রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর
আমূল বদলেছে পোশাক শিল্পের পরিবেশ
সাভারে রানা প্লাজা ধসের পর গত ১১ বছরে আমূল বদলে গেছে পোশাক খাতের কর্মপরিবেশ। এ খাতের মালিকদের পাশাপাশি শ্রমিক নেতা ও গবেষকরাও এ কথা স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, রানা প্লাজায় ১ হাজার ১৩৫ শ্রমিকের প্রাণহানির পর ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোটের চাপে কারখানা মালিকেরা বাড়তি বিনিয়োগ করে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করেছেন। বাংলাদেশের পোশাক খাত যে এখন নিরাপদ ও কমপ্লায়েন্ট তা প্রকাশ্যেই স্বীকার করছেন বিভিন্ন সময়ে এ খাতের সমালোচনা করা পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরাও। তবে শ্রমিক অধিকারের ক্ষেত্রে আরও কিছু করার রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারখানা মালিকরা বলছেন, আগে প্রায় প্রতি বছরই পোশাক খাতে কোনো না কোনো দুর্ঘটনা ঘটত। কিন্তু ২০১৫ সালের পর থেকে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। এ সময়ে ইউরোপের ক্রেতা জোট অ্যাকর্ড ও উত্তর আমেরিকার ক্রেতা জোট অ্যালায়েন্সের সুপারিশ অনুযায়ী, কারখানাগুলোতে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা হয়েছে। এতে পোশাক খাত ভেতর থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছে। এ কারণেই মালিকরা এখন ক্রেতা হারানোর বদলে তৈরি পোশাকের দাম বাড়ানোর জন্য দরকষাকষি করার ওপর জোর দিচ্ছেন। ‘রানা প্লাজা’ ধসের বছর অর্থাৎ ২০১২-১৩ অর্থবছরে এ খাতে রপ্তানি হয়েছে ২১ বিলিয়ন ডলার। তবে নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬ দশমিক ৯৯ বিলিয়ন ডলারে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে (জুলাই-ফেব্রুয়ারি) এই খাতে রপ্তানির পরিমাণ ৩২ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার। পোশাক খাতের বদলে যাওয়ার গল্প বিশ্বজুড়ে ব্র্যান্ডিং করে আগামী ২০৩০ সাল নাগাদ রপ্তানি আয় ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা নিচ্ছেন মালিকরা।
বিজিএমইএ নেতারা জানিয়েছেন, পোশাক খাতের যাত্রাকাল থেকে রানা প্লাজা ধস পর্যন্ত সময়কালের পরিস্থিতি ও তারপর এ খাতের ইতিবাচক পরিবর্তন তুলে ধরা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল বাংলাদেশের ২০৭টি পোশাক কারখানাকে লিড সনদ দিয়েছে। এর মধ্যে ৭৭টি লিড প্লাটিনাম। বিজিএমইএ বলছে, বিশ্বে পরিবেশবান্ধব শিল্পোদ্যোগে শীর্ষে রয়েছে দেশের পোশাক খাত। পোশাক খাতের বদলে যাওয়ার গল্প তুলে ধরে দর বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে।
তারা জানান, রানা প্লাজা ধসের পর পশ্চিমা দেশগুলোর ক্রেতারা আমদানিকারক ব্র্যান্ডগুলোর কার্যালয়ের সামনে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। তিন মাসের মাথায় ২০১৩ সালের জুন মাসে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য সুবিধা (জিএসপি) স্থগিত করে ২০ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নের শর্ত দেয় যুক্তরাষ্ট্র। জিএসপি পুনর্বহালের জন্য সেগুলো গুরুত্ব দিয়ে বাস্তবায়ন করে সরকার, যদিও তা ফিরে পাওয়া যায়নি। ইউরোপের দেশগুলোও পোশাক খাতে সময়াবদ্ধ সংস্কারের জন্য চাপ দেয়। তার পরিপ্রেক্ষিতেই অ্যালায়েন্স ও অ্যাকর্ড বাংলাদেশের পোশাক খাত সংস্কারে কাজ শুরু করে। অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের অধীনে ২ হাজার ২৫৪টি কারখানা মান যাচাই শেষে প্রাপ্ত ত্রুটির প্রায় ৯০ ভাগই সংস্কার করেছে। অন্যদিকে, সংস্কার না করায় ১৯৪টি কারখানাকে ব্যবসার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। ৬২৫টি কারখানা প্রাথমিক সংস্কারের কাজ পুরোপুরি শেষ করেছে। এই সংস্কার কাজে ভবনের দেয়াল থেকে শুরু করে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম সবকিছুই পরীক্ষা করে ত্রুটি দূর করতে হয়েছে মালিকদের।
কারখানা মালিকরা জানান, এ সময়ে মালিকদের দাবি মেনে করপোরেট কর হার, উৎসেকর হার কমিয়ে সমর্থন জুগিয়েছে সরকার। তৈরি পোশাক কারখানায় অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত আমদানি সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। গত ছয় বছরে রানা প্লাজার মতো ভবনগুলোতে যেসব ছোট ও সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা গার্মেন্ট ছিল, সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে অথবা অন্য কোথাও স্থানান্তর করা হয়েছে। সরকারও এ সময় পোশাক খাত সংস্কারে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভা কমিটি গঠন করে। কারখানার মানোন্নয়নে গত ১১ বছর এ খাতে বড় ধরনের কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি। শ্রমিক অসন্তোষও অনেক কমেছে।
রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাত কতটা এগিয়েছে এ প্রশ্নে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, “বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ফ্যাক্টরিগুলো এখন বাংলাদেশে। বিল্ডিং সেফটি, ফায়ার সেফটি, ইলেকট্রিক সেফটি-সবকিছু উন্নত করা হয়েছে। রানা প্লাজা ধস আমাদের জন্য একটা ওয়েক আপ কল (সতর্কবার্তা) ছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যম বলছে, বাংলাদেশের ফ্যাক্টরিগুলো এখন বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ফ্যাক্টরি। ২০১৫ সালের আগে আমরা অনেক অগ্নি দুর্ঘটনাসহ নানা দুর্ঘটনা দেখতাম। এখন কিন্তু সেটা আর নেই। ফায়ার সেফটি শক্তিশালী থাকায় কোন দুর্ঘটনা এখন পর্যন্ত ঘটেনি।”
তিনি আরও বলেন, “পশ্চিমা ক্রেতারা ভারতের তৈরি পোশাকের যে মূল্য দেয়, বাংলাদেশকে তা দেয় না। এতদিন ইমেজ ভালো না থাকায় আমাদের দরকষাকষির সুযোগ ছিল না। এখন সে পরিস্থিতি নেই। এখন পোশাকের দর বাড়ানোই আমাদের প্রধান চ্যালেঞ্জ।”
বিজিএমইএ’র সাবেক পরিচালক্ ও ঢাকা-১৮ আসনের সংসদ সদস্য মো. খসরু চৌধুরী ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, রানা প্লাজা ধ্বসের আগে দেশে একটা গ্রিন ফ্যাক্টরিও ছিল না। বর্তমানে এই সংখ্যা ২১৫টি। এরমধ্যে প্লাটিনাম, গোল্ড, সিলভার ও সার্টিফাইড ক্যাটাগরির ফ্যাক্টরি রয়েছে। সারাবিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া আর কোন দেশের এমন অবস্থা নেই। বাংলাদেশ এখন এমন উচ্চতায় পৌঁছেছে যা অন্য কোনও দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি সুবিধা পেতে তাদের শর্তের কতটুকু পূরণ করা সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে খসরু চৌধুরী বলেন, “জিএসপি বাতিলের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেকগুলো শর্ত দিয়েছিল যার বেশিরভাগই পূরণ করা হয়েছে। আর কয়েকটি শর্ত আমরা মেনে নেইনি। যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে এক্ষেত্রে যত শর্ত দিয়েছে, তার মধ্যে বাংলাদেশই সবচেয়ে বেশি শর্ত পূরণ করা দেশ।”
বিগত সময়ে পোশাক খাত বদলে যাওয়ার কথা স্বীকার করে জাতীয় গার্মেন্ট শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার ভেতরে শ্রমিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। কারখানায় কাজের পরিবেশ নিশ্চিত হয়েছে। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ বেড়েছে, তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেড়েছে। তবে এ কাজ এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি। নিরাপদ কর্মক্ষেত্র বলতে যা বোঝায় তা পুরোপুরি নিশ্চিত করতে চলমান সংস্কার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করেন তিনি।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, পোশাক খাতের কাঠামোগত অনেক পরিবর্তন এসেছে। কারখানাগুলো নিরাপদ হয়েছে। সে বিবেচনায় শ্রমিক পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। আগামীতে শ্রমিকদের জীবনমানের উন্নয়নের দিকে আরও গুরুত্ব দিতে হবে।
এফবিসিসিআই সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ও জার্মানির পণ্য আমদানি করতে চায়নি কোনো দেশ। যুদ্ধে পরাজয়ের পর সারা বিশ্বে তাদের সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু পণ্যের মান বাড়িয়ে সে পরিস্থিতি পাল্টাতে পেরেছে তারা। রানা প্লাজা ধসের পর বাংলাদেশের পোশাক নিয়েও নেতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছিল। একেকটি কারখানায় ৫-৩০ কোটি পর্যন্ত বাড়তি বিনিয়োগ করে নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এখন এগুলো বিশ্ববাসীর কাছে প্রচারে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্য দিয়েই আমরা পোশাকের ন্যায্যমূল্য আদায় করতে সক্ষম হব। কারণ আমাদের পোশাকের মান অন্য দেশের তুলনায় অনেক ভালো।”
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে