গাজী টায়ার কারখানায় আগুন: বিপর্যয়ের মুখে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ
বেকার হবে প্রায় ১০ হাজার মানুষ
অস্থির হতে পারে রিকশা, অটোরিকশার টায়ারের বাজার
ভাড়াটিয়া হারাবেন মধ্যম আয়ের বাড়ির মালিকরা
নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কায়
বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম টায়ার প্রস্তুতকারী গাজী অটো টায়ার কারখানায় অগ্নিকাণ্ড ও লুটপাটের ঘটনায় বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ সরাসরি এই বিপর্যয়ের মুখে পড়বে। ধারণা করা হচ্ছে, অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক কাজ হারিয়ে বেকার হবেন। পাশাপাশি অস্থির হতে পারে টায়ারের বাজার।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত গাজী অটো টায়ার কারখানায় গত ২৫ আগস্ট ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত ১৩০ জনের প্রাণহানি হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরই কারখানাটিতে প্রথম দফায় হামলা হয়। পরে গাজী গ্রুপের চেয়ারম্যান সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের খবরে ২৫ আগস্ট মাইকে ঘোষণা দিয়ে কারখানায় লোক জড়ো করা হয়। পরে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। অগ্নিকাণ্ডে সম্পূর্ণ ভবনটি পুড়ে গেছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এখনো ক্ষতির পরিমাণ প্রকাশ করতে না পারলেও কারখানাটি বড় আর্থিক বিপর্যয়ে পড়বে, তা মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া কারখানার শ্রমিকসহ ওই এলাকার নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ বড় অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখে পড়বে।
কর্মহীন হয়ে পড়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ
২৫ আগস্ট গোলাম দস্তগীর গাজীর গ্রেপ্তারের খবর টিভিতে প্রচার হওয়ার পর পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে একটি বিশাল মিছিল টায়ার কারখানার পেছনের মূল গুদামে অভিযান লুটপাট শুরু করে। ওই গুদামে টায়ার, কাঁচামালসহ প্রচুর পরিমাণে দাহ্য তরল পদার্থ ছিল।
উত্তেজিত জনতা লুটপাটের এক পর্যায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। ছয় দিন ধরে সেখানে আগুন জ্বলে। পরে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। গাজী গ্রুপের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভবন, গুদাম, যানবাহন এবং যন্ত্রপাতি সবই ধ্বংস হয়ে গেছে, ফলে ১০ হাজার কর্মী বেকার হবে।
গাজী অটো টায়ারের এজিএম (কমার্শিয়াল মার্কেটিং) মুস্তাফিজুর রহমান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'যারা কারখানায় কাজ করছিলেন তারা বেশিরভাগই মধ্যম ও নিম্ন আয়ের মানুষ। রাতারাতি কারখানার ১০ হাজারেরও বেশি কর্মচারী বেকার হয়ে গেছে। এ অবস্থায় বলা মুশকিল আবার কবে কারখানা খুলতে পারব।'
তিনি বলেন, 'কারখানার সবকিছু ক্ষতিগ্রস্ত বা লুটপাট হয়ে গেছে। কাজেই কারখানাটি কবে আবার উৎপাদনে যাবে, সে বিষয়ে মন্তব্য করা সম্ভব নয়।'
অগ্নিকাণ্ডে বিধ্বস্ত ভবনটি পরিদর্শন করেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি বিশেষজ্ঞ দল। তারা জানিয়েছে, যে কোনো মুহূর্তে ভবনটি ধসে পড়তে পারে।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য উল্লেখ করে ঘটনাস্থলে উপস্থিত কয়েকজন কর্মচারী বলেন, তারা আশা হারিয়ে ফেলেছেন।
গাজী গ্রুপের উপ-পরিচালক রফুকুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'আমরা আগস্ট মাসের বেতন তাড়াতাড়ি পরিশোধ করবে। এরপর কী হবে জানি না। এখনই কোনো আশ্বাস দেওয়া সম্ভব না।'
অস্থির হতে পারে রিকশা, অটোরিকশার টায়ারের বাজার
গাজী অটো টায়ার কারখানায় রিকশা, অটোরিকশা, হালকা বাণিজ্যিক যান, মোটরসাইকেল, ইজিবাইক, সাইকেল এবং কৃষি কাজে ব্যবহৃত যানবাহনের টায়ার উৎপাদন করা হতো। এই পণ্যগুলোর ভোক্তা মধ্যম আয়ের মানুষ। গাজী অটো টায়ার কারখানাটি ৬০ শতাংশের বেশি রিকশার টায়ার এবং প্রায় ৪০ শতাংশ অটোরিকশা, রিকশা ভ্যান এবং সিএনজিচালিত অটো টায়ার উৎপাদন ও সরবরাহ করে। হঠাৎ করে কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় অল্প সময়ের মধ্যে সরবরাহ বাজারে বড় ধরনের ধাক্কা লাগবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হঠাৎ উৎপাদন বন্ধ হওয়ায় বাজারে সরবরাহ কমবে। এতে সাপ্লাই চেইনে বড় বিপর্যয় দেখা দেবে। এতে এই পেশার সঙ্গে জড়িতদের আয় কমার পাশাপাশি অনেকে বেকার হয়ে যাবেন।
এসব টায়ারের দাম এরই মধ্যে ১০০ টাকা (টায়ার প্রতি) বেড়ে গেছে উল্লেখ করে, মারিয়াম সাইকেল স্টোরের মালিক মোহাম্মাদ ইসলাম ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘দেশের বাজারে মূলত তিন কোম্পানির- গাজী, আলম, মেঘনা টায়ার বেশি চলে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় টায়ার তৈরির কাঁচামাল হিসেবে যে রাবার দরকার হয়, সেটা প্রক্রিয়াজাত করে দেশের বাজারে গাজী থেকেই সাপ্লাই দেওয়া হয়।এই রাবারের সাপ্লাই বন্ধ হলে আগামী তিন মাসের মধ্যেই বাজারে একটা অস্থিতিশীলতা তৈরি হবে।’
কারখানাটির এজিএম (বাণিজ্যিক বিপণন) মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, 'আমাদের সাম্প্রতিক জরিপ অনুসারে, হালকা যানবাহনের টায়ারের বাজারের অর্ধেকের বেশি আমাদের টায়ারের ওপর নির্ভরশীল। তাই, হঠাৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে বাজারে বিরূপ প্রভাব পড়বে।'
কয়েকটি রিকশার মালিক আইনাল মিয়া ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'পণ্যের দাম বাড়লে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষই প্রথম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। টায়ারের দাম বাড়লে আমরা সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হব।'
ভাড়াটিয়া হারাবেন মধ্যম আয়ের বাড়ির মালিকরা
কারখানায় কর্মরত ১০ হাজার কর্মচারীর মধ্যে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশের বাড়ি ওই এলাকার বাইরে, যারা কারখানার আশপাশের এলাকায় ভাড়া বাড়িতে থাকেন। এসব শ্রমিকের থাকার উপযোগী করে বাড়ির মালিকরা বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
স্থানীয় ও কারখানার শ্রমিকরা জানান, কারখানা সংলগ্ন বিভিন্ন গ্রামে প্রায় ৩ থেকে ৪ হাজার পরিবার ভাড়া বাড়িতে থাকে। তাদের আশঙ্কা, বেকার হওয়ার পর অনেক শ্রমিক পরিবার নিয়ে অন্য জায়গায় চলে যাবেন। এতে বাড়ির মালিক, স্থানীয় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক আর্থিক ধাক্কা খাবে।
কারণ হিসেবে তারা জানান, বাসা ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার, রেস্তোরাঁ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্নভাবে এ এলাকায় অন্তত ৫ কোটি টাকার ট্রানজিশন হয়। কারখানা বন্ধ হলে এই ট্রানজিশনও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয় হবে।
খাদুন গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবুজ বলেন, 'বাড়ির মালিক, ব্যবসায়ী, রেস্তোরাঁ ব্যবসা এবং স্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কারখানার কর্মচারীদের ওপর নির্ভরশীল। তারা মাসে অন্তত ৩ থেকে ৫ কোটি টাকারও বেশি ট্রানজিশন করে।'
তিনি বলেন, এখন বেশিরভাগ কর্মচারী এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। অল্প সময়ের মধ্যে কারখানাটিও সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যাবে। এতে এই এলাকার অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।'
স্থানীয় বাড়ির মালিক মোহাম্মদ সেলিম বলেন, 'গাজী স্থানীয় বাসিন্দাদের কাজ না দিলেও আমরা কারখানার সুবিধা পেয়েছিলাম। বাড়ি ভাড়া দিয়ে আমরা আয় করেছি।'
তিনি বলেন, ১০ হাজার কর্মচারীর মধ্যে অনেকেই হয়তো আশপাশের কারখানায় চাকরি পাবেন; কিন্তু বেশিরভাগই নতুন কাজের সন্ধানে এলাকা ছেড়ে চলে যাবে। এতে আমাদের বাড়িগুলো খালি থাকবে। বলতে গেলে অগ্নিকাণ্ডের কারণে আমরা আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লাম।'
গাজী অটো টায়ার কারখানার নির্বাহী পরিচালক (অ্যাডমিন, এইচআর, ফায়ার সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, 'আমি ধরে নিচ্ছি এই প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতির মাধ্যমে শেষ হবে না। অনেক স্থানীয় যুবক আছে, যারা বিভিন্নভাবে কারখানার ওপর নির্ভরশীল। আর্থিক হতাশা থেকে ডাকাতি বা মাদকাসক্তির মতো বিভিন্ন অনৈতিক কাজে তারা লিপ্ত হতে পারে।'
নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কায়
টায়ার প্রস্তুতকারী কারখানায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যরা বড় অর্থনৈতিক সংকটের শঙ্কায় রয়েছেন। এ ঘটনায় অন্তত ১২৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। তার নিহত হয়েছেন বলে মনে করা হচ্ছেন।
স্থানীয় একটি দোকানের সহকারী রাসেল হোসেনের মতে, কয়েকশ মানুষ কারখানায় লুট করতে এসেছিল; কিন্তু কারখানায় আগুন লাগায় তারা আর বের হতে পারেনি।
আগুনের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর আটকে পড়া ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা কারখানার সামনে জড়ো হন। তারা উদ্ধারের জন্য ফায়ার সার্ভিসের সদস্যদের খবর দেন।
তবে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ওই ভবন থেকে কোনো মৃতদেহ উদ্ধার করতে পারেনি ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস ও জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি ভবনে তল্লাশি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়েছে শুক্রবার বিকেলে তল্লাশি অভিযান স্থগিত করেছে।
রাসেল বলেন, যারা নিখোঁজ তারা গাজী গ্রুপের শ্রমিক নয়। তবে গত ২৫ আগস্ট নিখোঁজ হওয়া মো. মনির হোসেনের বড় ভাই মো. জাকির জানান, তার ভাই কারখানার শ্রমিকদের একজন।
তিনি বলেন, মনির গত দুই মাসের বেতন পাননি। তাই, কারখানায় কী ঘটছে তা নিয়ে তিনি কৌতূহলী ছিলেন। এখন তিনি নিখোঁজ এবং তার দুই সন্তানসহ তার পরিবার বড় বিপর্যয়ের মুখে।
নূরে আলম নামের নিখোঁজ একজনের মা নূর বানু আইডি কার্ড নিয়ে ছেলেকে খুঁজতে আসেন। রোববার রাতে নূর আলম ও তার সাত বন্ধুসহ এ ভবনে প্রবেশ করে আটকে যায়। একই অবস্থা অপু ও তার মামা নজরুলেরও।
নিখোঁজদের বেশিরভাগই তাদের পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। লাশ পাওয়া না যাওয়ার ঘোষণার পরপরই ক্ষতিপূরণের দাবিতে কারখানার প্রধান ফটকে ক্ষোভে ফেটে পড়েন নিখোঁজদের স্বজনরা।
বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য উপজেলার ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ক কাজী মনিরুজ্জামান মনির বলেন, গাজী সাহেবের ওপর মানুষের ক্ষোভ থাকতে পারে কিন্তু শত শত মানুষের আয় কেড়ে নেওয়ার কাজ কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।
তিনি বলেন, ‘কারণ যাই হোক না কেন- প্রতিশোধ, লোভ বা অন্য কিছু, যারা কারখানায় হামলা করেছে তাদের এটা করা উচিত ছিল না।’
তিনি আরও বলেন, ‘একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। তাদের পক্ষে এখনই সমস্যাটির সমাধান করা কঠিন। তবে, আমরা সরকারকে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছি কারণ এটা মানুষের টিকে থাকার বিষয়।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে