পলিসিতে ভুল হলে ব্রডব্যান্ড সেবার ব্যবসায় অনেক উদ্যোক্তা হারিয়ে যাবে
ইমদাদুল হক। বর্তমানে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ (আইএসপিএবি)-এর সভাপতি। তিনি দেশের অন্যতম প্রধান ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান অপটিম্যাক্সের কর্ণধার। তিনি প্রায় দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবার ব্যবসায় যুক্ত আছেন। আইএসপিএবির যাত্রার শুরু থেকেই এই সংগঠনের নেতৃত্বের ভূমিকায় আছেন তিনি। এর আগে দুই দফায় আইএসপিএবির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। সম্প্রতি তিনি দেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা ব্যবসার নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে দেশের টেলিযোগাযোগ খাতের সার্বিক ব্যবসা এবং নীতিকাঠামো প্রসঙ্গও। তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: জোবায়ের মাহমুদ
ভিউজ বাংলাদেশ: ব্রডব্যান্ড সেবার ওপর ভ্যাট, ট্যাক্স আছে। এখন আইএসপিদের ওপর সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের জন্যও চার্জ আরোপের কথা বলা হচ্ছে। আপনার মূল্যায়ন কী?
ইমদাদুল হক: আমাদের লেয়ার চারটি। একদম সাবমেরিন বা আইটিসি থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি আরম্ভ করে ইউজার পর্যন্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাদের ৪টি লেয়ার অতিক্রম করতে হয়। প্রথম লেয়ার হলো সাবমেরিন এবং আইটিসি। সেখানে সরকার ভ্যাট, ট্যাক্স, রেভিনিউ শেয়ারিং ও এসওএফ ফান্ড পাচ্ছে। পরবর্তী লেয়ার আইআইজি। প্রতিটি পর্যায়ে আবার ট্রান্সমিশন লাগে যে সার্ভিস দেয় এনটিটিএন কোম্পাানিগুলো। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সরকার ভ্যাট, ট্যাক্স, রেভিনিউ শেয়ারিং ১০ শতাংশ এবং শতাংশ এসওএফ পাচ্ছে। এরপরের ধাপ আইএসপি। সেখানে সরকার ভ্যাট ট্যাক্স পাচ্ছে। এখন আবার সরকার এসওএফ আরোপ করতে চাচ্ছে আইএসপির ওপরে।
ভিউজ বাংলাদেশ: এসওএফ আরোপ করা কি আপনাদের জন্য সমস্যাজনক মনে করছেন?
ইমদাদুল হক: বিগত সরকারের শেষ সময়ে এসে এক প্রকার জোর করেই এসওএফ চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা হয়েছিল। আইএসপিএবি সেটা মানেনি। বিটিআরসি এর সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা চলছে। আমরা যেহেতু প্রান্তিক পর্যায়ে সেবা দেই। একেবারে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণের কাছাকাছি আমরা যাচ্ছি। আমাদের আয়ের পরিমাণও বেশি নয়। এ কারণে আমাদের ওপর যাতে এই এসওএফ টা আরোপ করা না হয়, সেটাই চাচ্ছি।
ভিউজ বাংলাদেশ: সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিলের অর্থ ব্যয় নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ইমদাদুল হক: এসওএফকে যেটা বলা হচ্ছে যে সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল দরিদ্র লোকদের জন্য কাজ করা, যেসব এলাকায় ইন্টারনেট পৌঁছায়নি, সেসব এলাকার জন্য কাজ করা। আমি মনে করি, এখন পর্যন্ত এসওএফ ফান্ডের যত টাকা খরচ হয়েছে, যেসব প্রকল্পে হয়েছে, তার কোনো টাকাই সঠিক পথে খরচ হয়নি। এর আগে এসওএফ নিয়ে যে কমিটি করা হয়েছিল। সে কমিটির আমিও একজন সদস্য ছিলাম। যদিও আমি কোনো অথরিটি ছিলাম না। সদস্য হিসেবে আমার সেখানে নেগেটিভ ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ডিনাই করার কোনো সুযোগ ছিল না।
ভিউজ বাংলাদেশ: বর্তমানে যে রেভিনিউ শেয়ারিং আছে, সেটা নিয়ে কি আপনারা সন্তুষ্ট?
ইমদাদুল হক: রেভিনিউ শেয়ারিং নিয়ে কিছু সমস্যা আছে। এটা নতুন করে পর্যালোচনা করা উচিত। আমি যেহেতু আইআইজির ব্যবসা সম্পর্কে জানি, আমি আপনাকে বলছি যে, বর্তমানে ৩৬৫ টাকা করে দাম ধরা আছে যে আইআইজি ব্যান্ডউইথ বিক্রি করবে আইএসপির কাছে; কিন্তু মার্কেট কম্পিটিশনের কারণে সেটা কমে একেবারে কমে চলে আসছে ২০০-২৫০ টাকায়। এই দামে বিক্রি করে ৩৬৫ টাকায় রেভিনিউ শেয়ার করতে গেলে হয় সেল কম দেখাইতে হবে। অথবা পকেট থেকে টাকা দিতে হবে। এই জায়গায় আমার মনে হয় বিটিআরসির উচিত মার্কেট সার্ভে করে যেই দাম আছে সেই অনুযায়ী রেভিনিউ শেয়ারিংটা নির্ধারণ করা উচিত। তাহলে মাঝখানে যে গ্যাপ এটা হবে না। এই গ্যাপের কারণে ছোট আইআইজির অস্তিত্ব হুমকির মুখে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ২-৪ টা আইআইজি ছাড়া কেউ টিকতে পারবে না। হয় অস্তিত্ব বিলীন হবে, নাহলে তাদের রেভিনিউ শেয়ারিং কম দেখাতে হবে। কারণ তারা আসলেই ব্যবসা করতে পারছে না। মার্কেট ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলেছে। এই জায়গায় কাজ করতে হবে বিটিআরসির।
ভিউজ বাংলাদেশ: আইআইজির মতো ছোট ছোট অনেক আইএসপিও তো আছে। এসব আইএসপি কি অবস্থায় আছে?
ইমদাদুল হক: সবকিছু নির্ভর করছে সরকারের পলিসির ওপর। সরকারের পলিসি যদি সঠিক হয়, তাহলে সমস্যা নেই। পলিসি ভুল হলে ছোট উদ্যোক্তারা হারিয়ে যাবে। অনেক নতুন উদ্যোক্তা যারা আইএসপি ব্যবসার জন্য বিনিয়োগ করেছেন, তারা পুঁজি হারাবে। আর নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হবে না। আইএসপি ইন্ডাস্ট্রিতে যে নতুন উদ্যোক্তা, প্রচুর মানুষের কর্মসংস্থান হওয়ার যে সুযোগ আছে সে জায়গায় একটা ভাটা পড়ে যাবে। যদি পলিসিগত কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। পলিসি ঠিক হলেই দেখা যাবে মার্কেটটা একটা ব্যালেন্সের মধ্যে থাকবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: ২০২১ সালের ৬ জুন ‘এক দেশ এক রেট’ ঘোষণা করা হয়। দাম বেঁধে দেয়ায় বাজার পরিস্থিতিতে কি ধরনের প্রভাব পড়েছে?
ইমদাদুল হক: প্রায় ৩ হাজার আইএসপি একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে মূল্য নির্ধারণ করে। সেখানে বেঁধে দেয়া মূল্য আমার মনে হয় ঠিক হবে না। কোনো জায়গায় তো আছে ৩০০ টাকায় ব্রডব্যান্ড সেবা দেয়া হয়। সে জায়গায় হয়তো খুব সামান্য ব্যবহার হয়। ইউজার বুঝে কোয়ালিটি নির্ধারণ করা হয়। কোনো জায়গায় হয়তো ৭০০ থেকে ৫০০০ টাকায় আবার করপোরেট প্যাকেজ সেটা ৫০ হাজার ১ লাখ টাকারও হয়। কে কেমন সেবা নিবে সেটা নির্ধারণ করা হয় কাস্টমার এবং অপারেটর বসে ঠিক করে আপনার কি কি সেবা দরকার এবং কি পরিমাণ ব্যান্ডউইথ দরকার হবে। আমার মনে হয় এ জায়গায় একটা ফ্লেক্সিবিলিটি থাকা উচিত। এটা নির্ধারণ করে দাম বেঁধে দেয়ার বিষয়টি প্রকৃত অর্থে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি।
এ জায়গায় প্রশ্ন আসতে পারে মোবাইল অপারেটরদের ভয়েস কলের দাম তো বিটিআরসি থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে মোবাইল অপারেটর আছে মাত্র চারটি। চারটির দাম সরকার নির্ধারণ করে দিতেই পারে। কারণ ইচ্ছা করলে চারটির মধ্যে তিন অপারেটরের একজোট হয়ে মনোপলি করার সুযোগ আছে; কিন্তু আইএসপির সংখ্যা ৩ হাজার। আইএসপিরা চাইলেও মনোপলি করতে পারবে না। তারা একে অপরের সঙ্গে প্রতিযোগিতে করে সর্বনিম্ন প্রফিট রেখেই ব্যান্ডউইথটা ছেড়ে দেয়।
ভিউজ বাংলাদেশ: ব্রডব্যান্ড এর মূল্য যদি সরকার ৫০০ টাকা থেকে নামিয়ে ৪০০ টাকা করে। সেক্ষেত্রে অপারেটররা কি সমস্যায় পড়বে বলে আপনি মনে করেন?
ইমদাদুল হক: দাম আরও কমালে কোয়ালিটি সম্পন্ন সেবা দেয়া কঠিন হবে। তারা বিপাকে পড়ে যাবে। কারন ১০০ টাকা কিন্তু কোনো প্যাকেজে প্রফিট হয় না। তখন হয়তো অপারেটর কে ব্যান্ডউইথে কম্প্রোমাইজ করতে হবে। অথবা অন্য কোনো জায়গায় কম্প্রোমাইজ করতে হবে। কোয়ালিটি সেবাটা গ্রাহকরা পাবে না। এই যে এখন ৫০০ টাকা এটা কভিডের পরপর নির্ধারণ করা হয়েছিল। তখন আমরা বলেছিলাম ৫০০ টাকা নির্ধারণ করলে আমাদের জন্য কঠিন হয়ে যাবে। আপনি ভারতে দেখেন। সেখানেও সর্বনিম্ন দাম কিন্তু বাংলাদেশি টাকায় ৬০০ টাকা। এখন বাংলাদেশে এটা কমানো হলে অনেক অপারেটর ঝরে যাবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কি মনে করেন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবসায় ছোট-বড় সব অপারেটরের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আছে?
ইমদাদুল হক: আমাদের মার্কেটে আসলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডটা নেই। এর অনেক কারণ আছে। এর মধ্যে যেমন আমি প্রথমে বলব কোনো কোনো অপারেটর তার সব লেভেলের লাইসেন্স আছে। অর্থাৎ ৪টি লেয়ারেরই লাইসেন্স আছে। কোনো কোনো অপারেটর এর ১-২টি আবার কারও শুধু ১টি লেয়ারের লাইসেন্স আছে। এখন যার ১ লেয়ারের লাইসেন্স আছে সে ৪ লেয়ারের লাইসেন্সপ্রাপ্ত এর সঙ্গে কীভাবে প্রতিযোগিতা করবে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মোবাইল অপারেটররা ১ এমবিপিএস ব্যান্ডউইথ কিনে ১৭০-৮০ টাকায়। আর আমাদের এখনো বিটিআরসির প্রাইজ ৩৬৫ টাকা। তাহলে আমরা এখানে যারা ব্রডব্যান্ড ব্যবসা করি। তাদের ওপর আসলে অবিচার করা হচ্ছে। আমাদের জন্য দামটা হাইড করে রাখা হয়েছে; কিন্তু যারা মোবাইল অপারেটর তাদের জন্য দামটা ফিক্সড না। তারা ইচ্ছা করলে ১৭০-৮০ টাকার কমে নিতে পারবে। আইআইজিরা কমে বিক্রি করতে পারবে তাদের কাছে।
আমার মনে হয় না এখানে পার্থক্য থাকা উচিত মোবাইল অপারেটর ও ব্রডব্যান্ড অপারেটরদের মধ্যে। হয়তো বলতে পারে কারও কম কারও বেশি ব্যান্ডউইথ লাগে। যার ব্যান্ডউইথ বেশি লাগে, সে হয়তো সুবিধা একটু বেশিই পায়; কিন্তু সুবিধাটা এত বেশি ছোট বা মাঝারি পর্যায়ের, যারা অপারেটর তারা তার সঙ্গে কোনোভাবেই প্রতিযোগিতায় পারবে না। সেখানে দামের যে পার্থক্য এটা কমায় নিয়ে আসা উচিত। একেবারে সামান্য পার্থক্য থাকা উচিত। কারণ সরকারের তো সাবমেরিন কেবল। যার যতটুকু ব্যান্ডউইথ লাগবে। সেটা বেশি হোক বা কম। সে কিন্তু নিবেই। তাহলে এখানে সরকার অপারেটরদের প্রতিযোগিতায় ফেলে দেখ না। কেন কাউকে সুবিধা বেশি দেয়া হচ্ছে। এখানে প্রতিযোগিতা করে ছোটরা বড় হোক। বড়রা যদি টিকতে না পারে। তারা ছোট হয়ে যাবে। প্রতিযোগিতা থাকলে সাধারণ জনগণ ভালো সেবাটা পাবে। প্রতিযোগিতামূলক একটা বাজার তৈরি হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনি কি মনে করেন, দামের দিকে নজর না দিয়ে সরকারের এখন ইন্টারনেটের মানের দিকে নজর দেয়া উচিত?
ইমদাদুল হক: আমি মনে করি সেবার মানের দিকে যাতে এখন নজর দেয়া হয়। দাম নির্ধারণ করবে মার্কেট। আমাদের এখানে একটি ব্যারিয়ার দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ জায়গা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আইপিটিভি, ট্রিপল প্লে আমরা দিতে পারছি না। এই সেবাগুলো যাতে আমরা দিতে পারি। সেদিকে নজর দেয়া উচিত। এখানে যদি আমরা দাম বেঁধে দিতে যাই। সেটা আসলে সরকারের উচিত হবে না। আমরা চাই এখানে যাতে সরকার দৃষ্টি দেয়। আমি মনে করি, সরকার যে কোনো সিদ্ধান্তই নেক না কেন, ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বসা উচিত। ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে বসে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে সত্যিকার অর্থে যে কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে। যেহেতু এখন একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তাদের সুযোগ আছে ভালো কিছু পলিসি তৈরি করার। কারণ যখন কোনো রাজনৈতিক সরকার আসে। তখন একটা বিশেষ গোষ্ঠী তাদের পাশাপাশি চলে আসে। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থেই অনেক কিছু করে ফেলে। তখন আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের আসলে কিছু করার থাকে না। এখন এ সরকার চাইলে ভালো কিছু পলিসি তৈরি করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। যেহেতু তারা কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের না। এক্ষেত্রে যদি তারা অ্যাসোসিয়েশনের সহায়তা চায়। অবশ্যই অ্যাসোসিয়েশন সরকারের পাশে থাকবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে