বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতিই আমাদের বিশ্বমৈত্রীর পথ
১৭ মার্চ, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী। আজ থেকে ১০৪ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন বাঙালি হলেও তিনি ছিলেন বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের নেতা। আজও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
একবার জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কিউবার কিংবদন্তি সংগ্রামী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর বৈঠক হয়েছিল। পরে ফিদেল কাস্ত্রো বলেছিলেন, ‘আমি হিমালয় পর্বত দেখিনি; কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তিনি হিমালয়ের মতো বিশাল হৃদয়ের একজন নেতা।’ বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। আগামীতেও তিনি বিশ্বব্যাপী সম্মানের সঙ্গে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন ব্যক্তিত্বকে স্বল্প পরিসরে মূল্যায়ন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু একটি জাতি সৃজন করেছেন। বাঙালিদের স্বাধীনতার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তার দেখানো পথেই হাজার বছরের পরাধীন বাঙালি শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এর চেয়ে বড় অবদান একজন মানুষ কীভাবে রাখতে পারে? বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু দীর্ঘদিন কারাভোগসহ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন; কিন্তু তিনি কখনোই নীতির প্রশ্নে, বাঙালির স্বার্থের প্রশ্নে আপোষ করেননি।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন অত্যন্ত মহৎ হৃদয়ের মানুষ। দরিদ্র মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল চোখে পড়ার মতো। স্বল্পকালীন রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনকালে তিনি অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে খুব কাছ থেকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পেয়েছি। ছাত্রজীবনেই আমি বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাস্তববাদি দূরদর্শী নেতা। তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণে যে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণে দ্বিধা করতেন না।
দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে আমার মনে হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর সমকক্ষ বা কাছাকাছি যাবার মতো কোনো বাঙালি এখনো জন্মাননি। আগামীতেও জন্মাবে কি না সন্দেহ আছে। যে কোনো বিষয়েই বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ধারণা রাখতেন। যে কোনো স্থান বা পরিবেশে তিনি তার ধারণা খুব দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করতেন। তিনি অনেকের পরামর্শ শুনতেন কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন নিজের বিবেচনা মতো। কারো দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি কখনোই ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন বলে আমার জানা নেই। আমি বিভিন্ন সময় বঙ্গবন্ধুর সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেয়েছি। তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার এবং বুঝার সুযোগ পেয়েছি; কিন্তু তা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর সামগ্রিক জীবনচিত্র তুলে ধরা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি শুধু তার পররাষ্ট্রনীতির কিছু দিক তুলে ধরার চেষ্টা করব।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফিরে এসে তিনি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব পান। সেই সময় বঙ্গবন্ধু দেশ পুনর্গঠনের ইস্যুটিকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সচেষ্ট হন। কারণ তিনি জানতেন, সদ্য স্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক সৃষ্টি করা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই।
মাত্র সাড়ে তিন বছরের শাসনকালে বাংলাদেশ বিশ্বের অধিকাংশ দেশের স্বীকৃতি আদায় করতে সক্ষম হয়। এটা সম্ভব হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর ক্যারিসমেটিক নেতৃত্বের কারণেই। বঙ্গবন্ধু বিশ্বব্যাপী ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেন। ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে থাকে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি সুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করলেন। তার পররাষ্ট্র নীতির মূল কথাই ছিল, ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়।’
এই চমৎকার পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করেই বঙ্গবন্ধু ক্ষান্ত হননি। তিনি এর সফল বাস্তবায়ন করেছেন। বাংলাদেশ এখনো বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথেই পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন ও অনুসরণ করে চলেছে। বাংলাদেশ সবার প্রতি বন্ধুত্ব রক্ষা করে চলতে চায়। কারও প্রতি শত্রুতা প্রদর্শন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি নয়। এমনকি যে সব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক খুব একটা ভালো নয়, তাদের সঙ্গেও আমরা সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আত্মসম্মান এবং নিজ স্বার্থ সমুন্নত রেখে বাংলাদেশ যে কোনো দেশের সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন করার ক্ষেত্রে আগ্রহী।
দেশের ফিরে আসার পর বঙ্গবন্ধু ভারতীয় মিত্রবাহিনীকে তিন মাসেরও কম সময়ে তাদের দেশে ফেরৎ পাঠান। ভারতীয় মিত্র বাহিনী ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ দেশে ফিরে যায়। বিশ্বের আর কোনো দেশে মিত্রবাহিনী এত স্বল্প সময়ে দেশে ফিরে যাবার কোনো নজীর নেই। বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং কূটনীতির কারণেই এটা সম্ভব হয়েছিল।
‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়’ এই পররাষ্ট্রনীতির সফল প্রয়োগ দেখিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। আমাদের নিশ্চয়ই মনে থাকার কথা, ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে অর্গনাইজেশন অব ইসলামিক কনফারেন্স (ওআইসি) এর সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। তখনো পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। এই অবস্থায় স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণে সম্মত হননি। সেই অবস্থায় পাকিস্তান ত্বরিতভাবে বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রদান করে এবং তিনটি মুসলিম দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে এসে বঙ্গবন্ধুর হাতে পাকিস্তানের দেয়া স্বীকৃতিপত্র তুলে দেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ওআইসি সম্মেলনে যোগাদান করেন।
বঙ্গবন্ধু যাতে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি সম্মেলনে যোগদান না করেন সে জন্য অভ্যন্তরীণভাবে তার ওপর প্রচন্ড চাপ ছিল। এমনকি কোনো কোনো বন্ধুরাষ্ট্র বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণ না করার পরামর্শ দিয়েছিল; কিন্তু বঙ্গবন্ধু তার সিদ্ধান্তে অটল ছিলেন। বঙ্গবন্ধু যদি পাকিস্তানে অনুষ্ঠিতব্য ওআইসি সম্মেলনে যোগদান না করতেন তাহলে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিক হতো না। পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি প্রাপ্তিও এত সহজ হতো না।
পরবর্তীতে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে নানাভাবে অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদান করেছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় অধিকাংশ মুসলিম রাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের পক্ষে। ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের সুযোগ পান। তিনি এই সুযোগ পরিপূর্ণভাবেই কাজে লাগিয়েছিলেন। ওআইসি সম্মেলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বার্থের কথা মুসলিম রাষ্ট্রপ্রধানদের সামনে তুলে ধরতে সক্ষম হন। এমন কি পাকিস্তানের নিকট বাংলাদেশের যে সম্পদ পাওনা ছিল সে ইস্যুটিও অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে তুলে ধরা সম্ভব হয়।
‘সবার প্রতি বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির এই মূল আদর্শ ওআইসি সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছিল। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের যে কিছুটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লাহোরে অনুষ্ঠিত ওআইসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের মাধ্যমে তা দূরীকরণ করা সম্ভব হয়।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল আদর্শ স্বাধীনতার পর উদ্ভাবন করা হয়নি। ১৯৭০ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় বঙ্গবন্ধু একাধিকবার বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়। কাজেই বলা যায়, তাৎক্ষণিক কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু তার পররাষ্ট্রনীতির মূল আদর্শ নির্ধারণ করেননি। এটা আগে থেকেই তিনি সুচিন্তিতভাবে নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের নিকট ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধির বিচার দাবি করেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ হবে সুইজারল্যান্ড অব দি ইস্ট। এই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাবে। ওআইসি সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শান্তির জন্য অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের উপর বিশেষ জোর দেন। এর একাধিক কারণ ছিল। প্রথমত, সেই সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি ছিল খুবই নাজুক অবস্থায়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সহায়তা প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু সেই কাজটিই করেছিলেন। এবং চমৎকারভাবে সফল হয়েছিলেন। সেই সময় অনেকেরই ধারনা ছিল যেহেতু ভারত এবং সোভিয়েত রাশিয়া বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করে তাই বাংলাদেশ হয়তো সোভিয়েত ব্লকে চলে যাবে; কিন্তু বঙ্গবন্ধু কোনো বিশেষ ব্লকের দিকে ঝুঁকে পড়েননি। তিনি দেশের সাধারণ মানুষের মঙ্গলের কথা চিন্তা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ যেসব দেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বাংলাদেশের প্রতিপক্ষে ছিল তাদের সঙ্গেও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
এ ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কখনোই আবেগ তাড়িত হননি। তিনি বাস্তবতার নিরিখে দেশ ও জনগণের স্বার্থ চিন্তা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে বাণিজ্য ক্ষেত্রে কোটা সুবিধা প্রদান করে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা সম্বলিত জেনারালাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স (জিএসপি) প্রদান করে। বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে সফলতা অর্জন করেছে তার পেছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া কোটা সুবিধা এবং ইউরাপীয় ইউনিয়নের দেয়া জিএসপি সুবিধা বিশেষ অবদান রেখেছে। বঙ্গবন্ধু যদি স্বাধীনতার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের উদ্যোগ গ্রহণ না করতেন তাহলে পরবর্তীতে তাদের নিকট থেকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে এসব সুবিধা পাওয়া সম্ভব নাও হতে পারতো।
বঙ্গবন্ধু এক সময় বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো বিশেষ জোটের অন্তর্ভুক্ত হবো না।’ তিনি আমেরিকায় গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে দেখা করলেন। মুক্তিযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আমাদের বিরোধিতা করেছে। তারপরও সেই দেশের রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বঙ্গবন্ধু দেখা করেন এবং বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা কামনা করেন।
এটা নিশ্চিতভাবেই বঙ্গবন্ধুর চরিত্রের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন অথবা স্থাপনের বেলায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু কখনোই ভুল করেন নি। রাষ্ট্রের জন্য যা প্রয়োজনীয় তা তিনি করেছেন। বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক দৃঢ়তা ছিল উল্লেখ করার মতো। তাই তিনি দেশ ও জাতির জন্য যা মঙ্গলজনক তা অবলীলায় করে ফেলতেন।
আমি যখন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলাম তখন একদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি বললেন, আপনারা এত ভোট পান কিভাবে? একটি নির্বাচনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ প্রার্থি ছিল। আমরা সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছি। আমি মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধিকে বললাম, আমরা বেশি ভোট পাই কারণ আমাদের জাতির পিতা আমাদের জন্য অনুসরণীয় একটি নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। যার মূল কথাই হচ্ছে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে আমরা ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো প্রতি শত্রুতা নয়’ নীতি অনুসরণ করবো।
এই নীতির কারণেই অন্য রাষ্ট্রগুলো আমাদের সমর্থন দেয়। আমাদের চিহ্নিত কোনো শত্রু নেই। আমরা সবার সঙ্গেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলি। আমি জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি থাকাকালে প্রায় ৫২টি নির্বাচন করেছি। এবং প্রত্যেকটি নির্বাচনে আমরা জয়লাভ করেছি। এমনকি ইসরায়েল নামক যে রাষ্ট্রটির সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই তাদের সঙ্গেও নানা ক্ষেত্রে আমরা কাজ করেছি।
এর ফলে আমরা উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করতে পেরেছি। লেবানন এড়িয়াতে আমরা নৌবাহিনী প্রেরণ করি। সেখানে আমাদের একটি ডেস্ট্রয়ার আছে। ৪৪২ জন নাবিক তাতে কর্মরত রয়েছেন। আমি জাতিসঙ্ঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের নৌ-সেনাদের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে নেবার জন্য অনুরোধ করি। তিনি বলেন, লেবাননে শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম প্রধানত ইউরোপীয়ানরা কাজ করে। এ ছাড়া ইসরায়েলের সম্মতি ছাড়া আমরা অন্য কোনো দেশের নৌ-সেনাদের সেখানে নিতে পারিনা। বাংলাদেশের সঙ্গে যেহেতু ইসরায়েলের কোনো কুটনৈতিক সম্পর্ক নেই তাই বিষয়টি ম্যানেজ করা খুবই কঠিন হবে। তবে তুমি যদি ইসরায়েলকে ম্যানেজ করতে পারো তাহলে হয়তো কাজটি করা সম্ভব হতে পারে।
জাতিসঙ্ঘে ইসরায়েলের যিনি স্থায়ী প্রতিনিধি ছিলেন, তার সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমি চিন্তা করলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থায়ী প্রতিনিধি যার সঙ্গে আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে তাকে দিয়ে ইসরায়েলের স্থানীয় প্রতিনিধিকে অনুরোধ করি; কিন্তু বিষয়টি জানাজানি হলে আমাদের দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া হতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম, মার্কিন স্থায়ী প্রতিনিধির বাসায় ইসরায়েলি স্থায়ী প্রতিনিধিকে দাওয়াত দেবো।
সেখানে কথার ফাঁকে এক সময় মার্কিন প্রতিনিধি ইসরায়েলি প্রতিনিধিকে বললেন, প্রফেসর মোমেনের একটি ইস্যু আছে। তিনি বললেন, প্রফেসর মোমেন চাচ্ছে তাদের দেশের নৌ-সেনাদের লেবানন উপকূলে শান্তিরক্ষী বাহিনীতে অন্তর্র্ভুক্ত করা হোক। তিনি বলেন, বেশ ভালো কথা। আমি আমার দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত জানাবো। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত প্রস্তাব করলেন, বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে জি-৭৭ এর পরই ইউরোপীয় ইউনিয়নের বক্তব্য প্রদানের প্রস্তাব যদি সমর্থন করে তাহলে তারা নৌবাহিনী প্রেরণের প্রস্তাব সমর্র্থন করবেন। আমি বিষয়টি নিয়ে পররাষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করি; কিন্তু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনোভাবেই সম্মতি প্রদান করলো না। আমি তখন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানালাম। তিনি সবকিছু শুনে বললেন, তুমি এগিয়ে যাও। নেত্রী ঠিক তার বাবার মতোই বাস্তববাদি এবং সাহসী। আমি আলোচনা শুরু করলাম। লেবানন উপকূলে নৌ-বাহিনীর সদস্যদের প্রেরণের ফলে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছি। বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে যে নির্দেশনা আমাদের দিয়েছিলেন তা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক সৃষ্টি ও উন্নয়নে খুবই সহায়ক হচ্ছে।
লেখক: সংসদ সদস্য, সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
অনুলিখন: এম এ খালেক
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে