মরুর দেশে বন্যা, বঙ্গে তাপপ্রবাহ সঙ্গে কুয়াশা
মরুভূমির দেশ ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যের এই দেশ দুটিতে বৃষ্টি হয় না বললেই চলে। আর সেই দুই দেশই কি না এবার দেখল রেকর্ড বৃষ্টিপাত ও ভয়াবহ বন্যা। গত মঙ্গলবার দুদেশের রাস্তা-ঘাট থেকে শুরু করে বিমানবন্দর সবই ছিল পানিতে টইটুম্বুর। বিশ্বের অন্যতম ধনী দেশ দুটির বিভিন্ন শহরে কোমর পানির স্রোতে ভাসছিল দামি দামি গাড়ি। সংযুক্ত আরব আমিরাত আবহাওয়া দপ্তর বলছে, গত ৭৫ বছরে এত পরিমাণ বৃষ্টিপাত হয়নি। এখন কথা হচ্ছে মরুর এই দুদেশে হঠাৎ কেন এমন বৃষ্টি। এর জন্য কিছু বিশষজ্ঞরা ‘ক্লাউড সিডিং’কে দায়ী করলেও অনেকে আবার এর জন্য লা নিনাকে দায়ী করেছেন।
অন্যদিকে দক্ষিণ এশিয়া বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে এখন একদিকে চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ ও অন্যদিকে এই অঞ্চলের অনেক জেলায়ই গত কয়েক দিনে ভোরে পড়ছে ঘন কুয়াশা। আবহাওয়ার এই বিরূপ আচরণের জন্য অনেকে এল নিনোর প্রভাবকে দায়ী করেছেন। তবে মধ্যপ্রাচ্য ও বঙ্গের আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক আচরণের জন্য বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যে দায়ী এ বিষয়ে কোনো সংশয় নেই বিশেষজ্ঞদের।
ক্লাউড সিডিং, এল নিনো ও লা নিনা আসলে কী?
আকাশে ভেসে থাকা বৃষ্টির অনুপযোগী মেঘগুলো বৃষ্টি হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ার জন্য পর্যাপ্ত ঘনীভবন প্রয়োজন হয়। স্বাভাবিকভাবে বৃষ্টি না হলে ড্রাই আইস অথবা সিলভার আয়োডাইড ব্যবহার করে মেঘের ঘনীভবন ঘটানো যায়। ড্রাই আইসের তাপমাত্রা মাইনাস ৭৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়ে থাকে। ভেসে থাকা মেঘের ওপর এই ড্রাই আইসের গুঁড়া ছড়িয়ে দিলে সেটা ঘনীভূত হয়ে বৃষ্টি হয়ে মাটিতে পড়ে। এই প্রক্রিয়াকেই ক্লাউড সিডিং বলা হয়।
এল নিনো মানে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এই স্রোতের ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। এ সময় দক্ষিণ গোলার্ধের পুবালী বায়ুর প্রবাহ বদলে যায়। পুবালী বায়ু সাধারণত পেরু থেকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে বয়ে যায়। এল নিনো পরিস্থিতিতে এই বায়ুপ্রবাহ কমে যায়, থেমে যায় অথবা উল্টে যায় এর দিক। বায়ু তখন পুব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। ফলে যে সমুদ্রস্রোত উষ্ণ পানিকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে বয়ে নেয়ার কথা, তার দিকও উল্টে যায়। সমুদ্রস্রোতের টানে উষ্ণ পানি বয়ে যায় পেরু, অর্থাৎ দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিকে। এই পানি আসে অস্ট্রেলিয়া উপকূল থেকে। ফলে অস্ট্রেলিয়া উপকূলে পানি নেমে যায়। আর বেড়ে যায় পেরু উপকূলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ও উচ্চতা। এসব পরিবর্তনের কারণে পেরুতে বায়ুর উর্ধ্বমুখী পরিচলন ঘটে। ফ্লুয়িড বা প্রবাহীর অবস্থানান্তর ঘটতে পারে তিনভাবে। পরিবহন, পরিচলন ও বিকীরণ। পানির মতো বাতাসও এক ধরনের প্রবাহী। আর বাতাসের উর্ধ্বমুখী পরিচলন হলে, তা সঙ্গে করে সামুদ্রিক পানি নিয়ে যায়। পৌঁছে দেয় বায়ুমণ্ডলে। এই পানি বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপে ঘন হয়, ফলে তাপমাত্রাও কমে। একসময় ঝরে বৃষ্টি হয়ে। অর্থাৎ যে বৃষ্টি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়ার কথা, তা হয় পেরুতে।
বাংলাদেশ, ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার বিষয়টা কী? পুবালী বায়ু যখন পুবে না বয়ে পশ্চিমে বয়ে যায়, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার- এই পুরো অঞ্চলটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। কারণ, বাতাসের প্রবাহ সমুদ্রস্রোতকে বয়ে নিতে থাকে পশ্চিম দিকে। ফলে পশ্চিমের দিকে বৃষ্টি বাড়ে। আর বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত- এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শুকিয়ে যায় মাটি। এমনকি খরাও দেখা দিতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো ঠিক জানেন না, এল নিনো কখন বা কেন হয়। আমরা জানি, বায়ুপ্রবাহের দিক বদলে যাওয়ার ফলে এমনটা হয়; কিন্তু কেন এই বদলে যাওয়া, তা জানা যায়নি। তা ছাড়া প্রতিটি এল নিনো পরিস্থিতি ভিন্ন হয়। এর প্রতি বায়ুমণ্ডলের প্রতিক্রিয়াও তাই ভিন্ন হয় প্রতিবার। প্রত্যেকবার এরকম ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় এবং সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়ম না থাকায়, এল নিনোর পেছনের কারণ এখনো পুরোপুরি বুঝতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। সাধারণত ৪ থেকে ৭ বছর পরপর এই পরিস্থিতি দেখা দেয়। স্থায়ী হয় ১২ থেকে ১৮ মাসের মতো; কিন্তু বর্তমানে এটি আরও ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে।
এল নিনোর উল্টো ঘটনার নাম লা নিনা। যেসব বছর এই লা নিনা থাকে, সেসব বছর প্রশান্ত মহাসাগরের সাধারণ অবস্থা আরও তীব্র হয় পুবালী বায়ুপ্রবাহের জন্য। লা নিনার সময়ে পুবালী বায়ুপ্রবাহের গতি বেড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় বায়ুর উর্ধ্বমুখী পরিচলনের ফলে ভারি বৃষ্টি হয়। এর ছোঁয়া লাগে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ আশপাশের অঞ্চলেও। ভারি বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি এ সময় বন্যাও হতে দেখা যায়। এই প্রবণতা এখন দক্ষিণ এশিয়া ছাড়িয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে।
মরুর দেশ ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে হঠাৎ কেন এত বৃষ্টি
সংযুক্ত আরব আমিরাতে চলতি সপ্তাহে যে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়েছে, এর মূল কারণ হিসেবে অনেকে দায়ী করেছেন ক্লাউড সিডিংকে। পানির নিরাপত্তা সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০২ সাল থেকে অর্থাৎ গত প্রায় ২২ বছর ধরে এই ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে দেশটির সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবহাওয়া বিভাগ ন্যাশনাল সেন্টার অব মেটিওরোলজি বৃষ্টি নামানোর লক্ষ্যে গত সোমবার ও মঙ্গলবার (১৫ ও ১৬ এপ্রিল) আল আইন বিমানবন্দর থেকে ক্লাউড সিডিং বিমান প্রেরণ করে। ফলে এই দুদিন ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতের মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর জীবন যখন তাপপ্রবাহের কারণে ওষ্ঠাগত তখন এই বৃষ্টিপাতকে আল্লাহর ‘আশীর্বাদের বৃষ্টি’ বলে অভিহিত করে দেশটির কর্তৃপক্ষ; কিন্তু বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হওয়ায় তাতে ব্যাপক বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এতে চরম বিতর্ক ও সমালোচনার মুখে পড়েছে দেশটির সরকার। সংযুক্ত আরব আমিরাতে গত মঙ্গলবার ২৪ ঘণ্টার কম সময়ের মধ্যে দেশটির আল-আইন অঞ্চলের খাতম আল-শাকলায় ২৫৪ দশমিক ৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যেখানে দেশটিতে বছরে গড়ে ১৪০ থেকে ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। আর দুবাইয়ে সাধারণত মাত্র ৯৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। এপ্রিলের মাসিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাত্র ৮ মিলিমিটার।
এদিকে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে প্রতিবেশী দেশ ওমানেও প্রবল বর্ষণ হয়েছে। দেখা দিয়েছে প্রচণ্ড বন্যা। যার ফলে দেশটিতে কমপক্ষে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশটিতেও সম্প্রতি ক্লাউড সিডিং প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল। জানা গেছে গত মঙ্গল ও বুধবার ওমান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের বাহরাইন, কাতার ও সৌদি আরবেও বৃষ্টি হয়েছে।
তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন লা নিনার প্রভাবে মরুর দেশেও অসময়ে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। তদের মতে গত প্রায় ২২ বছর ধরে ক্লাউড সিডিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে ওমান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ মধ্য প্রাচ্যের বেশ কিছু দেশ। তাহলে এবার কেন এতো বৃষ্টি ও প্রবল বন্যা? এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট লা নিনার প্রভাবে মধ্যপ্রাচ্যে বায়ুর উর্ধ্বমুখী পরিচলনের ফলে সেখানে অস্বাভাবিক অতি ঘণ মেঘমালার সৃষ্টি হয়েছে। তা ক্লাউড সিডিংয়ের মাধ্যমে জোর করে নামাতে গিয়ে ভারী বৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে বন্যারও সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। অর্থাৎ সেখানে লা নিনার প্রভাবে অস্বাভাবিক অতি ঘণ মেঘমালার সৃষ্টি না হলে শুধু ক্লাউড সিডিংয়ের কারণে এমন বৃষ্টি হতো না।
বঙ্গে কেন একসঙ্গে তাপপ্রবাহ ও ঘন কুয়াশা?
এল নিনোর প্রভাবে এখন পুবালী বায়ুর পুবে না বয়ে পশ্চিমে বয়ে যাচ্ছে। তাই এখন বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার- এই পুরো অঞ্চলটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে গেছে। কারণ, বাতাসের প্রবাহ সমুদ্রস্রোতকে বয়ে নিচ্ছে পশ্চিম দিকে। ফলে পশ্চিমের দিকে বৃষ্টি বেড়েছে। যা মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত চলে গেছে। আর পূর্ব দিকে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত- এসব অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বৃষ্টির অভাব। বেড়ে গেছে তাপমাত্রা। শুকিয়ে যাচ্ছে মাটি। দেখা দিয়েছে খরা। অন্যদিকে, এল নিনোর প্রভাবে এই গ্রীষ্মেও বঙ্গে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ এত বেড়ে গেছে যে, দিনে তাপপ্রবাহ থাকলেও শেষ রাতে থেকে ভোর পর্যন্ত এই এলাকার বেশ কিছু জেলায় ঘন কুয়াশা পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া, বর্ধমান, হাওড়া, কলকাতা, কোচবিহার, দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা এবং বাংলাদেশের পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুষ্টিয়া ও চুয়াডাঙ্গা জেলা।
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ হিসেবে পরিচিত হলেও বিগত কয়েক বছরে তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতি ম্লান করে দিয়েছে। বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৯৬০ সালে বঙ্গীয় এলাকায় সর্বোচ্চ ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়। স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ৩০ মে রাজশাহীতে তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয় ৪৬ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ১৯৯৫ সালের এসে নথিভুক্ত করা হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের ২৬ এপ্রিল যশোরে রেকর্ড করা হয় বিগত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই পরিসংখ্যানে আপাতদৃষ্টিতে যদিও মনে হচ্ছে তাপমাত্রা কমছে, তবে অতীতের সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা ছিল কম, অথচ বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই গড় তাপমাত্রা ১৯৭২ সালের থেকে ২০২৪ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট এল নিনোই এর জন্য দায়ী বলে এখন অনেকটাই স্পষ্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে