ভারতের সঙ্গে কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক যুদ্ধ যে দিকে যাচ্ছে
বললে ভুল হবে না যে, ভারত ও কানাডার কূটনৈতিক সম্পর্কের ইতিহাসে এই সময়টি সবচেয়ে শীতল ও জটিল পর্যায়ে পৌঁছেছে। দুটি দেশই আয়তনে, জনসংখ্যা এবং অর্থনীতিতে বড় দেশ। ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর বসবাস কানাডায়। এমনকি কানাডায় যত বিদেশি শিক্ষার্থী লেখাপড়া করে তার ৪০ শতাংশই ভারতের। সুতরাং এই সম্পর্কের শীতলতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগোলিক দূরত্ব সত্ত্বেও দেশ দুটির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই শুরু হয়েছিল; কিন্তু খুবই ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো, এই দেশ দুটির মধ্যে প্রায় দুইশত বছর ধরে বারবার টানাপোড়েন দেখা গেছে। সে কাহিনি কখনো মিষ্টি এবং কখনো তিক্ত ও হৃদয়বিদারক।
কানাডা এবং ভারত দুটি দেশই ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত। রানি ভিক্টোরিয়ার সময় এশিয়ার চীন এবং জাপান থেকে মানুষ কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে মাইগ্রেট করতে থাকে। তারা খুবই ভালো আয় করত এবং বাড়িতে অর্থ পাঠাতো। তখন ভারতীয়রা স্বদেশ ছেড়ে বাইরে বের হতে চাইতো না। শুধু পাঞ্জাবি শিখদের দেশান্তরিত হয়ে আয় করতে কোনো আপত্তি ছিল না; কিন্তু সাহস পেত না। কারণ তৎকালীন কানাডায় প্রাচ্যের মানুষকে খাটো করে দেখার প্রবণতা ছিল। এমন পরিস্থিতিতে কানাডিয়ান প্যাসিফিক কোম্পানি এবং হাডসন বে নামে দুটি কোম্পানি (এরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো ছিল) এগিয়ে এসে জানায়, তোমাদের ভারতীয়দের চাকরির নিশ্চয়তা দেয়া হবে এবং তোমাদের খাটো করে দেখা হবে না। তাতেও অল্প কিছু শিখ সম্প্রদায়ের লোক কানাডায় স্থানান্তরিত হন।
এরপর ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া একটি কালজয়ী ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, জাতি ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ভারতীয়রাও সমান অধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। তখনই বেশিসংখ্যক ভারতীয় কানাডায় যেতে শুরু করে, বিশেষ করে শিখ সম্প্রদায়। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই হঠাৎ কানাডা সরকার একটি আদেশ জারি করে যে, ভারতীয় শ্রমিকরা আসতে পারবে, তবে সঙ্গে স্ত্রী-সন্তান আনতে পারবে না। সে সময় কানাডার সরকারের মধ্যে ভারতীয়দের প্রতি অসহযোগিতার মনোভাব দেখা দেয়। একটি হৃদয়বিদারক ঘটনা উল্লেখ করি। তখন ভারতের কানাডায় পাড়ি দেয়ার মতো নিজস্ব কোনো জাহাজ ছিল না। ১৯১৪ সালে কোমাগাতা মারু নামক একটি জাপানি জাহাজে প্রায় চারশ শিখ দুই মাস নিরলস যাত্রা করে কানাডার ভ্যানকুভার বন্দরে গিয়ে পৌঁছালে ওই জাহাজ থেকে তাদের নামতে দেয়া হয়নি।
এদিকে জাহাজে খাবার ও পানি ফুরিয়ে গেছে, ফলে তারা নামতে চেষ্টা করে; কিন্তু তৎকালীন কানাডা সরকার ওই জাহাজে থাকা শিখদের নেতা গুরদিত সিংকে জানিয়ে দেয়, যদি বন্দর ছেড়ে না যাওয়া হয়, তাহলে পুরো জাহাজ মানুষসহ পুড়িয়ে দেয়া হবে। যাত্রীরা মরতে মরতে জাহাজে করে কলকাতায় ফিরে আসে। তারা আর বাড়ি ফিরতে চায় না, কলকাতাতেই থেকে যেতে চায়। কারণ তারা বাড়ি ঘর বিক্রি করে গিয়েছিল। তারা বিদ্রোহ করে। ঘটনাক্রমে সেই জাহাজের যাত্রীদের ওপর ব্রিটিশ পুলিশ গুলি চালায় এবং গুরদিত সিংকে ফাঁসি দেয়া হয়। মাত্র ১৯৮২ সালে পূর্ণ স্বাধীন দেশ হলেও কানাডা আসলে ব্রিটিশ এবং আমেরিকানদেরই একটি ভূমি, সাংস্কৃতিক ও পররাষ্ট্র নীতির দিক দিয়ে।
যা হোক, আধুনিক সময়ে ভারত ও কানাডার মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন প্রথম শুরু হয় ৭০ থেকে ৮০-এর দশকে। ১৯৭৪ সালে ভারত প্রথম স্মাইলিং বুদ্ধ নামে পারমাণু বোমা পরীক্ষা করে। কানাডা ভারতকে কানাডা-ইন্ডিয়া রিঅ্যাক্টর নামে পরমাণু প্রযুক্তির সহায়তা দিয়েছিল শান্তিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য; কিন্তু পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার পর কানাডা সেই সহায়তা বন্ধ করে দেয়। ফলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে চিড় ধরে। ৮০-এর দশক থেকে কানাডায় শিখদের স্বাধীন ভূমির দাবিতে যে খালিস্তান আন্দোলন তার সমর্থন বাড়তে থাকে। ভারত তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে মনে করে আসছে। যারা কানাডার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছে, তারা ভারতের পাঞ্জাবের স্বাধীনতার জন্য প্রচারণা, তহবিল সংগ্রহ ইত্যাদি শুরু করে। এ সময় চরম খালিস্তান আন্দোলন চলছিল। ১৯৮৪ সালে ভারত পাঞ্জাবের স্বর্ণমন্দিরে অপারেশন চালায় এবং জার্নাল সিং ভিন্দ্রেনেওয়ালেসহ ৪০০ লোক নিহত হয়, যার মধ্যে ৮৭ জন ছিল ভারতীয় সেনা। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কানাডার মাটি ব্যবহার করছে বলে ভারত অভিযোগ করে। ১৯৮৫ সালে ভারতের একটি ফ্লাইট কানাডার মন্ট্রিল থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লি যাত্রার পর বোমা বিস্ফোরিত হয় এবং ৩২৯ জন যাত্রীর সবাই নিহত হয়। ভারত এর পেছনে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীরা রয়েছে বলে দাবি করে।
এরপর আবার ১৯৯৮ সালে অটল বিহারি বাজপেয়ির সময়ে ভারত পরমাণু বোমার পরীক্ষা চালায়। কানাডা আবার ক্ষিপ্ত হয় এবং কানাডাসহ তার পশ্চিমা দোসররা ভারতের ওপর কিছু নিষেধাজ্ঞা দেয়। ঘটনাক্রমে তা তুলে নেয়া হয় এবং ভারত ও কানাডার মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক অব্যাহত থাকে; কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে কানাডা ভারতের সম্পর্ক উত্তরোত্তর খারাপ হতে থাকে এবং তা কেবলমাত্র শিখ আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই। এখন ভারত আর বিংশ শতাব্দীর মতো দুর্বল নেই। ভারতের অর্থনৈতিক শক্তি বেড়েছে, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা শক্তিশালী হয়েছে, সামরিক দিক দিয়ে বিশ্বে চার-পাঁচ নম্বর জায়গায় স্থান করে নিয়েছে। ফলে এখনকার বৈরিতা অনেক বেশি আন্তর্জাতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কানাডার শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে খালিস্তান আন্দোলনের মাত্রা অনেক বেশি বেড়েছে। ভারত কানাডার শিখ রাজনৈতিক নেতাদের বিচ্ছিন্নতাবাদ উসকে দেয়ার বিরুদ্ধে বারবার অভিযোগ করে আসছে।
২০১৭ সালে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কানাডায় অবস্থিত গুরুদুয়ারায় প্রবেশ নিষিদ্ধ করে কানাডার শিখ সম্প্রদায়। ভারত তীব্র আপত্তি জানায়। এরই পর পর ২০১৮ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ভারত সফর করেন কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করতে; কিন্তু তার প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন যশপাল আতোয়াল, যাকে ভারত একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী মনে করে। এই যশপাল আতোয়ালকে ভারতে নিযুক্ত কানাডীয় হাই কমিশন ডিনারের দাওয়াত করলে ভারত আরও ক্ষিপ্ত হয়। ২০২০ সালে ভারতে কৃষক আন্দোলন হয়। এই কৃষক আন্দোলন মূলত ছিল পাঞ্জাব ও হরিয়ানার শিখদের নেতৃত্বে। জাস্টিন ট্রুডো তাদের প্রতি সরকারের আচরণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলে ভারত অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ বলে অভিযোগ করে।
এখন প্রশ্ন হলো, কানাডার প্রধানমন্ত্রী কেন বারবার শিখদের হয়ে কথা বলেন এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিবৃতি দেন, উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং সরাসরি অবস্থান নেন? কানাডার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে রয়েছে শিখদের প্রভাব। দেশটির হাউস অব কমনসে ১৮ জন শিখ নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে। ট্রুডোর কেবিনেটে তিনজন ফুল মন্ত্রী রয়েছেন। কানাডায় শিখ নেতা জগমিত সিংয়ের নেতৃত্বাধীন নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টি ট্রুডো সরকারে কোয়ালিশনে ছিল। এখন নেই; কিন্তু তাদের মধ্যে আবার সখ্য গড়ে উঠেছে। ফলে তিনি অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে শিখদের স্বার্থ নিয়ে একটা চাপ অনুভব করেন। এরপর ২০২৩ সালের ১৮ জুন থেকে ভারত কানাডা সম্পর্ক সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ওইদিন কানাডার নাগরিকত্ব পাওয়া শিখ খালিস্থানপন্থি নেতা হারদিপ সিং নিজ্জার কানাডার সেই ভ্যানকুভারের সারে শহরে নিহত হন। কানাডা মনে করে, নিজ্জার একজন অ্যাক্টিভিস্ট; কিন্তু ভারত মনে করে সে খালিস্তান টাইগার ফোর্স নামের সশস্ত্র সংগঠনের মাস্টারমাইন্ড। জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ করেন যে, ভারতের এজেন্টরা নিজ্জারকে হত্যা করেছে, যদিও ভারত তা অস্বীকার করে আসছে।
অতি সম্প্রতি কানাডার রয়াল মাউন্টেন পুলিশ তাদের ইনভেস্টিগেশনে নিজ্জার হত্যায় ভারতীয় সরকারের এজেন্টদের কাজ বলে রিপোর্ট করার পর কানাডা সরকার কানাডায় নিযুক্ত ভারতের হাই কমিশনারসহ ৬ কূটনীতিককে বহিষ্কার করে। এর জবাবে ওই দিনই, অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর ভারতও দেশটিতে নিযুক্ত কানাডার হাইকমিশনার, ডেপুটি হাইকমিশনারসহ আরও চারজন ফার্স্ট সেক্রেটারিকে বহিষ্কার করে। বাস্তবে ভারত এবং কানাডা অলিখিতভাবে দুদেশের ভিসা প্রদানে খানিকটা কড়াকড়িও আরোপ করেছে। কানাডার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেলানি জলি এমনকি ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার সম্ভাবনারও ইঙ্গিত দিয়েছেন।
অন্যদিকে, কানাডার সঙ্গে সুর মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও বলেছে, ভারত ইনভেস্টিগেশনে যথেষ্ট সহায়তা করেনি। এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র ম্যাথু মিলারে কথায় বোঝা গিয়েছে, তারা এই কানাডা ভারত দ্বন্দ্বে কানাডাকেই সমর্থন দিচ্ছে। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে সেখানে নাগরিকত্ব গ্রহণকারী খালিস্তান মুভমেন্টের নেতা গুরপাত সিং পান্নুন ভারতে হামাস ধরনের আক্রমণের হুমকি দেয় এবং নানা ধরনের পুরস্কার ঘোষণা করে ভারত সরকারকে উৎখাত এবং ভারত ভেঙে দেয়ার জন্য। ২০২০ সালে ভারত পান্নুনকে ডেসিগনেটেড টেররিস্ট হিসাবে অখ্যায়িত করে। তার বিরুদ্ধে ভারতে ২২টি অভিযোগ আনা হয় এবং ভারত সরকার ইন্টারপোলের সহায়তা চায়; কিন্তু ইন্টারপোল সে সহায়তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ২০২৩ সালে পান্নুনকে হত্যাচেষ্টা হয়। যুক্তরাষ্ট্র এই হত্যা পরিকল্পনার জন্য বিকাশ যাদব নামে একজন ভারতীয় সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে অভিযুক্ত করে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ, এই ভারতীয় গোয়েন্দাই হত্যাচেষ্টাকারী নিখিল গুপ্তকে সব ধরনের আয়োজন ও পান্নুন সম্পর্কে ইনফরমেশন দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতে তিনি এখন ভারতে আছেন।
অর্থাৎ এই টানাপোড়েনে প্রকৃত পক্ষে জড়িয়ে পড়েছে ভারত কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্র এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা নিশ্চিত না। তবে আপাতত ভারতের সঙ্গে যে কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক শীতল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। ২০২৫ সালে কানাডায় নির্বাচন। মনে হচ্ছে এই নির্বাচনের আগে ট্রুডো সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের বিশেষ কোনো উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে