ইসরায়েলের গণহত্যা: দক্ষিণ আফ্রিকার মামলা
গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজেতে মামলা ঠুকে দিয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। এই কোর্ট জাতিসংঘের শীর্ষ আদালত; জাতিসংঘের সব সদস্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই আদালতের সদস্য। দায়ের করা মামলার ৮৪ পৃষ্ঠার আর্জিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েল বোমা মেরে গাজার ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করে দিচ্ছে। ইসরায়েলের কর্মকর্তাদের বক্তব্যেও গণহত্যার উদ্দেশ্য প্রকাশ পেয়েছে বলে আর্জিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
আর্জিতে আরও বলা হয়েছে, ইসরায়েলের বর্বরোচিত ধ্বংসযজ্ঞ তাড়াতাড়ি থামানো না হলে গণহত্যার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। ইসরায়েল মামলাটি লড়ার ঘোষণা দিয়েছিল এবং যুদ্ধ শুরু করার জন্য হামাসদের দায়ী করেছে। ফিলিস্তিনিদের সশস্ত্র সংগঠন হামাস গত বছর ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ভেতরে ঢুকে ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা করে ২০০ জনেরও বেশি লোককে গাজায় এনে বন্দি করে রাখে। হামাসের এই আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে ইসরায়েল প্রথমে বিমান হামলা চালায়, পরে স্থলপথে অভিযান শুরু করে। ইসরায়েলের আক্রমণে এই পর্যন্ত প্রায় ২৮ হাজার লোক মারা গেছে, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই নারী ও শিশু। ইসরায়েল যুদ্ধ চালিয়ে শুধু মানুষ হত্যা আর অবকাঠামো ধ্বংস করছে না, তারা গাজায় খাদ্য, পানি এবং জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ রেখেছিল, এখন আন্তর্জাতিক চাপে সীমিত আকারে খাবার ও পানি সরবরাহ করার অনুমতি দিয়েছে।
ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস বা আইসিজে প্রতিষ্ঠিত করার অন্যতম প্রধান কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইউরোপে ৬০ লাখ ইহুদির হত্যা। ইহুদিদের নির্বিচারে হত্যার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে যে আদালত ১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়, আজ সেই আদালতে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েল আসামি। শুনানির পর মামলার অন্তর্বর্তীকালীন রায়ে গাজায় গণহত্যা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে এমন কর্মকাণ্ড রোধে পদক্ষেপ নিতে ইসরায়েলকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া গাজায় মানবিক সহায়তার প্রবেশ নিশ্চিত করতেও ইসরায়েলকে পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আদালতের রায় থেকে প্রতীয়মান হয়, গাজায় ইসরায়েল গণহত্যা চালাচ্ছে বলে কোর্ট এখনো তা স্বীকার করছে না; প্রকৃতপক্ষে যুদ্ধে কোনো রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে গণহত্যার ঘটনা প্রমাণ করা খুব সহজ কাজ নয়। বসনিয়ার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সার্বিয়ার গণহত্যার অভিযোগ খারিজ করে দিয়েছিল আইসিজে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ২০১৯ সালে দায়ের করা গাম্বিয়ার গণহত্যার মামলাটির ওপর এখনো শুনানিই হয়নি। দক্ষিণ আফ্রিকা আশা করেছিল কোর্ট যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেবে; কিন্তু কোর্ট যুদ্ধ বন্ধের আদেশ দেয়নি। কোর্ট রায় প্রদানে এবার সতর্কতা অবলম্বন করেছে, কারণ রায় কার্যকর করার মতো কোনো ক্ষমতা কোর্টের হাতে নেই।
ইউক্রেনও রাশিয়ার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলা করেছিল, আইসিজে রাশিয়াকে সামরিক অভিযান বন্ধ করার নির্দেশ দিলেও মস্কো সেই নির্দেশ উপেক্ষা করেছে। মিয়ানমার এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ গাম্বিয়া এবং ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে যুক্তিতর্ক পেশের আবেদন করেছিল; কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কেউ আদালতে দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ নেয়নি; ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মামলার বিষয়ে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে গিয়ে বলেছে, এই মামলার কোনো যোগ্যতা নেই এবং মামলাটি ভিত্তিহীন।
অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকার করা এই মামলাকে ইসরায়েল প্রত্যাখ্যান করেছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর অভিমত হচ্ছে, গাজা অভিযানে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী নজিরবিহীন নৈতিকতার পরিচয় দিয়েছে; কিন্তু হামাস যদি সুযোগ পেত, তাহলে সব ইহুদিকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করত। দক্ষিণ আফ্রিকার করা মামলার গুরুত্ব অপরিসীম, এর মাধ্যমে ইসরায়েলকে অন্ততপক্ষে অভিযুক্ত করা সম্ভব হলো। দুঃখজনক হচ্ছে, ইসরায়েলকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত করার জন্য কোনো মুসলিম দেশ এগিয়ে আসেনি, এসেছে একটি খ্রিষ্টান অধ্যুষিত দেশ। মাত্র ৩ শতাংশ মুসলমান দক্ষিণ আফ্রিকার বাসিন্দা। শুধু মামলা করেনি, যুদ্ধের শুরুতে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে সব ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। গাজার ওপর বর্বরোচিত হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত অক্টোবরে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ বলিভিয়াও ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল; অথচ বলিভিয়ার ৯৯ শতাংশ অধিবাসী খ্রিষ্টান। মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র বাহরাইন ইসরায়েলে নিযুক্ত তাদের রাষ্ট্রদূতকে দেশে ফিরিয়ে এনে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছিল; কিন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেনি।
এই মামলায় বাংলাদেশসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন দিয়েছে মাত্র। শিয়া মুসলিমদের নিয়ে গঠিত লেবাননের হিজবুল্লাহ হামাসের পক্ষে ইসরায়েলে রকেট নিক্ষেপ করছে, এরা ২০০৬ সালেও ৩৪ দিন যুদ্ধ করেছে ইসরায়েলের সঙ্গে। ইয়েমেনের হুতিরাও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছে, তারাও ইরান সমর্থিত সশস্ত্র গোষ্ঠী। ৫৭টি মুসলিম দেশের মধ্যে একমাত্র ইরানই হামাসের অকৃত্রিম বন্ধু। হামাস ইরান সমর্থিত বলেই কোনো আরব মুসলিম দেশ তাদের পছন্দ করে না, ইসরায়েলের মতো তারাও হামাসের ধ্বংস কামনা করে। গাজায় ইসরায়েলের লাগাতার হামলার ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আমেরিকার ইহুদিরা যতটুকু বিক্ষোভ করছে, ততটুকু বিক্ষোভ কোনো মুসলিম দেশে হয়েছে বলে মনে হয় না। আরবলিগ ও ওআইসির ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। সম্মুখযুদ্ধে ইসরায়েলের সঙ্গে কোনো মুসলিম দেশ লড়তে সাহসী হবে না; কিন্তু তাই বলে ৫৭টি মুসলিম দেশকে এভাবে নীরবতা পালন করতে হবে কেন?
যুদ্ধ বন্ধ না হলে একযোগে মুসলিম দেশগুলো আমেরিকার সৃষ্ট বলয় থেকে সরে যাওয়ার হুমকি দিতে পারে; কিন্তু দেবে না; কারণ গণতন্ত্রবিহীন মুসলিম রাষ্ট্রগুলো ইরানের চেয়ে ইসরায়েলকে বেশি নিরাপদ মনে করে। ১৯৯৩ সালে পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গঠনের ৫ বছরের মধ্যে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ৩০ বছরেও হয়নি। রাজতন্ত্রবিরোধী ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সম্ভবত কোনো আরব মুসলিম দেশও চায় না; চায় না বলেই ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রে ব্যতিরেকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটি কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছে কতিপয় আরব দেশ। আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতেই সম্ভবত হামাসের সশস্ত্র যোদ্ধারা ৭ অক্টোবর ইসরাইলের শহরগুলোতে রকেট নিক্ষেপ ও সীমান্ত প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেঙে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহরগুলোতে প্রবেশ করে গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। হামাসদের নিশ্চিহ্ন করার ক্ষেত্রে ইসরায়েল এত বেশি একগুয়ে হয়ে উঠেছে যে, তারা কারও কথা মানছে না, গাজায় প্রতিদিন টনে টনে বোমা ফেলছে।
রাষ্ট্র গঠনের প্রাথমিক পর্যায়ে ইসরায়েল আরব রাষ্ট্রগুলোর স্বীকৃতির জন্য লালায়িত ছিল, স্বীকৃতির বিনিময়ে তারা যে কোনো সমঝোতায় সম্মত ছিল; কিন্তু আরব রাষ্ট্রগুলো ইসরায়েলকে ভূমধ্যসাগরে ডুবিয়ে নিশ্চিহ্ন করার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর ছিল। আর এখন! ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ইসরায়েলের সম্মতির বিনিময়ে সৌদি আরব সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে প্রস্তুত; মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এন্থনি ব্লিনকেনের দেয়া এমন একটি প্রস্তাব ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন প্রত্যাখ্যান করেছেন। অর্থাৎ এক সময় ইসরায়েল তাদের স্বীকৃতি দেয়ার জন্য আরব দেশগুলোর কাছে ধরনা দিয়েছিল, এখন সব আরব দেশের একটি দাবি, ইসরায়েল যেন ফিলিস্তিনেদের স্বীকৃতি দেয়।
সময়ের ব্যবধানে ইসরায়েলের বাস্তবতা বিশ্বে স্বীকৃত হলেও ফিলিস্তিনিদের অস্তিত্ব কেউ মানছে না। জেরুজালেম ও আল আকসা মসজিদে মুসলমানদের আধিপত্য ইহজগতে প্রতিষ্ঠিত হবে বলেও মনে হয় না। কারণ মুসলিম দেশগুলো এসব সমস্যা এড়িয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে উদ্গ্রীব। কথিত সোলায়মানি বাদশাহ এরদোগানের এখন আর কথাই শোনা যায় না। মুসলিম জাতি সম্পূর্ণ পরকালমুখী, স্বল্প স্থায়ী ইহকালে টিকে থাকার কোনো বাসনা তাদের নেই, ডারউইনের ‘সারভাইভাল অব দ্য ফিটেস্ট’ তারা বিশ্বাস করে না, তাই সাধারণ মুসলমানদের অনুভূতির বাস্তবায়নে অলৌকিক শক্তির আবির্ভাব ও সহায়তা জরুরি।
আরব মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর আন্তরিকতার অভাবে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠন করা হামাস বা ফিলিস্তিনিদের পক্ষে সম্ভব হবে না, সম্ভব হবে যদি ইসরায়েল চায়। ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ইসরায়েলের স্বার্থেই অপরিহার্য; প্রতিষ্ঠিত না হলে ৭ অক্টোবর বারবার ঘটবে। এ কথাটি আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনও বলেছেন, তার অভিমত হচ্ছে, সামরিক শক্তি দিয়ে হামাসকে নিশ্চিহ্ন করা যাবে না এবং ইসরায়েলের নেতারা তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে।
লেখক: সাবেক নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক ও সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাকশাল।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে