে পারছে না নারী দল’, ‘মাঠে করুণ আত্মসমর্পণের শেষ কোথায়’, ‘আরেকবার হোয়াইটওয়াশ’ প্রিন্ট মিডিয়াতে নারী ক্রিকেট নিয়ে এসব শিরোনামই প্রকাশিত হচ্ছে সম্প্রতি। পড়তে আমাদের সবার খারাপ লাগে। তবে এটি বাস্তবতা। মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। আমাদের উচিত নারী ক্রিকেটে যেটি করণীয় সেদিকে মনোযোগ দেয়া।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নারী দল কঠিন এবং খারাপ সময় পার করছে। খেলার রাজার রোমাঞ্চকর চত্বরে যে ধরনের ভূমিকা আর ‘ক্যারেক্টার’ দেখানোর কথা সেটি থেকে দেশের নারী দল অনেক পিছিয়ে আছে। বোলিং এবং ব্যাটিংয়ে কারও ব্যক্তিগত নৈপুণ্য প্রদর্শন দলীয় ও পুরো খেলাতে বড় কোনো গুরুত্ব বহন করে না। যেটি প্রয়োজন দলীয় ‘কমপেক্ট’ পারফরম্যান্স। মানসিক দুর্বলতা, অনিশ্চয়তা আর প্রচণ্ড মানসিক চাপে ভুগলে তো কখনো নির্ভার খেলা সম্ভব নয়।
ক্রিকেটে নিজের অনুভূতির ওপর বিশ্বাস রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটাই একজন ভালো খেলোয়াড়ের সঙ্গে একজন খারাপ খেলোয়াড়ের পার্থক্য গড়ে দেয়। প্রতিটি খেলোয়াড়ের স্বকীয়তা আছে। আছে নিজকে মাঠে তুলে ধরার নিজস্ব স্টাইল। নিজের চিন্তাকে একটি ফ্রেমে বেঁধে না রাখতে পারলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে সাহসী ক্রিকেট খেলা সম্ভব নয়। ক্রিকেট শক্তি নয়- স্কিলের খেলা। এখানে মেধার পাশাপাশি বেশি দরকার মনোসংযোগ। মাঠে নিজের ভেতরের বারুদটাকে তো জ্বালাতে হবে। ক্রিকেটে সামর্থ্য প্রদর্শনই কিন্তু শেষ কথা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধে নামতে হবে জয়ের ক্ষুধা নিয়ে।
ক্রিকেট আমাদের ক্রীড়াঙ্গনে ইতিবাচক শক্তি। গত কয়েক বছর ধরে ক্রিকেট বাঙালি জীবনে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। ক্রিকেটের বদৌলতে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে আমাদের পরিচিত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা প্রতিপক্ষের কাছ থেকে সমীহ আদায় করতে সক্ষম হয়েছি; কিন্তু বর্তমান নারী ক্রিকেট দল আর সেই সুনাম ধরে রাখতে পারছে না।
প্রথমে অস্ট্রেলিয়া এরপর ভারতের বিপক্ষে দুটি সিরিজেই নারী দল পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে মাঠ ছেড়েছে। নারী ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়া সব সময় শক্তিশালী দল। পুরুষ দলের মতো নারী দলেরও একমাত্র লক্ষ্য বিজয়। আর এর জন্য তারা লড়াইয়ে শেষ বল পর্যন্ত লড়ে। ভারতের দলটিও ছিল ভারসাম্য এবং পুরো শক্তির অধিকারী। আইসিসির ফিউচার ট্যুর কর্মসূচির আওতায় বাংলাদেশে খেলতে এসেছিল অস্ট্রেলিয়া ও ভারত। পাশাপাশি অন্যতম উদ্দেশ্য হলো আসন্ন অক্টোবর মাসে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি নারী বিশ্বকাপ। খেলা হবে সিলেট এবং ঢাকায়। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের নারী দল কন্ডিশনের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়ার কাজটি বাংলাদেশ নারী দলের বিপক্ষে সিরিজ খেলার মাধ্যমে ধাতস্থ করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ নারী দল টিম ম্যানেজমেন্ট এবং নারী ক্রিকেট পরিচালনা কমিটি বুঝতে পেরেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নারী ক্রিকেটে আমরা কোথায় অবস্থান করছি। এখন আমাদের করণীয় কী। নারী ক্রিকেট নিয়ে যাদের চিন্তা-ভাবনা করার কথা- পর পর দুটি সিরিজ তাদের বন্ধ করা চোখ খুলে দিয়েছে। নারী হেড কোচ, কোচিং স্টাফ, টিম ম্যানেজমেন্ট সবাই কিন্তু সব কিছু বুঝে না বুঝে সময় পার করে চলেছেন। এক সময় সব হয়ে যাবে নারীরা ক্রিকেটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা সৃষ্টিতে সক্ষম হবেন, নারী ক্রিকেট ‘রাইট ডিরেকশনে চলছে’ এসব পরিস্থিতিকে সামাল দেয়ার জন্য। নারী ক্রিকেটের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট সবার কিন্তু জবাবদিহি এবং দায়বদ্ধতা থাকার কথা। কোচ, কোচিং স্টাফ এবং সবাই তো আবার দেখলেন তারা কোন ক্রিকেট নিয়ে সব সময় কথা বলেন ছোট এবং বড় করে।
ক্রিকেটাররা খেলেন তারা তাদের অভিজ্ঞতাকে কতটুকু কাজে লাগাতে পারছেন। কতটুকু সংশোধিত এবং নিজেদের স্কিল ও ট্যাকনিককে উন্নত করতে পারছেন এই প্রশ্নগুলো এখন অনেক বেশি জোরালো হচ্ছে।
আমরা ক্রিকেট শিখছি। একদিন বোলাররা ভালো করছে। আরেকদিন ব্যাটাররা ভালো করছে। ফিটনেস এবং ফিল্ডিংয়ে সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছে না- এই বক্তব্যগুলোর উত্তরে কী করার দরকার এটি তো নারী ক্রিকেট অপারেশন এবং টিম ম্যানেজমেন্টের অজানা নয়।
নারী ক্রিকেট ‘সুস্থ একটা প্রসেসের মধ্যে চলছে না’-কথাটি অপ্রিয় শোনালেও সত্যি। নারী ক্রিকেটে স্কোয়ার্ড গঠনে অগ্রগতি নেই। শূন্য স্থানগুলো পূরণ হচ্ছে না। খেলোয়াড় নেই। খেলোয়াড় কীভাবে আসবে? সেই উদ্যোগ নেই। নারী ফুটবলে যেভাবে খেলোয়াড় উঠে আসছেন ক্রিকেটের মতো খেলায় তো সেটি সম্ভব নয়। বাংলাদেশ নারী দলকে তো ক্রিকেট খেলতেই হবে, ক্রিকেট তারা খেলবেও। জাতীয় দলের বাইরে ক্রিকেটার কোথায়? যারা আসছেন তারা একদম নতুন তাদের ঘষেমেজে ঠিক করতে সময় লাগবে। এই ক্ষেত্রে উদ্যোগে ঘাটতি আছে।
নারী ক্রিকেটের সঙ্গে ভীষণভাবে জড়িয়ে আছে সামাজিক রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট। সামাজিক প্রতিবদ্ধকতার বিপক্ষে যুদ্ধে করে ফুটবলে যেভাবে নারী খেলোয়াড় আসছেন ক্রিকেটের এটি সম্ভব নয়। ক্রিকেটে বিকল্প চিন্তা ছাড়া উপায় নেই। নারী ক্রিকেটাররা ২০১৮ এশিয়া কাপ জিতেছেন। এশিয়ান গেমসে রৌপ্য পদক পেয়েছেন। সাউথ এশিয়ান গেমসে স্বর্ণ পদক জিতেছেন। ২০১৪ সালের পর আবার ২০২৪ সালে আসন্ন অক্টোবর মাসে নারী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ- বাংলাদেশ কোনো হতে রাজি হয়েছে-এটি বুঝার দরকার আছে।
বাংলাদেশ তো চ্যাম্পিয়ন বা রানার্স-আপ হবে না নিজ দেশে। বাংলাদেশের লক্ষ্য হলো আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে একটি বা দুইটি খেলায় জয় লাভ। সবচেয়ে বড় কথা হলো নারী বিশ্বকাপ দেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত হওয়া মানে- দেশের নারী ক্রিকেট ক্ষেত্রে অনেক বড় উৎসাহ অনুপ্রেরণা এবং জাগরণ সৃষ্টি। নারী ফুটবলাররা এখন ভালো করছেন আন্তর্জাতিক চত্বরে যেহেতু সম্ভাবনা আছে আর তাই ভাবা হচ্ছে নারী ক্রিকেটাররাও আগামীতে ধারাবাহিকতার সঙ্গে ভালো পারফরম্যান্স প্রদর্শনে সক্ষম হবেন। নারী দল দেশের বাইরে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জিতেছে। জিতেছে পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। জুলাই মাসে শ্রীলঙ্কায় নারী টি-টোয়েন্টি এশিয়া কাপ। এশিয়া কাপের খেলা এর আগে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের বিপক্ষে খেলা- এসব কিছুই কিন্তু নিজ দেশে আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কাজে লাগবে। অভিজ্ঞতা অর্জন আর সংশোধিত হবার তো বিকল্প নেই। নিজ দেশে আসন্ন বিশ্বকাপের প্রস্তুতিতে এসব কিছু কাজে লাগবে। কাজে লাগবে নারী বিপিএল। শুধু প্রয়োজন ইতিবাচক মানসিকতা এবং লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাওয়া।
বিশ্বকাপের আগে সময় পাওয়া যাবে দুই-তিন মাস। এই সময়টা বিদেশি কোচ এবং সাপোর্টিং স্টাফদের উচিত মেয়েদের ব্যাটিং, বোলিং এবং ফিল্ডিংয়ে এই তিন বিভাগে উন্নতি সাধনের জন্য কাজ করা। হতাশাজনক পারফরম্যান্স এই চিৎকার দিয়ে তো লাভ নেই। সঠিক কাজগুলো করা উচিত। মেয়েদের ‘স্কিল’ বাড়াতে হবে। টি-টোয়েন্টি কীভাবে খেলতে হবে- এটি তাদের মাথায় ঢুকাতে হবে। মেয়েদের মানসিক শক্তি বৃদ্ধির বিষয় নিয়েও কাজ করার প্রয়োজনীয়তা ভীষণভাবে অনুভূত হচ্ছে। মেয়েরা প্রত্যাশার চাপে ভোগের সব সময় বলা হয়। ক্রিকেটে চাপ থাকবেই। চাপ সামাল দিয়েই খেলতে হবে। আর এর জন্য টিম ম্যানেজমেন্টকে কাজ করতে হবে। আরেকটি বিষয় খুব জরুরি-পাইপ-লাইনে খেলোয়াড় বাড়ানো।
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি এআইপিএস এশিয়া, আজীবন সদস্য বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার ফুটবল এশিয়া।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে