উদ্বোধনী সংখ্যা ৪ : সম্ভাবনার বাংলাদেশ
বিচার বিভাগকে স্বাধীন রাখার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সবার
গণতন্ত্রের পথ চলা কতটা মসৃণ হবে, তা নির্ভর করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপর। আর বিচার বিভাগের স্বাধীনতার ওপরই নির্ভর করে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ। বিশ্বের যেসব দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেসব দেশে বিচার বিভাগও স্বাধীন। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বর্তমানে তুলনামূলক স্বাধীনই বলা যায়। তবে এখনো কিছু ক্ষেত্রে ঘাটতি আছে, যা নিরসনে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এখন থেকে ১৫ বছর আগে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়েছিল। এখন বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এমন লক্ষ্য ছিল। মূলত বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য ১৯৯৪ সালে একটি রিট মামলা করেছিলেন জেলা জজ ও জুডিশিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন।
সেই মামলাটি ‘মাসদার হোসেন মামলা’ নামে পরিচিত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যার চূড়ান্ত রায় হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। রায়ের আট বছর পর ২০০৭ সালে মূল নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছিল। গত ১৬ বছরে আইন অঙ্গন ও বিচার বিভাগে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। এটা সরকারের অনেক বড় সাফল্য। বিচার বিভাগ যে স্বাধীনভাবে কাজ করছে, এটা তার বড় প্রমাণ। কোনো অভিযোগ উত্থাপিত হলে তা তদন্তে বিচারপতিদের দিয়ে কমিটি গঠন করা হলে এবং অভিযুক্ত বিচারপতিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে ব্যবস্থা নিলে কোনো পক্ষের অসন্তুষ্টি থাকবে না।
তবে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের জন্য সংসদের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় সর্বোচ্চ আদালতে রিভিউ শুনানি হবে। এই রায়ের ওপর বিচার বিভাগ কতটা স্বাধীন থাকবে সে বিষয়ে অনেক কিছু নির্ভর করে। আমি পাঁচ বছর আইনমন্ত্রী ছিলাম। আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে অনেক উদ্যোগ নিয়েছি। বিচার বিভাগ যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, এ রকম নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, যার সুফল দেশের মানুষ এখনো পাচ্ছেন।
আমি সব সময় বলেছি, এটা আমি বিশ্বাসও করি যে- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা না থাকলে সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। দেশে আইনের শাসনও প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। তবে এটাও ঠিক, এই স্বাধীনতা কেবল সরকারের একার পক্ষে নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সরকার, বিচারক এবং আইনজীবী-সবাইকে মিলে স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। সবার আগে বিচারকদের দক্ষ ও অন্যায়ের কাছে আপোষহীন হতে হবে। এটা ন্যায় বিচারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ পেতে আইনজীবীদেরও ভূমিকা আছে। একশ জন অপরাধী পার পেয়ে গেলেও একজন নিরাপরাধ যেন সাজা না হয়, এটাই বিচারের মূল স্পিরিট। একইভাবে একজন সত্যিকারের অপরাধী, যেমন স্বঘোষিত অপরাধীর পক্ষে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তাকে নিরপরাধী বানানো চেষ্টা করা যে কোনো আইনজীবীর অনৈতিক প্রচেষ্টা বলেই মনে করি। এটা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে খর্ব করে।
অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, তদন্তে অকাট্য দলিলে কেউ একজন বড় অপরাধের সঙ্গে যুক্ত আছেন বলে প্রমাণিত হয়েছে কিংবা দিনের আলোতে সবার সামনে খুনের মতো অপরাধ করেছেন; কিন্তু একজন আইনজীবী জেনে শুনেই সেই অপরাধীর পক্ষে দাঁড়াচ্ছেন। যুক্তি দিচ্ছেন, একজন চিকিৎসকের কাছে যেমন রোগীর পরিচয় শুধু অসুস্থ মানুষ, তেমনি একজন আইনজীবীর কাছেও কেউ মামলা নিয়ে আসলে সেই বিচাপ্রার্থীকে রোগীর মতোই বিবেচনা করতে হয়। এটা আসলে কুযুক্তি। একজন অসুস্থ মানুষের চিকিৎসার সঙ্গে একজন সত্যিকারের অপরাধীকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে দণ্ড থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করার তুলনা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না।
আইনজীবীদের তাদের নিজেদের বিবেক দিয়ে কাজ করতে হবে। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায়, তা প্রত্যেক আইনজীবী ভালোভাবেই বোঝেন; কিন্তু সব ক্ষেত্রে আমরা সব আইনজীবীর মধ্যে এমন হিতাহিত জ্ঞান দেখতে পাই না। তাই অবশ্যই প্রত্যেক আইনজীবীকে সততা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে আইনি লড়াই করতে হবে। আমি বিশ্বাস করি, সবার যৌথ প্রয়াসেই বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা আরও পরিণত ও উন্নত হবে। সমষ্টিগত প্রয়াস ও প্রচেষ্টাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার পূর্বশর্ত। তাই বিচারক থেকে শুরু করে বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে নিবিড়ভাবে সংযুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে।
সুবিচার ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিচারালয়ের সর্বনিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা থেকে সর্বোচ্চ পদাধিকারীর ঐক্যবদ্ধ থাকা একান্ত প্রয়োজন। বর্তমানে সাংবিধানিকভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন; কিন্তু বাস্তবে কতটুকু, তা আমরা সকলেই জানি এবং বুঝি। রাষ্ট্রের তিনটি (নির্বাহী, আইন ও বিচার) বিভাগের চৌহদ্দি সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। যেখানে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে থাকার নির্দেশনাও আছে। নিজ নিজ পরিধির মধ্যে থেকে কে কতটুকু কাজ করবে তা সংবিধানে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কেউ রেখা অতিক্রম করতে না পারে। বিচার ব্যবস্থা তার নিজস্ব গতিতেই চলে। শত চেষ্টা চালিয়েও কেউ তার গতি রোধ করতে পারবে না।
যত বাধা-বিপত্তি কিংবা ঘাত-প্রতিঘাতই আসুক না কেন, আমাদের ঐকান্তিক ও ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় বিচার বিভাগের গতি কেউ রোধ করতে পারবে না। অনেক সময় বিচার বিভাগ প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে বিচারক ও বিচার ব্যবস্থাকে এক করে ফেলা হয়। আমরা ভুলে যাই যে, বিচারকও একজন মানুষ। মনে রাখতে হবে সুবিচারের প্রতীক শ্বেতশুভ্র অট্টালিকাটির গায়ে কোনো কালিমা লাগে–এমন কিছু যেন বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট কেউ না করি। তবেই বিচার বিভাগ সত্যিকারার্থে স্বাধীন থাকবে। প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায় বিচার।
লেখক: সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে