এক বছরে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা
শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে নজর দিন
শিক্ষাজীবন অসম্ভব এক আনন্দের সময়। প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন রহস্যের দরজা উন্মোচন হয় এ সময়। দলবেঁধে স্কুলে যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে গল্প, খেলাধুলা, শিক্ষকদের আদর-ভালোবাসা সব মিলিয়ে শিক্ষাজীবনটি সত্যিই অন্যরকম। পরবর্তী সারাজীবন ধরেই এ সময়টি মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। বয়স যত বাড়ে মানুষের ততই আফসোস হয়, আহারে, সেই দিনগুলো যদি আবার ফিরে পাওয়া যেত! পরীক্ষার একটা আতঙ্ক অনেক সময় ভর করে অনেকের মনে, পরবর্তী জীবনে অনেকে পরীক্ষা নিয়ে দুঃস্বপ্নও দেখে; কিন্তু শিক্ষাজীবনের অনাবিল আনন্দের তুলনায় তা সামান্য; একটু সচেতন হলে, নিয়মিত পড়াশোনা করলে সহজেই সেই আতঙ্ক কাটিয়ে ওঠা যায়। আতঙ্ককে পরিণত করা যায় আনন্দে।
শিক্ষাজীবনের সবচেয়ে বড় আনন্দ অপরিসীম কৌতূহল মেটানো। প্রতিটি ক্লাসে একজন শিক্ষার্থী কত যে নতুন নতুন বিষয় জানতে পারে। প্রতিদিন তারা একটু একটু করে বড় হয় আর নতুন নতুন জ্ঞান আহরণ করে। প্রতি বছর শুধু তারা ক্লাসই পাল্টায় না, একেকটি বছরে তাদের জীবনও বদলে যায় অনেকখানি। প্রতি বছর তারা নতুন মানুষ হয়ে ওঠে। শিক্ষাজীবন তাই পরবর্তী চলার পথের ভিত্তি। তারপর মানুষ যতই সফল হোক, যতই ব্যর্থ হোক, ঘুরে ঘুরে তার কেবল মনে পড়ে শিক্ষাজীবনের কথা। অনেকে ভাবে, আবার সেই দিনগুলো ফিরে পাওয়া গেলে নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলা যেত।
কিন্তু আমাদের দেশে, বিশেষত বর্তমান সময়ে, শিক্ষাজীবন সারাক্ষণই মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম। অনেক স্কুলে খেলার মাঠ নেই, বন্ধুদের সাহচর্য নেই, শিক্ষকদের স্নেহ নেই; আছে কেবল পড়া, পড়া আর পড়া- পরীক্ষা, পরীক্ষা আর পরীক্ষা। এত পড়েও যে তারা কিছু শিখে তাও নয়। পরীক্ষায় পাস করে ভালো ফলাফল নিয়ে- এ প্লাসের ছড়াছড়ি- কিন্তু শিক্ষার যে প্রকৃত উদ্দেশ্য- সেটাই অনুপস্থিত; জ্ঞানাহরণ নেই; কোনো জানাবোঝা নেই; আছে শুধু পাস আর পাস; সাফল্য অর্জনের ইঁদুর দৌড়!
ফলে দিন দিন আমাদের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এক জরিপের ফলাফল এসেছে আঁতকে ওঠার মতো- গেল এক বছরে সারা দেশের স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ৩১০ জন শিক্ষার্থীর আত্মহননের চিত্র উঠে এসেছে এক সমীক্ষায়। সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আঁচল ফাউন্ডেশনের এ সমীক্ষা বলছে, সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যা করেছে মেয়ে শিক্ষার্থীরা, এ হার ৬১ শতাংশ। আর শিক্ষার স্তর অনুযায়ী আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি ছিল মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে, ৪৬ দশমিক ১ শতাংশ।
এক সংবাদ সম্মেলনে ২০২৪ সালের আত্মহননের এই চিত্র তুলে ধরেছে সংগঠনটি। ২০২৩ সালে ৫১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে, ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ৫৩২। সে তুলনায় গেল বছর আত্মহননের ঘটনা কম ঘটার তথ্য পাওয়া গেছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে আত্মহত্যা সম্পর্কিত রিপোর্ট মিডিয়াতে কম এসেছে বলে গবেষকরা মনে করছেন।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, অভিমান, প্রেম, পড়াশোনার চাপ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ও মানসিক অস্থিরতায় ভুগে শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করছে। অনিয়ন্ত্রিত আবেগ ও তুলনামূলক দুর্বল মানসিক স্থিতিশীলতার কারণে শিক্ষার্থীরা হতাশায় ডুবে এ পথে পা বাড়াচ্ছে। পাশাপাশি পারিবারিক চাপ, সমাজের প্রত্যাশা, কর্মজীবনের অনিশ্চয়তা ও ব্যক্তিগত সম্পর্কের জটিলতা শিক্ষার্থীর মানসিক অবস্থা বিপর্যস্ত করে তুলছে। প্রতিটি আত্মহনন শুধু একটি পরিবার বা শিক্ষাঙ্গনের জন্য শোকের কারণ হলেও এটি শিক্ষা ও মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বড় ধরনের ফাঁকফোকরকে ইঙ্গিত করে।
আঁচল ফাউন্ডেশন তাদের জরিপে শিক্ষার স্তর, লিঙ্গভেদ, বিভাগ অনুযায়ী আত্মহত্যার হার তুলে ধরেছে। এখানে অনেকগুলো বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আছে। প্রতিটি শিক্ষার স্তর, লিঙ্গভেদ ও বিভাগীয় অবস্থান নিয়ে আলাদা করে গবেষণার দরকার আছে। কিন্তু; প্রথম কথা, বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ ও প্রতিকার নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। শিশু-তরুণ-শিক্ষার্থীসহ সমাজের কোনো বয়সের মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়েই তেমন গবেষণা হয় না। মানুষের মানসিক যত্নের দিকটি আমাদের দেশে খুবই অবহেলিত। দ্বিতীয় আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আত্মহত্যা শব্দটিকে যেখানে সেখানে সহজভাবে ফলাও করাও ঠিক না। তাতেও অনেকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত হতে পারে। তৃতীয় যে বিষয়টি, এসব আত্মহননের পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ী এই সমাজ-রাষ্ট্র। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নিরাপদ, আনন্দদায়ক পরিবেশ গড়ে তুলতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের মনে প্রবল আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে পেরেছে। আর সব শিক্ষার্থীর জন্য তৈরি করেছে এক চরম অনিশ্চয়তার জীবন। লেখাপড়া শেষ করে শিক্ষার্থীরা কী করবে, কীরকম কর্মজীবনে প্রবেশ করবে এ নিয়েও আতঙ্কে ভোগে দেশের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে আঁচল ফাউন্ডেশন বেশ কিছু সুপারিশ দিয়েছে। সেগুলো হলো মানসিক স্বাস্থ্য অ্যাম্বাসাডর প্রোগ্রাম, বন্ধু সহযোগিতা গ্রুপ, লাইফ স্কিলস ওয়ার্কশপ, গেমিফিকেশন টেকনিক, ফিলিংস অ্যালার্ম সিস্টেম চালু, পারিবারিক কাউন্সেলিং প্রোগ্রাম, সৃজনশীল থেরাপি ক্লাস এবং ডিজিটাল মেন্টাল হেলথ ক্যাম্পেইন।
আমরা জানি এর বেশিরভাগই কাগজে-কলমে থাকবে; বাস্তবে কোথাও বাস্তবায়িত হবে না; হলেও শহরের দুচারটি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে; দেশের বেশিরভাগ শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, অধিকাংশ শিক্ষার্থী, বিশেষত প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা এসব সুপারিশের বাইরেই থাকবে। তাদের অনেকে আত্মহত্যা না করলেও ধুঁকে ধুঁকে মরবে; কারণ আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থাটিই ধীরে ধীরে দম বন্ধ করে মেরে ফেলার।
থ্রি-ফোরের একটি শিশুর যদি সাত-আটটা বই থাকে, বাংলা-ইংরেজি গ্রামার বই থাকে, উপরের ক্লাসে উঠতে উঠতে যদি তার ব্যাগ ক্রমাগত ভারী হতে থাকে; এমন ভারী যে শিশুরা তা বহন করতে করতে কুঁজো হয়ে যায়- এত চাপ তাহলে শিক্ষার্থীরা কীভাবে সহ্য করবে? শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ একবার বলেছিলেন, শিশুদের কাঁধে ভারী ব্যাগ দেখলে তিনি খুব অসহায়বোধ করেন।
আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন কেবল পড়া আর পরীক্ষার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এর থেকে শিক্ষার্থীদের বের করে নিয়ে আসতে ব্যাপক রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন প্রয়োজন। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে যদিও এসব নিয়ে অনেক কথা শোনা যাচ্ছে কিন্তু এখন পর্যন্ত পরিবর্তনের কোনো নজির দেখা যাচ্ছে না। যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী আমাদের দেশে বর্তমানে পাঠরত তাদের কোনোভাবেই আসলে সুষ্ঠু তত্ত্বাবধায়নে আনা সম্ভব না। প্রতিটি শ্রেণিতেই অতিরিক্ত শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীর তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা একদিকে যেমন অনেক কম, অনেক শিক্ষকও আসলে সেভাবে যোগ্য নন। অনেক পরিবার ও শিক্ষার্থীরা সুষ্ঠু পরিবেশ পায় না। দারিদ্র্যের কারণে তাদের সুষম খাদ্যের অভাব হয়, পুষ্টির অভাব হয়; সঠিক চিকিৎসা পায় না; ভালো বাসস্থান পায় না, পরিবারের অন্যদের অনিশ্চিত-অসুস্থ জীবনযাপনও তাদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। সব মিলিয়ে এটা সাদা চোখেই বোঝা যায় আমাদের শিক্ষার্থীরা ভালো নেই। কিন্তু তাদের ভালো রাখতে হবে। সেই ব্যবস্থা প্রতিটি পরিবারকেই করতে হবে। তেমনি প্রতিটি শিক্ষার্থীর মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে।
সবশেষে মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যা কোনো রোগ নয়; এটি একটি প্রবণতা; জীবন দৃষ্টি বদলালে এই প্রবণতাও বদলে যায়। এর সঙ্গে অনেক নীতিনৈতিকতাও জরুরি। আমাদের সমাজে-রাষ্ট্রে-পরিবারে নীতিজ্ঞানও বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের এটাও বোঝাতে হবে, তার ওপর যেমন তার নিজের দায়িত্ব আছে, তেমনি তার ওপর তার পরিবারের, সমাজ-রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব আছে। একটা ভুল সিদ্ধান্তে এই জীবনের ইতি টানা অত্যন্ত নির্বুদ্ধিতার লক্ষণ। মানসিক কোনো দুঃখ-কষ্ট হলে অবশ্যই বড়দের সঙ্গে খোলাখুলি কথা বলতে হবে। পাশাপাশি বড়দেরও খেয়াল রাখতে হবে শিক্ষার্থীদের মানসিক যত্নের দিকে। পরিবার ও সমাজ-রাষ্ট্রের সহযোগিতা-সহমর্মিতার ফলেই তারা ফুলের মতো বিকশিত হবে। অন্যথায় অকালে ঝরে যাবে। এই ঝরে যাওয়া ফুলের দুঃখ আমাদের সবার।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে