আট মাস ধরে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে গান্ধীর ভাস্কর্যটি
নওগাঁ জেলার আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেলস্টেশন থেকে ২০০ মিটার পূর্বে গেলেই দেখা যাবে গান্ধী আশ্রম বা বঙ্গীয় রিলিফ কমিটির তোরণ। আশ্রমের অদূরেই তিন মাথার মোড়ে স্থাপন করা হয়েছিল মহাত্মা গান্ধীর একটি ভাস্কর্য। সিমেন্টের বেঞ্চে ঘেরা চত্বরের মাঝখানে লোহার গ্রিলের ভেতরে ছিল ভাস্কর্যটি। জানা যায়, ভাস্কর্যটির বিশেষ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেই সেসময় এই লোহার গ্রিলের ব্যবস্থা করা হয়। তবে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই সেই লোহার গ্রিল টপকে দুর্বৃত্তরা ভেঙে ফেলে ভাস্কর্যটি। এখনো সেই অবস্থাতেই মুখ থুবড়ে পড়ে আছে সেটি। এরপর থেকে ভাস্কর্যটি সংস্কারের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
জানা যায়, মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন উপলক্ষে ২০২১ সালের ২ অক্টোবর এই ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করা হয়। নওগাঁ-৬ (আত্রাই-রানীনগর) আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য ইসরাফিল আলম ও ভারতীয় হাইকমিশনার যৌথ অর্থায়নে এ ভাস্কর্যটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন ২০২০ সালে। তবে ভাস্কর্যটি নির্মাণের পরপরই লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে দেয়ার ফলে সেটির সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছিলেন স্থানীয় সচেতন মহল। সেসময় লোহার খাঁচা দিয়ে ঘিরে রাখার কারণ হিসেবে নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে এনেছিলেন এটির নির্মাতা ভাস্কর মাহাফুজুর রহমান (ডন)।
গত ৩১ মার্চ ঈদুল ফিতরের দিন সন্ধ্যায় সরেজমিন দেখা যায়, লোহার নিরাপত্তা বেষ্টনি অক্ষত থাকলেও মহাত্মা গান্ধীর ভাস্কর্যটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। এ সময় সেখানে কিছু কিশোর ও তরুণকে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে হইচই এবং নাচানাচি করতে দেখা যায়। ব্যাটারিচালিত ভ্যানের ওপর সাউন্ডবক্স রেখে উচ্চৈঃস্বরে বাজানো হচ্ছিল হিন্দি গান। মোবাইল ফোনে ভেঙে ফেলা ভাস্কর্যটির ছবি তুলতে গেলে কয়েকজন কিশোর এগিয়ে আসে এবং বেশ রূঢ়ভাবে ছবি তোলার কারণ জানতে চায়।
সেখান থেকে সরে গিয়ে আহসানগঞ্জ রেলস্টেশনের কাছে কয়েকজন স্থানীয় ভ্যানচালক এবং দোকানির সঙ্গে কথা হয়। জানা যায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরপরই এটি ভেঙে ফেলা হয়। কারা এটি ভেঙে ফেলেন, এ প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, সেসময় একটি বিশৃঙ্খল অবস্থা ছিল। দল-মত নির্বিশেষে সবাই রাস্তায় ছিল। গান্ধী চত্বর মূল রাস্তা থেকে কিছুটা পেছনে হওয়ায়, কারা এটি ভেঙেছে সে বিষয়ে তারা তেমন কিছু বলতে পারবেন না। চত্বরের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা অভিযোগ করেন, সন্ধ্যা হলেই এলাকাজুড়ে এরকম কিশোর ও তরুণরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে অবস্থান করে এবং নানারকম উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে, ফলে এলাকার মানুষ বিরক্তির মধ্যে এবং নিরাপত্তা নিয়ে কিছুটা চিন্তিত অবস্থায় আছেন।
এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে আত্রাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো শাহাবুদ্দিন বলেন, ‘এলাকাজুড়েই আমাদের টহল টিম অত্যন্ত তৎপর অবস্থায় রয়েছে। ঈদের ছুটিতে জনবল কম থাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থতি ভালো রাখতে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে। তবে, কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। বিষয়টি নজরে আনার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমরা অবশ্যই গান্ধী চত্বর সংলগ্ন এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করব।’এদিকে এই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনায় এলাকার সচেতন মহলের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। তাদের দাবি, এসব দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় আনা উচিত।
এ ব্যাপারে স্থানীয় সাংবাদিকরা জানান, কে বা কারা এটি ভেঙেছে তা বলা মুশকিল, কারণ সেসময় একটি পক্ষ বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে পুরা এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং মোটামুটি সব ধরনের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলে। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক যুবক বলেন, ‘এই ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার ঘটনা খুবই হতাশাজনক। ব্যাপারটি নিয়ে এত সহজ সমীকরণ টানলে হবে না। এর পেছনে বড় ধরনের রাজনৈতিক জিঘাংসা কাজ করেছে। মহাত্মা গান্ধী রাজনীতির ঊর্ধ্বে গিয়ে একজন মানবতাবাদী, এই সত্য তারা ভুলে গেছেন।’
জানা যায়, ১৯২২ সালের সেপ্টেম্বরে প্রবল বৃষ্টিপাতে উত্তরবঙ্গের আত্রাইসহ অনেক নদী ফুলে ফেঁপে ওঠে। এর ফলে পূর্ববাংলায় দেখা দেয় এক ভয়াবহ বন্যা। বন্যার খবর কলকাতায় পৌঁছালে ‘ভারত সভা হলে’ আয়োজিত হয় একটি জনসভা। সেই জনসভা থেকেই এ বাংলায় অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে তৈরি হয় ‘বন্যা সাহায্য কমিটি’। সে সময় মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে এই কমিটিতে সক্রিয় হলেন সুভাষচন্দ্র বসু এবং আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। তারা এই এলাকার জমিদার, ব্যবসায়ী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের অনুদানে আত্রাই ঘাট রেলওয়ে স্টেশনের পূর্বপাশে গড়ে তোলেন ‘বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি’ নামক একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। বন্যা-পরবর্তী স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে কলকাতা মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র ডা. নীরেন দত্ত এখানে চালু করলেন একটি চিকিৎসাকেন্দ্র।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সেসময় বন্যায় রাজশাহী, বগুড়া ও নওগাঁ জেলা মিলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ৬ কোটি টাকা, গৃহহীন হয়ে পড়েছিলেন কয়েক লাখ মানুষ। মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে এবং আচার্য্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের নেতৃত্বে এপার বাংলার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ভারতীয় স্বেচ্ছাসেবক, ছাত্র, শিক্ষক ও সাধারণ মানুষ। তাই, কৃতজ্ঞতাস্বরূপ গান্ধীর ভাস্কর্যটি এখানে স্থাপন করা হয়।
মহাত্মা গান্ধী ও এই ভাস্কর্যের বিষয়ে কথা হয় প্রখ্যাত লেখক ও গবেষক মফিদুল হকের সঙ্গে। তিনি ‘ভিউজ বাংলাদেশ’কে বলেন, ‘মহাত্মা গান্ধী একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার রক্ষায় তার অবদান রয়েছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশে তাকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। অনেক দেশেই তার সম্মানে স্থাপন করা হয়েছে নানারকম স্মারক এবং ভাস্কর্য। বাংলাদেশের মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে তার ভূমিকা অনস্বীকার্য। ফলে বাংলাদেশেও তার ভাস্কর্য থাকবে- এটি খুবই স্বাভাবিক এবং আমাদের জন্য সম্মানের।’
এপার বাংলার বিশেষ করে আত্রাইয়ের উন্নয়নে মহাত্মা গান্ধীর অবদান বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের এই প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি বলেন, ‘তৎকালীন পূর্ব বাংলার বিশেষ করে উত্তরবঙ্গের জনসাধারণের জীবনমান উন্নয়নে তার অবদান আমাদের শ্রদ্ধাভরে এবং কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করতে হবে। এই এলাকায় ‘বঙ্গীয় রিলিফ কমিটি’ গঠন করে তিনি স্থানীয়দের শিক্ষা, চিকিৎসাসহ নারীদের স্বাবলম্বী হিসেবে গড়ে তুলতে নানারকম কর্মসূচি গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের উচিত হবে, সেসব কর্মসূচিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং এলাকার মানুষের মধ্যে মহাত্মা গান্ধীর আদর্শকে ছড়িয়ে দেয়া।’
গান্ধীর ভাস্কর্য ভাঙার ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা একটি বর্বোরচিত কাজ। আমি দাবি জানাই, ভাস্কর্যটি অবিলম্বে সংস্কার করে পুনঃস্থাপন করা হোক।’
এ ব্যাপারে সমাজকর্মী এবং গান্ধী আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত ফরিদুল আলম পিন্টু জানান, ‘বিষয়টি সেই সময় ভারতীয় হাইকমিশনের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের জানানো হয়েছে। তারা দেখেও গেছেন। তবে, আর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ভাস্কর্যটি এভাবেই পড়ে আছে।’
ভেঙে ফেলা ভাস্কর্যটি অপসারণ করা হচ্ছে না কেন বা এটি আবার সংস্কার করে পুনঃস্থাপন করা হবে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে আত্রাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামাল হোসেন ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘বিষয়টি আমরা জানি, তবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কোনো নির্দেশনা না থাকায় আমরা কোনো ব্যবস্থা এখনো নেইনি। বিষয়টি সম্পর্কে স্যাররা বিস্তারিত বলতে পারবেন।’
যোগাযোগ করলে নওগাঁর জেলা ডেপুটি কমিশনার ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল আওয়াল বলেন, 'আমি বিষয়টি জানি না। আমাকে প্রথমে স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে।'
মারিয়া সালাম: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে