২৫ বছর পর ঘটছে এমন ঘটনা: ‘লা নিনা’য় ভর করে সময়ের আগেই এবার বর্ষার আগমন
বাংলা সালের আষাঢ় ও শ্রাবণ- এই দুমাস বর্ষাকাল। এ সময় দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবেশের মাধ্যমেই দেশে বর্ষার আগমন ঘটে। তবে ‘লা নিনা’ সক্রিয় থাকায় চলতি বছর আগেভাগেই বাংলাদেশের সীমানায় প্রবেশ করছে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা। এবার জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই মৌসুমি বায়ু সারা দেশে বিস্তার লাভ করতে যাচ্ছে। যা হবে গত ২৫ বছরে মধ্যে প্রথম। এর আগে ২০০০ সালে সর্বশেষ দেশে আগাম বর্ষা এসেছিল।
আবহাওয়াবিদ একেএম নাজমুল হক ভিউজ বাংলাদেশকে জানান, গত কয়েক বছর প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে ছিল ‘লা নিনা’র উপস্থিতি। ‘লা নিনা’ হচ্ছে ‘এল নিনো’র ঠিক বিপরীত। লা নিনা সক্রিয় থাকাকালে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পূর্ব থেকে পশ্চিমে বয়ে চলা বাযুর পরিবর্তন ঘটে। তখন উষ্ণ জলস্রোত প্রবাহিত হতে থাকে পশ্চিমের দিকে। এ সময় সমুদ্রের গভীর থেকে ঠান্ডা জল সমুদ্রের উপরিভাগে উঠে যায়। যার ফলে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে ঠান্ডা হয়ে যায়। এল নিনো যেমন তীব্র তাপপ্রবাহের কারণ, তেমনি লা নিনা ঠিক এর উল্টোটা। লা নিনা প্রভাব ফেলে বর্ষায়। ফলে আগাম ও কিছুটা বেশি বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা থাকে। এবার এই লা নিনা অনেকটাই সক্রিয়। তাই স্বাভাবিক আবহাওয়ার পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। গত ২৫ বছরের মধ্যে ভারতীয় উপমহাদেশ বর্ষায় প্রশান্ত মহাসাগরকে কখনো এমন অবস্থা পায়নি। এ কারণে এবার শুধু বাংলাদেশই নয়, পুরো ভারতীয় উপমহাদেশসহ মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস ও ভিয়েতনামেও আগাম বর্ষা আসতে যাচ্ছে।
কানাডার সাসকাচুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া ও জলবায়ু বিষয়ক গবেষক মোস্তফা কামাল পলাশ গত ২৭ মে তার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পোস্টে জানান- ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও আমেরিকার আবহাওয়া পূর্বাভাস মডেল থেকে পাওয়া সর্বশেষ পূর্বাভাস অনুযায়ী আগামী ৩১ মে শনিবার ১৭ জ্যৈষ্ঠ দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু দেশের টেকনাফ উপকূলে এসে পৌঁছাবে। এরপর ১ জুন কক্সবাজার, ২ জুন চট্টগ্রাম, ৩ জুন বরিশাল, খুলনা ও কুমিল্লা, ৫ জুন ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহ, ৬ জুন রাজশাহী এবং ৭ জুন রংপুর অঞ্চলে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু বা বর্ষা বিস্তার লাভ করবে এবং পুরোপুরি সক্রিয় হতে শুরু করবে। এ সময়ে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিমাণে বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, ফেনী, যশোর, সাতক্ষীরা, খুলনা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, মাগুরা, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, বরগুনা, বরিশাল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও সিলেট জেলায়। এছাড়া আগামী ৩০ মে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগরে ভারতের ওড়িশা ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের উপকূলেও দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু প্রবেশ করবে।
আবহাওয়াবিদ খন্দকার হাফিজুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, মৌসুমি বায়ু সাধারণত একটি নির্দিষ্ট সময়ে আসা-যাওয়া করে; কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই স্বাভাবিক নিয়মে অনেক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি, সমুদ্রের তাপমাত্রা পরিবর্তন এবং বায়ুমণ্ডলের নানা ধরনের অসঙ্গতির কারণে এমনটা হচ্ছে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় বায়ুমণ্ডলের চাপ এবং বায়ু প্রবাহের দিক পরিবর্তিত হচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকায় মৌসুমি বায়ু দ্রুত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। একইভাবে প্রশান্ত মহাসাগরের লা নিনার প্রভাবে এবার বাংলায় বর্ষার আগমন হচ্ছে অনেকটা আগেভাগেই। বৃষ্টির পরিমাণও এবার কিছুটা বেশি থাকতে পারে।’ আগাম বর্ষার ফল কী হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আগাম বর্ষা কৃষকদের জন্য কিছুটা স্বস্তি আনতে পারে। বিশেষ করে যারা বোরো ধান চাষ করেন, তারা সময়মতো ধান কাটতে পারলে ক্ষতির হাত থেকে বাঁচতে পারেন। অন্যদিকে অতিবৃষ্টি বা অসময়ের বৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। আগে বর্ষা এলে নদ-নদীর পানি বেড়ে গিয়ে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হতে পারে। পাহাড়ি অঞ্চলে অতিবৃষ্টির কারণে ভূমিধসের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং ঘূর্ণিঝড়ের ঝুঁকিও বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে আগাম বর্ষা আসা মানে আগেই তা শেষ হবে এমনটা নয়। অর্থাৎ বর্ষাকাল এবার দীর্ঘ হবে। এতে করে দীর্ঘমেয়াদি বন্যার সম্ভাবনা বেশি থাকছে। তবে এটা নির্ভর করছে বৃষ্টির পরিমাণের ওপরে। অস্বাভাবিক অতিবৃষ্টি না হলে প্রকৃতির জন্য এটা আগাম বর্ষাকে ভালোই বলা চলে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে