শত কোটি টাকার ক্ষতি চার কলেজে, পরীক্ষা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ২৩০০ শিক্ষার্থী
শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ-ভাংচুর-লুটপাটের জেরে এক সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর রাজধানীর চারটি কলেজ ফের খুলছে আগামী রোববার (১ ডিসেম্বর)। তবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের শিকার যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইলের ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ (ডিএমআরএমসি) খুলে দেয়া নিয়ে এখনো অনিশ্চয়তায় কর্তৃপক্ষ। পুরান ঢাকায় পাশাপাশি থাকা অন্য তিনটি কলেজ হলো ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, সরকারি হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ ও কবি নজরুল সরকারি কলেজ।
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৮ নভেম্বর মারা যান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিৎ হাওলাদার। এর জেরে ২৪-২৫ নভেম্বর কলেজ চারটিতে পাল্টাপাল্টি হামলা-ভাঙচুর-লুটপাটের ঘটনা ঘটে। কলেজগুলোর শিক্ষার্থীদের পরস্পরের মধ্যেকার সংঘর্ষে জড়ান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত আরও কয়েকটিসহ অন্তত ৩৫টি কলেজের বহিরাগত শিক্ষার্থীরাও। অন্তত দুইশ’ শিক্ষার্থী-সাধারণ মানুষ আহত হওয়া ছাড়াও অন্তত ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সম্পদের ক্ষতি হয় কলেজ চারটিতে। ২৫ নভেম্বর থেকে বন্ধ রয়েছে কলেজগুলোর সব ক্লাস-পরীক্ষা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম। ব্যাহত হচ্ছে ন্যাশনাল মেডিকেলের চিকিৎসাসেবাও।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধিভূক্ত সাত কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের চলমান পরীক্ষা নিয়েও চরম অনিশ্চয়তায় পড়ে গেছেন কবি নজরুল কলেজের প্রায় ২ হাজার ৩০০ পরীক্ষার্থী। ২৪ নভেম্বর পাশের সোহরাওয়ার্দী কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা হামলা-ভাঙচুর-সংঘর্ষের মাঝে পড়েন তারা। হামলাকারীরা তাদের পরীক্ষার খাতাসহ সমস্ত কাগজপত্র ছিনিয়ে তছনছ ও ছিড়ে ফেললে পরীক্ষাই ভণ্ডুল হয়ে যায়।
কলেজটির স্টাফ আশরাফুল ইসলাম বলেন, দুপুর সাড়ে বারটায় পরীক্ষা শুরুর একঘন্টার মধ্যে হামলার ঘটনা ঘটে। এক অসুস্থ ছাত্রী অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে পরীক্ষা দিতে এসেছিলেন, সেটিও ভেঙে ফেলা হয়। কলেজ মিলনায়তন ভবনের ছাত্র-ছাত্রীরা ভয়ে পরীক্ষা ফেলেই চলে যান। আহত হন তাদেরও অনেকেই।
কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. মোতালেব হোসেন জানান, তাদের কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে আসা কবি নজরুল কলেজের প্রথম বর্ষের ওই দুই হাজার ৩০০ শিক্ষার্থীর একটি পরীক্ষা নষ্ট হয়েছে, সেটিই এখন তাদের জন্য মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় বৃহস্পতিবারের (২৮ নভেম্বর) পরীক্ষাও স্থগিত হয়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফের দুটি পরীক্ষার আয়োজন কষ্টসাধ্য হবে বলেও সতর্ক করেন এই অধ্যাপক।
সোহরাওয়ার্দী কলেজের অধ্যক্ষ ড. কাকলী মুখোপাধ্যায় জানান, সাত কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের চলমান পরীক্ষার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। সেটি নিশ্চিতে তিনি প্রায়শই মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন বা যোগাযোগ করছেন।
সংঘাতের ঘটনায় ডিএমআরএম কলেজ ২৫ নভেম্বর যাত্রাবাড়ী থানায় এবং ঢাকা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ২৬ নভেম্বর সুত্রাপুর থানায় মামলা করেছে। আর সরকারি শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী কলেজ সাধারণ ডায়েরি (জিডি) ছাড়াও সুত্রাপুর থানায় মামলা করেছে বৃহস্পতিবার।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ জানান, মোল্লা কলেজ তাদের মামলায় আট থেকে নয় হাজার অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি এবং ৫০ কোটি টাকার ক্ষতির অভিযোগ করেছে।
এখন পর্যন্ত কাউকে আটক করা যায়নি। তবে প্রযুক্তিগত এবং অন্য তদন্ত শেষে জড়িতদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে বলেও জানান ওসি।
ড. মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আশরাফ সামীর দাবি, ‘সোহরাওয়ার্দী এবং ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের ছাত্র নামধারীরা নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের মদদে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র, সম্পদ ও শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। কলেজ ভবনের ব্যাপক ক্ষতিসাধন এবং অধ্যক্ষের কার্যালয়সহ বেশকিছু কক্ষে ভাঙচুর চালিয়েছে।
‘ধ্বংসস্তুপে পরিণত হওয়া আমাদের কলেজ খুলে শিক্ষা কার্যক্রম ফের শুরুতে বেশ বেগ পেতে হবে। আমাদের সব কম্পিউটার পর্যন্ত খুলে নিয়ে গেছে। অনলাইনে নোটিশ দেয়ার অবস্থাও নেই। আপাতত শনিবার (৩০ নভেম্বর) পর্যন্ত কতোটুকু সংস্কার করা গেছে, তা খতিয়ে দেখে রোববার কলেজ খুলতে পারে। তা সংক্ষিপ্ত আকারে হবে’ বলেও উল্লেখ করেন আশরাফ সামী।
অন্যদিকে মোল্লা মাহবুব কলেজসহ অন্য দুটির সঙ্গে ইউনাইটেড কলেজেস অব বাংলাদেশ (ইউসিবি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা সাত কলেজ বাদে ঢাকার ৩৫ কলেজের ফোরাম এবং বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনকে নিজেদের মামলায় দায়ী করেছে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
কলেজটির ১০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি হাসপাতালের সহকারী পরিচালক শফিকুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে অনেক গরিব রোগী চিকিৎসাসেবা নিতে আসেন। তাদের কথা চিন্তা করেই আমরা চিকিৎসা চালিয়ে নিলেও এখনকার পরিস্থিতিতে কিছুটা ব্যাহত হচ্ছে’। রোববার কলেজে পাঠদান শুরুর কথাও জানান তিনি।
সুত্রাপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইফুল ইসলামও এ মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার বা আটকের কথা জানাননি।
সোহরাওয়ার্দী কলেজ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক মো. মোতালেব হোসেন বলেন, ‘ঘটনা ঘটলো ন্যাশনাল মেডিকেলে আর হামলার শিকার হলাম আমরা। আমাদের সবগুলো বিভাগ মিলিয়ে প্রায় ৩৫ কোটি টাকার ক্ষতি করেছে হামলাকারীরা।
রোববার তাদের কলেজও খুলে দেয়ার কথা জানান অধ্যাপক মোতালেব।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) বলছে, ঢাবি অধিভূক্ত ঢাকা কলেজ, ইডেন কলেজ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সরকারি কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি কবি নজরুল কলেজের ছাত্র–ছাত্রীদের একটি জোট রয়েছে। এই সাত কলেজ বাদে ঢাকার অন্য ৩৫টি কলেজের শিক্ষার্থীদের ফোরামের নাম ইউনাইটেড কলেজ অব বাংলাদেশ (ইউসিবি)। কয়েক দিন ধরে মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের শিক্ষার্থী অভিজিতের মৃত্যু ঘিরে কয়েকদিন ধরেই ৩৫ কলেজের ফোরাম ও সাত কলেজের জোটের শিক্ষার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা চলে আসছিল। পরিস্থিতি এমন সংঘাতময় অবস্থায় নিয়ে যাওয়ার পেছনে ফোরাম ইউসিবি’র উস্কানিকেই বেশি দায়ী করছে ডিএমপি।
সুত্রাপুর থানার ওসি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এই রিলেটেড স্ক্রিনশটের মাধ্যমে অভিযোগটির সত্যতা আমরা পেয়েছি। আমরা দেখেছি, ইউসিবি গ্রুপ থেকে ‘স্টার সানডে’ ঘোষণা দিয়ে ন্যাশনাল মেডিকেলে হামলা চালাতে ছাত্রদের একত্রিত করে নিয়ে আসা হয়েছে। পরে সোহরাওয়ার্দী-কবি নজরুল কলেজেও হামলা হয়েছে। বাধা দিতে গেলে আমাদের সাথেও তাদের সংঘর্ষ বাধে। এতে দুজন পুলিশ কন্সটেবলও আহত হন’।
‘বহিরাগত কিছু ছাত্রকে এখানে আইডি কার্ড দিয়ে সিভিল ড্রেসে নিয়েও আসা হয়েছে। এই বহিরাগতদের চিহ্নিতেরও কাজ চলছে’- জানান ওসি।
ইউনাইটেড কলেজেস অব বাংলাদেশের (ইউসিবি ) ফাউন্ডার প্যানেলের ম্যানেজিং বোর্ড সদস্য নাফিস মোল্লাকে ফোনকলে পাওয়া যায়নি। তবে ২৫ নভেম্বর দেয়া বিবৃতিতে ফোরামটি এই অভিযোগ অস্বীকার করে স্বাস্থ্য উপদেষ্টার নীরবতা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার স্পষ্ট দায়িত্বহীনতা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর নিষ্ক্রিয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
যাত্রাবাড়ী থানার ওসি ফারুক আহমেদ বলেন, ‘অভিজিৎ হাওলাদারের মৃত্যুর পর মোল্লা কলেজের দুই ছাত্রসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করে ন্যাশনাল মেডিকেল কর্তৃপক্ষ। তদন্তের স্বার্থে আইসিইউ’র তিন চিকিৎসককে বরখাস্তও করা হয়েছে। তারপরও কেন এই হামলা হলো, আমরা সেটাই বোঝার চেষ্টা করছি’।
‘দুই থানা নিজেদের অংশে সংঘটিত সংঘর্ষের তদন্ত করছে। তদন্ত গুটিয়ে এলে প্রয়োজনীয় তথ্য শেয়ার করে তারা একসঙ্গে এগোবে’ বলেও নিশ্চিত করেন তিনি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে