বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি না করে শুধু সম্মেলন করে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ অসম্ভব
সম্প্রতি রাজধানীতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল চার দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন। বিভিন্ন দেশের ৫ শতাধিক বিনিয়োগকারী এবং বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। সদ্য অনুষ্ঠিত এই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন নানা কারণে ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ নানা কারণেই বিদেশি বিনিয়োগের গন্তব্যে পরিণত হতে পারে। এখানে রয়েছে ১৮ কোটি মানুষের বিশাল বাজার। দেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশি রপ্তানিকারকদের নানা ধরনের শুল্ক সুবিধা প্রদান করে থাকে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়ার জন্যও বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে পারেন; কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশে স্থানীয় এবং বিদেশি কোনো বিনিয়োগই প্রত্যাশিত মাত্রায় হচ্ছে না। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশে বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের সামনে তুলে ধরা হয়েছে; কিন্তু এ ধরনের বিনিয়োগ সম্মেলন করে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের ক্ষেত্রে খুব একটা লাভ হয় বলে আমি মনে করি না। কারণ বিনিয়োগ একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা নানা আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে নিজ দেশে বিনিয়োগ করতে বাধ্য হন; কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগকারীরা চাইলেই যে কোনো বিনিয়োগ করতে পারেন। কোনো নির্দিষ্ট দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে তাদের কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সম্মেলনে আগত বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নীতি ও আইনি প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা দেখতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তার এমন একটি পরিবেশ কামনা করেন, যেখানে সরকার পরিবর্তিত হলেও বিনিয়োগ নীতিমালা একই থাকবে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে বাংলাদেশ ৮২ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার নিট বিনিয়োগ আহরণ করতে সমর্থ হয়েছে বলে একটি সূত্র জানায়। এটা বিগত ৪ বছরের একই সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একটি বিষয় প্রত্যক্ষ করা গেছে তাহলো, বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ প্রস্তাব নিয়ে আসেন ঠিকই কিন্তু নানা কারণে শেষ প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হয় না। তারা বিনিয়োগ প্রস্তাব প্রত্যাহার করে চলে যান। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য বেশ আগ্রহী হলেও বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা চলে যেতে বাধ্য হন। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হচ্ছেন শীতের অতিথি পাখির মতো। শীতের অতিথি পাখি যেমন কোনো জলাশয়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ খাবার এবং জীবনের নিরাপত্তা না পেলে আশ্রয় গ্রহণ করে না। তেমনি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে পর্যাপ্ত মুনাফা অর্জন এবং পুঁজি ও জীবনের নিরাপত্তা না পেলে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আগ্রহী হন না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে স্বাধীন। তারা চাইলেই এক দেশের পরিবর্তে অন্য দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন।
বাংলাদেশে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণের জন্য যেসব আইনি সুবিধা দেয়া আছে তা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই; কিন্তু বিনিয়োগের বাস্তব পরিবেশ মোটেও সন্তোষজনক নয়। সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাব রয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে সুশাসনের অভাব রয়েছে। ফলে উদ্যোক্তারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সেবা পাচ্ছেন না। অবকাঠামোগত খাতে নানা ধরনের সমস্যা রয়েছে। পণ্য পরিবহন থেকে শুরু করে কোনো ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত মাত্রায় অবকাঠামোগত সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না। সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের এক শ্রেণির কর্মকর্তা-কর্মচারী উৎকোচ ব্যতীত কোনো কাজ করতে চান না। বিদ্যমান এসব সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা না করে শুধু বিনিয়োগ সম্মেলন করলেই বিদেশি বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আহরিত হবে না। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে ঘোষণা দিতে পারেন কিন্তু ঘোষণা দেয়া আর বাস্তবে বিনিয়োগ করা এক কথা নয়। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা কোনো দেশে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে আগে অনেক কিছুই চিন্তা করেন।
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বাংলাদেশের বিনিয়োগ পরিবেশ নিয়ে যেসব তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে থাকে তা কোনোভাবেই আমাদের জন্য সুখকর নয়। বিশ্বব্যাংক তাদের সর্বশেষ ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে’ ১৯০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নির্ধারণ করেছিল ১৭৬তম। অর্থাৎ বিনিয়োগ পরিবেশের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতেই বলা যায়। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ‘ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচক’ প্রকাশ বন্ধ রয়েছে। সংস্থাটি ‘বিজনেস রেডি’ নামে নতুন একটি সূচক প্রকাশ করেছে। এতে ৫০টি দেশের বিনিয়োগ পরিবেশকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ সারিতে। বিদ্যমান বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন ঘটানো না গেলে শুধু বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন করে বিদেশি বিনিয়োগ আহরণ করা যাবে না।
স্থানীয় ও বিদেশি উভয় ধরনের বিনিয়োগের জন্য সুস্থ ধারার ব্যাংকিং সেক্টর খুবই প্রয়োজন; কিন্তু আমাদের দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থা বর্তমানে বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে রয়েছে। খেলাপি ঋণের পরিমাণ দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং সেক্টরে বিদ্যমান আইনগুলো পরিবর্তন এবং সংশোধনের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের নানা ধরনের সুবিধা দেয়া হয়েছে। আইনি পরিবর্তনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আড়াল করে রাখা হয়েছিল। এখন সেই সব লুকায়িত খেলাপি ঋণ প্রকাশ্যে চলে আসছে। ঋণ হিসাব অবলোপন নীতিমালা সহজীকরণ, ঋণ হিসাব পুনঃতপশিলীকরণ নীতিমালা সহজীকরণ, খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তনের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তা দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের অবস্থা উন্নয়নের জন্য সহায়ক বিবেচিত হয়নি।
অর্থনীতিবিদদের অনেকেই মনে করেন, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টরে মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৬ লাখ কোটি টাকার বেশি হবে। বিগত সরকার আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় যেসব ব্যাংক স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছিল তাদের বেশির ভাগই এখন ভালো চলছে না। ব্যাংকিং সেক্টর যদি উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ঋণ দিতে না পারে তাহলে দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ হবে না। অধিকাংশ ব্যাংক তারল্য সংকটে পতিত হয়েছে। তারা চাইলেও উদ্যোক্তাদের চাহিদা মতো ঋণ দিতে পারবে না। বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে প্রতি শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির জন্য ব্যক্তি খাতে অন্তত ৫ শতাংশ বিনিয়োগ হওয়া প্রয়োজন। দেশে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের হার অনেক দিন ধরেই জিডিপির ২২/২৩ শতাংশে উঠানামা করছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাকালে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৮ শতাংশ; কিন্তু তা অর্জিত হয়নি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে ২৭ শতাংশ। এটা অর্জিত হওয়ার কোনোই সম্ভাবনা নেই। যদি ব্যক্তি খাতে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ না হয় তাহলে কর্মসংস্থানের নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি হবে না। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম বিঘ্নিত হবে।
উন্নত দেশগুলোতে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণের জন্য উদ্যোক্তাগণ ব্যাংকে না গিয়ে স্টক মার্কেটের উপর নির্ভর করেন। স্টক মার্কেট থেকে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ গ্রহণ করলে নানা ধরনের সুবিধা পাওয়া যায়। স্টক মার্কেট থেকে পুঁজি আহরণ করে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলে সেই প্রকল্পটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করার পর যদি মুনাফা অর্জন করে তাহলে ডিভিডেন্ড প্রদান করে; কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের পর সুদ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রকল্পের বাস্তবায়ন বা বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক থাকে না। ব্যাংক একটি নির্দিষ্ট সময় পর সুদ সমেত কিস্তি আদায় শুরু করে। সাধারণভাবে একটি প্রকল্প নিবন্ধনের পর থেকে ৬ মাসের মধ্যে বাস্তবায়িত হওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকল্প বাস্তবায়ন বিলম্বিত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে দেড় থেকে ২ বছর লেগে যায়।
এতে উৎপাদিত পণ্যের বাজার হারানোর আশঙ্কা থাকে। বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়ার কারণে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করার আগেই প্রকল্পের উপর বিরাট অঙ্কের ঋণের দায়ভার চেপে বসে। যারা বিনিয়োগ প্রস্তাব বাস্তবায়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের দুর্নীতিমুক্ত হয়ে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য অনেকগুলো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতি এবং দীর্ঘ সূত্রিতার আশ্রয় নেয়া হয়। যারা এভাবে বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা যেতে পারে। এদের চিহ্নিত করে চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন শাস্তি প্রদান করতে হবে। আর যারা নির্মোহভাবে বিনিয়োগকারীদের সহায়তা করবেন তাদের পুরস্কৃত করার ব্যবস্থা করতে হবে। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে নীতির ধারাবাহিকতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
শুধু বিদেশি বিনিয়োগকারীরাই নন স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও নীতির ধারাবাহিকতা প্রত্যাশা করেন। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যদি বিনিয়োগ নীতিমালা পরিবর্তিত হয় অথবা অন্য কোনো কারণে ঘন ঘন নীতির পরিবর্তন ঘটে তাহলে বিনিয়োগকারীদের জন্য সমস্যা সৃষ্টি হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত নতুন শুল্ক নীতিতে চীনের উপর ২৪৫ শতাংশ শুল্কারোপ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে চীন শীর্ষস্থানে রয়েছে। ভিয়েতনাম বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এর আগে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় স্থানে ছিল। চীনের ওপর অস্বাভাবিক উচ্চ হারে শুল্কারোপের ফলে তৈরি পোশাক রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনকে সমস্যায় পড়তে হবে পারে। ছোট ছোট চীনা কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা অন্যত্র স্থানান্তরের উদ্যোগ নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ হতে পারে তাদের প্রথম পছন্দের গন্তব্য।
ড. এ বি মীর্জ্জা আজিজুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ ও সর্বশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে