Views Bangladesh Logo

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার চীন সফর: কী থাকছে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায়

Manik Miazee

মানিক মিয়াজী

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে চলতি মাসের ২০ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৫ দিনের সফরে বেইজিং যাচ্ছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের চীনে এটিই প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফর।

বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ উন্নয়নের অংশীদার হচ্ছে চীন। নতুন প্রেক্ষাপট ও রাজনৈতিক বাস্তবতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের রূপরেখা নির্ধারণে এই সফরের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন কূটনীতিকরা। ফলে, এই সফরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়বস্তু নিয়ে আগ্রহ দেখা দিয়েছে সর্বস্তরে।

দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার
এই সফরের প্রাথমিক লক্ষ্য হবে বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করা, যা বাংলাদেশ-চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপনের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। আলোচনায় অর্থনৈতিক সহযোগিতা, বাণিজ্য সম্প্রসারণ, বিনিয়োগের সুযোগ এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই সফরে উভয় দেশই বাণিজ্য গতিশীলতায় পুনঃভারসাম্যের পথ অন্বেষণ করার লক্ষ্য রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে কারণ বর্তমানে বার্ষিক প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য হচ্ছে দেশটির সঙ্গে।

অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা
বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বৃদ্ধির প্রচেষ্টা গুরুত্ব পাবে এই সফরে। কৃষি, শিক্ষা, নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং অবকাঠামোর মতো ক্ষেত্রগুলোয় মনোযোগ দেয়া হবে।

রোহিঙ্গা সংকট
উভয় দেশই রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির টেকসই সমাধানের বিষয়ে আলোচনা করবে বলে আশা করা হচ্ছে, এই মানবিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহযোগিতামূলক পদ্ধতির সন্ধান করবে উভয়পক্ষই।

অবকাঠামো প্রকল্প
চলমান প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং অবকাঠামো উন্নয়নে ভবিষ্যতের সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা পাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব। এর মধ্যে রয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেইজিং সফরের সময় পূর্বে সম্মত হওয়া প্রকল্পগুলো, যেখানে ২১টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল এবং সাতটি নতুন প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছিল।

ভূরাজনৈতিক বিবেচনা
দক্ষিণ এশিয়ায় ভূরাজনৈতিক গতিশীলতার পরিবর্তনের পটভূমিতে এই সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। জুলাই-আগস্টে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত এবং চীনসহ প্রধান ক্ষমতাধর দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের জায়গা থেকেই জটিল একটি অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার ক্ষেত্রে চীনের আগ্রহ স্পষ্ট, বিশেষ করে রাজনৈতিক দৃশ্যপটের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের আলোকে। বিশ্লেষকরা পরামর্শ দিচ্ছেন যে বাংলাদেশকে সতর্কতার সঙ্গে এগিয়ে যেতে হবে, নিশ্চিত করতে হবে যে তার বৈদেশিক নীতির সিদ্ধান্তগুলো অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্কের ওপর বিরূপ প্রভাব যেন না ফেলে।

অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং সুযোগ
বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিদ্যুৎ খাতের দায়বদ্ধতাও রয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করার জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা চাইছে। একটি প্রধান বিনিয়োগকারী এবং বাণিজ্যিক অংশীদার হিসেবে চীনের ভূমিকা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই সফরে আর্থিক সহায়তা, গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ এবং বৃহৎ পরিসরে অবকাঠামো প্রকল্পে সহযোগিতার সুযোগ অন্বেষণ করা হবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এই সফরের ফলাফল আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি রূপরেখা নির্ধারণ করতে পারে। অন্যান্য বিশ্ব শক্তির সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানের জন্য অপরিহার্য হবে। এই সফরের সময় অনুষ্ঠিত আলোচনা এবং চুক্তিগুলো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং ভূরাজনৈতিক জোটের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে বলে আশা করা হচ্ছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের আসন্ন চীন সফর বাংলাদেশের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং জটিল ভূরাজনৈতিক পটভূমিতে নেভিগেট করার ওপর জোর দিয়ে, এই সফর বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের ভবিষ্যৎ গতিপথকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করার সম্ভাবনা রাখে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত অনুবিভাগের মহাপরিচালক নূরে আলম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিভিন্ন মন্ত্রণালয় এবং বিভাগের সঙ্গে আলোচনার পর, আমরা চীনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকের জন্য একটি নির্দিষ্ট এজেন্ডা নির্ধারণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

‘আমরা বেইজিংয়ে আনুষ্ঠানিক বৈঠকের সময় চীনের কাছ থেকেও পরামর্শ চাইব। তারপর, আমরা তাদের মতামতের ভিত্তিতে এজেন্ডাটি নিয়ে আলোচনা করে বিষয়বস্তু চূড়ান্ত করব। আমাদের মূল লক্ষ্য হবে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা চীনের সঙ্গে একটি এফটিএ প্রস্তাব করেছিলেন কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তা প্রত্যাখ্যান করেছে, এই আশঙ্কায় এটি বেইজিং এবং ঢাকার মধ্যে বাণিজ্য ব্যবধান আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে’, তিনি বলেন।

আলম বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে চীনা অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পগুলো কীভাবে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নেয়া যায় তা নিয়েও আলোচনা করতে চাই। আমরা আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সহায়তা করার জন্য নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরিবেশ সুরক্ষা, উৎপাদন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি এবং অন্যান্য অবকাঠামোতে বিনিয়োগ পাওয়ার চেষ্টা করছি।’

‘রোহিঙ্গা সমস্যাটি অগ্রাধিকার পাবে, কারণ আমরা এটি সমাধান করতে হিমশিম খাচ্ছি। প্রথমে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে আমরা প্রথমে চীনের কথা শুনব এবং আমাদের পারস্পরিক স্বার্থ রক্ষার জন্য পরে সেই বিষয়গুলো সমাধান করব।’

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলের সংবেদনশীল ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে, আমরা এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়ে সতর্ক রয়েছি যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মতো অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। আমরা আমাদের কূটনৈতিক ও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে চীনের কাছ থেকে পরামর্শ শুনতে আগ্রহী এবং আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমরা জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ বৃদ্ধি করার লক্ষ্য রাখি।’

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ