অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমস্যায় কূটনৈতিক সমাধান?
জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) ঘোষণার দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ। ঠিক একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠিতে রাজনৈতিক অঙ্গনের মস্তিষ্কে ঝড় চলছে। ওই চিঠিতে বাংলাদেশের তিন বড় দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টিকে শর্তহীন সংলাপে বসার আহ্বান জানানো হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায় বলে চিঠিতে উল্লেখ রয়েছে।
কারও মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে, অবাধ, সুষ্ঠু এবং আইনসিদ্ধ নির্বাচন অনুষ্ঠান বাংলাদেশের নিজেরই বিবেচনা হওয়া উচিত। বাইরের কোনো দেশকে কেন এ কথা বলতে হবে। আমরা সবাই জানি যে, সমাজের সর্বস্তরে গণমানুষের নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিতকরণে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের আয়োজন।
আমরা দেখছি, আগামী দুমাসের মধ্যে অনুষ্ঠিতব্য দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরা বেশ তৎপর। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সহিংসতা এবং আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে চলমান অচলাবস্থায় ঢাকার বিদেশি কূটনীতিকরা বিচলিত। তারা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং বিরোধী দলগুলোকে সমাধানের পথে হাঁটতে তাগাদা দিচ্ছেন, যেহেতু ওয়াশিংটনে মার্কিন সরকারের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে বিষয়টি সফলভাবে তুলে ধরতে পেরেছে বিএনপি।
যখন যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচনে অনিয়মের বিষয়টি মাথায় রেখে এর আগে ভিসায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করেছে, ঠিক একই সময়ে এ দেশে চলমান সহিসংতায় উদ্বেগের কথা জানিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দেশটিতে বিনিয়োগ নিয়ে চীন, জাপান, রাশিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়া আরও বেশি চিন্তিত। তা ছাড়া নিজেদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বাংলাদেশে অস্থিতিশীল অবস্থা দেখতে চায় না সবচেয়ে প্রভাববিস্তারকারী ভারত।
১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মের আগে এ দেশের রাজনৈতিক বিষয়ে নিয়মিত মাথা ঘামাত যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের ইতিহাসজুড়ে দেখা যায়, এখানে মার্কিন নীতিমালা আবর্তিত হতো এবং সময়ের সঙ্গে তা নিয়ন্ত্রণমূলক পন্থার দিকে যেত।
কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ বাংলাদেশে নতুন কিছু নয়। তবে ঢাকায় বিদেশি কূটনৈতিক মহল বিশেষ করে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের তৎপরতায় দেখা গেছে, এক দল থেকে আরেক দলের কাছে তার দৌড়ঝাঁপ কেবল নিরলস কূটনীতিকের সংগ্রামই নয় বরং কূটনৈতিক পন্থায় স্থানীয় রাজনৈতিক বিতর্ক নিরসনে এক রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীর উপস্থিতিও বটে।
সম্প্রতি বাংলাদেশ এবং যুক্তরাষ্ট্র দুদেশই কূটনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থা আরও টান টান হয়েছে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার মন্ত্রিসভা এবং তাদের দলীয় সহকর্মীরা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমেরিকার হস্তক্ষেপ নিয়ে প্রকাশ্যে মন্তব্য করেছেন। চীন এবং রাশিয়া ব্লকের দিকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান ঝোঁক ইতিমধ্যে যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ককে কণ্টকাকীর্ণ করছে, তা বেশ বোঝা যায়।
বেশ কয়েকটি দেশের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরে পরিষ্কার হয় যে, এখানকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে তাদের আগ্রহ রয়েছে। বিশেষ করে তাদের আগ্রহের বিষয়বস্তু আসন্ন জাতীয় নির্বাচন। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তা, সুশীল সমাজের সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে সফর করেছেন। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব এবং চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এসেছিলেন। বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রীও মন্তব্য করেছেন, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
এসব আকস্মিক সফর ও মন্তব্যের মাঝেই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র গত ১০ নভেম্বর নয়া দিল্লিতে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছে। সংবাদমাধ্যমকে ব্রিফিংকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা বলেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করেছি। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ আলোচনায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলমান অবস্থা নিয়ে পরিষ্কারভাবে আমাদের ধারণা নিয়ে আলাপ হয়েছে।'
তবে বাংলাদেশের বিষয়ে কী ঠিক হলো? কলকাতাভিত্তিক সংবাদপত্র দ্য টেলিগ্রাফ এক শিরোনামে জানিয়েছে, ওই বিবৃতির পর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে শেখ হাসিনা সরকার। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ না করার মন্তব্য করেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রা। তার এ মন্তব্যের অর্থ হলো, অন্যরা যেভাবে এ প্রক্রিয়ায় নাক গলাচ্ছে, তারা তেমনটা করবেন না। আর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ ব্যাখ্যাই মিলেছে।
সংঘাতবিহীন নির্বাচনের একটি উপায় হিসেবে সংলাপের পক্ষে দাঁড়িয়েছে আমেরিকা। এ বিষয় বোধগম্য যে, বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সত্ত্বেও যদি অবাধ, সুষ্ঠু এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হয়, তবে যুক্তরাষ্ট্র বর্তমান সরকারের দিকে সমর্থনের হাত বাড়িয়ে দেবে। কাজেই সামনের দিনগুলোতে কেবল বাংলাদেশের নির্বাচনের ওপরই সবকিছু নির্ভর করছে না, এখানকার শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার এবং আরও অনেক বিষয়ই রয়েছে।
লেখক: প্রধান নির্বাহী, গ্লোবাল টেলিভিশন
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে