Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

একুশের বইমেলার পাঁচটি মননশীল বই

Kamrul  Ahsan

কামরুল আহসান

বুধবার, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

কুশে বইমেলা দুই সপ্তাহ পার করেছে। এর মধ্যেই মেলায় এসে পৌঁছেছে গুরুত্বপূর্ণ সব বই। শত শত বইয়ের ভিড়ের মধ্যেও ভালো বইগুলো পাঠক আলাদা করে চিহ্নিত করতে পারছেন। বইমেলায় সাধারণত গল্প-কবিতা-উপন্যাসই জনপ্রিয় হয় বেশি। তারপরও সমৃদ্ধ পাঠক খুঁজে নেন মননশীল সব বই। গত কয়েক বছর ধরেই দেখা গেছে বাংলাদেশে বর্তমানে মননশীল, চিন্তাশীল বা প্রবন্ধ গ্রন্থের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মেলা ঘুরে ভিউজ বাংলাদেশের প্রতিনিধি বাছাই করেছেন এবার প্রকাশিত পাঁচটি সেরা মননশীল বই, যেগুলোর দিকে পাঠক আলাদা করে চোখ রাখছেন। সেই মননশীল পাঁচটি বই নিয়ে আমাদের সংক্ষিপ্ত আয়োজন।
১. লেনিন কেন জরুরী
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিদ্যাপ্রকাশ

সিরাজুর ইসলাম চৌধুরী দেশের অগ্রগণ্য বুদ্ধিজীবী। ষাট বছরেরও অধিককাল ধরে শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-সংস্কৃতি নিয়ে লেখালেখি করে তিনি আমাদের সমৃদ্ধ করে যাচ্ছেন। তার একটি নিজস্ব-পাঠকগোষ্ঠী আছেন। সমাজ-সংস্কৃতি রাজনীতি নিয়ে যারা সচেতন তারাই মূলত সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পাঠক। প্রতি বছরই তার পাঠকরা অপেক্ষায় থাকেন এবারের বইমেলায় সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর নতুন কোনো বই প্রকাশিত হচ্ছে কি না। তার পাঠকদের জন্য সুখবর এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী রচিত ‘লেনিন কেন জরুরি’ বইট। এটি মূলত একটি প্রবন্ধের বই। বেশ কিছু প্রবন্ধ নিয়ে বইটি সাজানো হয়েছে। বইয়ের নামপ্রবন্ধ ‘লেনিন কেন জরুরি’ লেখা হয়ছিল ১৯৯২ সালে। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর। সমাজতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নেই এরকম একটা ধারণা তখন অনেকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। সমাজতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরতেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তখন কলম ধরেছিলেন। অন্যান্য প্রবন্ধের সঙ্গে এই প্রবন্ধটিও যুক্ত হয়েছিল। এবার, ২০২৪ সালের রাশিয়ার সমাজতন্ত্রের মূল প্রতিষ্ঠাতা বিপ্লবী ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিনের শততম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হলো পৃথিবীজুড়ে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রবন্ধটি আবার পাঠকের সামনে উপস্থিত করেছেন। এবারের সংস্করণে লেনিনের কাজের প্রাসঙ্গিকতা ও আবশ্যকতা দুটোই আগের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
২. অর্থশাস্ত্র: ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি
আনু মুহাম্মদ
প্রথমা


আনু মুহাম্মদ দেশের অন্যতম প্রধান অর্থনীতিবিদ। তিনি মূলত মার্ক্সীয় অর্থনীতি নিয়ে লেখালেখি করেন। পাশাপাশি সমাজ-রাজনীতিও আছে তার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি সর্বদাই আমাদের সজাগ রাখেন দুর্বৃত্ত ও লুটেরাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এবারের বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তার অত্যন্ত মূল্যবান একটি বই। অর্থশাস্ত্র: ইতিহাস দর্শন রাষ্ট্রনীতি। বইয়ের শিরোনাম দেখেই বোঝা যাচ্ছে বইটি মূলত অর্থশাস্ত্রের পর্যালোচনা। ইতিহাস দর্শন ও রাষ্ট্রনীতিতে অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে তাই তিনি দেখাতে চেয়েছেন। অর্থশাস্ত্রের ইতিহাস এখানে দর্শন ও রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। কৌটিল্য ও ইবনে খালদুন থেকে একেবারে সমকালীন নারীবাদী অর্থনীতি পর্যন্ত এর বিস্তার। বাংলাদেশে অনেক অর্থনীতির বই-ই পাওয়া যায়; কিন্তু এরকম বিশদ, গভীর ও সুপাঠ্য বই কমই পাওয়া যায়। এই বই পাঠকের সামনে অর্থনীতি বোঝার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি খুলে দেবে। শুরু থেকেই বইটি সচেতন সমৃদ্ধ-পাঠকের দৃষ্টি-আকর্ষণ করেছে।
৩. চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষ
মহিউদ্দিন আহমেদ
ঐতিহ্য


১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ বাংলাদেশের ইতিহাসের এক দুর্ভাগ্যের ইতিহাস। সদ্য-স্বাধীন দেশে এই দুর্ভিক্ষ অপ্রত্যাশিত হলেও কিছুটা অবধারিতই ছিল। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটি তখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি। সবই শেষ করে দিয়েছিল পাকিস্তানিরা। রাস্তাঘাট ভেঙে দিয়েছিল, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল, মজুদকৃত ফসলগুলোও পুড়িয়ে দিয়ে দিয়েছিল। লাখ লাখ কৃষক ছিলেন গৃহহীন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিদেশ থেকে যেসব ত্রাণ আনতেন তাও চুরি হয়ে যেত। নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। এর মধ্যে দেশ পড়ে বন্যার কবলে। শুরু হয় অনাহার। মহিউদ্দিন আহমেদ এই দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির সামগ্রিক বর্ণনা দিয়েছেন। কীভাবে কেন দুর্ভিক্ষ শুরু হলো, দুর্ভিক্ষের প্রভাব কোথায় কীভাবে পড়ল, সরকার ও বিরোধী দল কে কীভাবে দুভিক্ষ নিয়ে রাজনীতি করল, জনগণ কীভাবে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সামাল দিল সবই উঠে এসেছে এই বইয়ে। দুর্ভিক্ষের ফলে যে চুরি-ডাকাতির পরিমাণ বেড়ে গিয়েছিল তাও তিনি তুলে ধরেছেন। তুলে ধরেছেন সে-সময়ের বিভিন্ন পণ্যের বাজারদর। তথ্য সংগ্রহ করেছেন তিনি তৎকালীন পত্র-পত্রিকা ও গবেষণাগ্রন্থ থেকে। বইটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গবেষণাগ্রন্থ লিখে মহিউদ্দিন আহমেদ কয়েক বছর ধরে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। এ বইটি নিয়েও আলোচনা হবে আশা করা যাচ্ছে।
৪. সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা
যতীন সরকার
কথাপ্রকাশ

সংস্কৃতি ছাড়া সমাজ-রাজনীতি-রাষ্ট্র কোনো কিছুই সুসংগঠিত, সুপরিচালিত হয় না। আমরা স্বাধীনতা-আন্দোলন জাগিয়ে তুলেছি সংস্কৃতিক-আন্দোলন দিয়েই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা শুধু রাজনৈতিক ফল নয় বরং সাংস্কৃতিক বিকাশও; কিন্তু, স্বাধীনতার পর থেকে এ দেশে এক ধরনের সাংস্কৃতিক সংকট দেখা দিয়েছে। কীভাবে আমরা আবার নতুন সাংস্কৃতিক জাগরণ করতে পারি তাই এই গ্রন্থের মূল আলোচ্য বিষয়। যতীন সরকার আমাদের শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদ। পঞ্চাশ বছরেও অধিককাল ধরে তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতি-রাজনীতি নিয়ে লেখালেখি করছেন। বর্তমানে তিনি বেশ অসুস্থ। তাও কলম ধরেন দায়িত্ববোধ থেকে। প্রবন্ধগুলো লেখকের বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত পত্রিকার কলাম-নিবন্ধ-প্রবন্ধের একটি সংকলন। বইয়ের ভূমিকায় লেখক লিখেছেন, ‘যেভাবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চললে আমরা পাকিস্তানের ভূতের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারতাম, সেটা আমরা করতে পারিনি । সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে যেতে না পারার এই যে ব্যর্থতা, সেই ব্যর্থতা দূর করা নিয়ে আমাদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন ছিল। নতুন করে হলেও তা আমাদের জাগ্রত করতে হবে।’
৫. বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ
আবুল আহসান চৌধুরী
অন্যপ্রকাশ


ডক্টর আবুল আহসান চৌধুরী মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস নিয়ে লেখালেখি করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, লালন, হাসন রাজা, কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী, আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, হুমায়ুন কবির, আনিসুজ্জামানের মতো যুগপুরুষদের নিয়ে তার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক গবেষণাগ্রন্থ আছে। তার এবারের নতুন প্রকাশিত গ্রন্থ ‘বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ ও মুসলমান সমাজ’। বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথ তিনজনই বাঙালি নবজাগরণের যুগপুরুষ। ঊনবিংশ শতাব্দীর তিন মহাত্মা; কিন্তু, মুসলমান সমাজের সঙ্গে তাদের দূরত্ব নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাই হয়েছে। আবুল আহসান চৌধুরী দেখাতে চেয়েছেন সত্যিই মুসলমান সমাজের সঙ্গে তাদের কতটা দূরত্ব ছিল। মুসলমান সমাজও তাদের চিন্তা ও কর্মদ্বারা কতটা প্রভাবিত ছিল। বইটি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। মুসলমান সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিদ্যাসাগর বঙ্কিমচন্দ্র রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে চিনতে শেখাবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ