মাতারবাড়ী, মহেশখালী থেকে ফিরে
নুনের জমিতে জেগে উঠেছে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন
এক দিকে সমুদ্র অন্যদিকে মাইলের পর মাইল জনমানবহীন লবণের ক্ষেত। বঙ্গোপসাগর থেকে উঠে আসা পানি আটকে রেখে এখানে এখনো লবণের চাষ হয়। এখান থেকে ট্রাকের পর ট্রাক অপরিশোধিত লবণ আসে ফ্যাক্টরিতে; কিন্তু এই লবণের জমিতেই গড়ে উঠছে নতুন এক বাংলাদেশ। এক দিকে গভীর সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র, স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল, বিশাল পরিসরে রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের সঙ্গে সাগর থেকে জ্বালানি তেল খালাস করার জন্য এখানে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল নির্মাণ করা হয়েছে।
জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি টোমোহাইড সম্প্রতি ‘মহেশখালী-মাতারবাড়ী সমন্বিত অবকাঠামো উন্নয়ন উদ্যোগ’ বিষয়ে এক উপস্থাপনায় বলেন, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে কেন্দ্র করে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠছে। এই অঞ্চলকে ঘিরে তিনটি ‘হাব’ বা অর্থনৈতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠার সম্ভাবনা রয়েছে। এগুলো হলো লজিস্টিক হাব, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি হাব এবং শিল্প হাব। সঙ্গত কারণে এর মধ্যে প্রতিবেশী দেশগুলোর আগ্রহ তৈরি হয়েছে। এখন বাংলাদেশ এই সুযোগ কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেটিই দেখার বিষয়।
মাতারবাড়ী ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের ৬০০ মেগাওয়াটের প্রথম ইউনিট আগেই বাণিজ্যিক উৎপাদনে এসেছে। দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ এর মধ্যে শেষ হয়েছে। এখন বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে রাষ্ট্রীয় কোম্পানি কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি (সিপিজিসিবিএল)। জাইকা বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে।
কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কালাম আজাদ জানান, এখন কখনো কখনো দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে সরবরাহ করা হচ্ছে। অন্য ইউনিট চাহিদামতো বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। তিনি বলেন, আপাতদৃষ্টিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণ ব্যয় বেশি বলে মনে হলেও এখানে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের চ্যানেল খনন করা হয়েছে। এখানে ১৮ দশমিক ৫ মিটার ড্রাফটের জাহাজ ভিড়তে পারে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এখানে গভীর সমুদ্র বন্দর নির্মাণ করলেও এখানে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির সঙ্গে মুনাফা ভাগাভাগি করবে। এ জন্য ইতোমধ্যে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কাজ শুরু করা হয়েছে। চ্যানেলটি খনন করতে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানির ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
এই চ্যনেলটি খনন করায় সরাসারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জেটিতে মাদার ভ্যাসেল এসে ভিড়তে পারছে। দেশের কোনো বন্দরের জেটিতে এত বড় মাদার ভ্যাসেল ভিড়তে পারে না। খনন করা চ্যানেলটির একপাশে কনক্রিট দিয়ে স্থায়ী রূপ দেয়া হয়েছে। তবে অন্যপাশে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্য ১০০ মিটার করে চ্যানেলটি প্রসস্ত করবে। এখন অবশ্য এসব কাজ শুরু হয়নি। ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের যাবতীয় ব্যয় নির্ধারণ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করেছে। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি সূত্র জানিয়েছে, মাতারবাড়ী বন্দরের জন্য চবক ও সিপিজিসিবিএলের যাবতীয় ব্যয় পৃথক করে পৃথকভাবে করা হবে।
বিগত জাতীয় নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন। তবে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে নির্মাণকাজ শুরু করেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। বন্দর নির্মাণ শুরু হলে সংযোগ সড়কসহ বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হবে। তবে বন্দরের জন্য জমি অধিগ্রহণ শেষ করা হয়েছে। কোথাও কোথায় সংযোগ সড়কের কাজও সীমিত পরিসরে শুরু হয়েছে।
বন্দর এবং বিদ্যুৎকেন্দ্রর বাইরেও এখানে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হবে। যেখানে বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। এই কাজও এখনো শেষ হয়নি। এর মধ্যেই মনে করা হচ্ছে মাতারবাড়ী করিডোরই বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপালসহ বঙ্গোপসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে আন্তঃযোগাযোগের কেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে। মাতারবাড়ী বাংলাদেশের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশের যোগাযোগের ক্ষেত্রে ‘গেম চেঞ্জার’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ভূরাজনীতিতেও মাতারবাড়ী গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। সরকার অবশ্য আগে থেকেই বলছে মাতারবাড়ী গড়ে উঠবে সিঙ্গাপুরের আলোকে। এখানে অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সঙ্গে আধুনিক জীবনযাবন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হবে। যা দেশি বিদেশি পর্যটককে আকৃষ্ট করবে।
সিপিজিসিবিএলের আরও একটি ১২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের আগ্রহ থাকলেও জাইকা নতুন করে কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখায়নি। এখন মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের সামনের জমিকে ল্যান্ড বেইজড এলএনজি বা স্থায়ী এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের জন্য ছেড়ে দেয়া হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির একজন প্রকৌশলী জানান।
মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্রের খুব কাছেই মহেশখালীতে নির্মাণ করা হয়েছে সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনাল (এসপিএম)। মূলত গভীর সমুদ্র থেকে সরাসারি মাদার ভ্যাসেল থেকে পাইপ লাইনের মাধ্যমে জ্বালানি তেল খালাস করার জন্য টার্মিনালটি নির্মাণ করা হয়েছে। আগে মাদার ভ্যাসেল থেকে কার্গো জাহাজে তেল আনা হতো। এরপর সেই তেল ডিপোতে এনে খালাস করা হতো।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং বয়াটি কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ-পশ্চিমে সমুদ্রের মধ্যে স্থাপন করা হয়েছে। মুরিংটি ৩৬ ইঞ্চি ব্যাসের ২টি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে মহেশখালী এলাকায় নির্মিত স্টোরেজ ট্যাংক টার্মিনালের সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে। আমদানিকৃত অপরিশোধিত তেল এবং ডিজেল পরিবহনকারী জাহাজ থেকে পাম্প করে পাইপলাইনের মাধ্যমে স্টোরেজ ট্যাংকসমূহে জমা করা হবে। পরবর্তীতে স্টোরেজ ট্যাংক হতে পাম্প করে ক্রুড অয়েল ১৮ ইঞ্চি ব্যাসের অপর ২টি পৃথক পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রামে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড এ পাঠানো হয়।
সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনালের প্রকল্প পরিচালক শরিফ হাসনাত জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্পটির টেস্টিং কমিশনিং শেষ হয়েছে। তিনি বলেন, মাতারবাড়ী বন্দর নির্মাণের জন্য সমুদ্রের অনেত গভীর দিয়ে পাইপ লাইন নির্মাণ করতে হয়েছে। বাংলাদেশে সাগরের মধ্যে দিয়ে পাইপ লাইন নির্মাণের অভিজ্ঞতা এই প্রথম বলেনও জানান তিনি।
চীনের এক্সিম ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ সিঙ্গেল পয়েন্ট মুরিং টার্মিনালটি নির্মাণ করেছে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে