সার সংকট দূরীকরণের স্থায়ী সমাধান এখনই ভাবুন
পঞ্চাশ বছর আগেও হয়তো আমাদের কৃষকরা ভাবতে পারেননি একদিন ডলার ও গ্যাসের সঙ্গে সারের সম্পর্ক জড়িয়ে যাবে। কারণ তারা তখন বেশির ভাগই ছিলেন জৈব সারনির্ভর; কিন্তু আজ দেশের কৃষি অনেকটাই কৃত্রিম সারনির্ভর হয়ে পড়েছে। আর কৃত্রিম সার উৎপাদন করতে দরকার কল-কারখানা, সেইসব কারখানা যে বিদ্যুৎ দিয়ে চলে তা আসে গ্যাস থেকে।
পাশাপাশি বিদেশ থেকেও প্রতি বছর প্রচুর পরিমাণে সার আমদানি করতে হয়। তার জন্য প্রয়োজন ডলার। বর্তমানে দেশে ডলার ও গ্যাস সংকট তীব্র। ফলে সার উৎপাদন ও আমদানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, শিগগিরই কাটছে না সার সংকট। এর কারণ হিসেবে কৃষি মন্ত্রণালয় দায়ী করেছে ডলার ও গ্যাস সংকটকে। দেশে প্রতি বছর বিভিন্ন ধরনের সারের মোট চাহিদা প্রায় ৬৫ লাখ টন। প্রাপ্ত তথ্যমতে, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ না থাকায় সার কারখানাগুলোর মাধ্যমে চাহিদার মাত্র ১৫ শতাংশ উৎপাদন করা সম্ভব হয়। অবশিষ্ট সার সরকারি পর্যায়ে বিসিআইসি ও বিএডিসি এবং বেসরকারি আমদানিকারকদের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়।
কিন্তু ডলার সংকটে গত জুন থেকে অন্তত তিন মাস সার আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলা স্থগিত ছিল। ফলে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুত গড়ে তুলতে না পারায় সারাদেশে সার সরবরাহে সংকট দেখা দিয়েছে। আমদানির জন্য মূল্য যথাসময়ে পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় বেশ কয়েকটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান সার সরবরাহ করেনি বলে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। কিছু ক্ষেত্রে চুক্তিবদ্ধ লটও বাতিল করা হয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করতে না পারায় এলসি খোলা হলেও মরক্কো, সৌদি আরব ও তিউনিসিয়া টিএসপি ও ডিএপি সারের পাঁচটি লটের জাহাজীকরণ বাতিল করে। পরবর্তী লটগুলোর শিপমেন্ট শিডিউল দিতে বিলম্ব করে। একইভাবে চীন ও রাশিয়াও নির্ধারিত সময়ে সার সরবরাহ করেনি। এমন অবস্থা চলমান থাকলে ভবিষ্যতে যথাসময়ে সার সরবরাহ কার্যক্রম ঝুঁকিতে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে, যা খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। এ ঝুঁকি এড়াতে সার রপ্তানিকারকদের যথাসময়ে মূল্য পরিশোধের বিকল্প নেই। সার কৃষির উল্লেখযোগ্য উপাদান। দেশের কৃষি বর্তমানে যে অবস্থায় পৌঁছেছে কোনোভাবেই আর জৈবকৃষির ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ানো সম্ভব নয়। এখন ডলার ও গ্যাসও আমরা বাড়াতে পারছি না।
তাহলে করণীয় কী? সার সংকট নিশ্চিতভাবেই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে। এই ঝুঁকি এড়াতে চড়া সুদে ঋণ নেয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তাও না-হয় হবে সাময়িক সমাধান। এর স্থায়ী সমাধান কী?
সার সংকটের কথা বেশ কয়েক বছর ধরেই শোনা যায়। নানারকম ভর্তুকি দিয়ে সরকার সার সংকটের সাময়িক সমাধান করে। সরকার ভাবে, এবার কোনোরকম পার পেয়ে গেলে পরেরবার দেখা যাবে; কিন্তু এর কোনো দীর্ঘমেয়াদি সমাধান কখনোই হয় না; কিন্তু এভাবে আর কতদিন? প্রশ্ন, বছরের পর বছর কি একই সমস্যা চলতে থাকবে?
যে উর্বর ভূমিতে আমাদের পূর্বপুরুষ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে জৈব সারের ওপর নির্ভরশীল থেকেই ফসল ফলিয়েছে আজ তার কেন এমন করুণ পরিণতি, যে সার ছাড়া কোনো ফসলই ফলে না! এই ভূমিতে তো যুগের পর যুগ আরও অনেক মানুষ বাস করবে, তাদের পরিণতিই-বা কী হবে! দিনের পর দিন কেবল সার ব্যবহারের মাত্রা বাড়বে, আর সেই সার জোগাতে না পেরে খাদ্য সংকট তৈরি হবে!
ভবিষ্যতের পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে তার আলামত এখনই বোঝা যাচ্ছে। সার এখন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গেই জড়িয়ে গেছ। তাই কোনো সাময়িক সমাধান নয়, দেশ-মাটি ও ভবিষ্যৎ-প্রজন্মের স্বার্থে সার তথা কৃষি ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের দীর্ঘমেয়াদি কোনো সমাধানের কথা এখনই ভাবতে হবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে