Views Bangladesh Logo

মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতে হবে

Anwara  Azad

আনোয়ারা আজাদ

মেয়েদের চলাফেরা নিয়ে সবার মাথাব্যথা! মেয়েদের এভাবে চলতে হবে, ওভাবে চলতে হবে, এভাবে কাঁদতে হবে, ওভাবে হাসতে হবে, জোরে হাহা করে হাসা যাবে না আরও নানান কাহিনি! এ জন্যই ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট এপিজে আব্দুল কালাম বলেছিলেন, ‘মেয়েদের কীভাবে চলা উচিত এটা নিয়ে কিছু পুরুষ যতটা ভাবেন, তা কম ভেবে নিজের কীভাবে চলা উচিত সেটা নিয়ে যদি ভাবতেন তা হলে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান হয়ে যেত!’ এমনকি কখন মেয়েরা ঘুমাবে, কখন ঘুম থেকে ওঠা উচিত এসব নিয়েও সময় নষ্ট করে পুরুষ! যুগের হেরফের হলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এখনো পিনপিন করে এসবই বলতে চায় মানুষ। না, শুধু পুরুষ নয়, নারীরাও বলে থাকে! তাই তো শেষ পর্যন্ত সারারাত রাস্তায় দাঁড়িয়ে প্রতিবাদমুখর হতেই হলো। পুরো রাত দখল করার ঘোষণা দিতে হলো। শুধু কলকাতা বা ঢাকার রোকেয়া হলে প্রতিবাদ হলে হবে না, এই প্রতিবাদ হতে হবে সারা বিশ্বে। ঘন ঘন। একটি দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর প্রতিবাদী হয়ে লাভ নেই, সব সময়ের জন্যই সোচ্চার হতে হবে। নিয়ম করে মাসে অন্তত একটি রাত রাস্তা দখল করে নারীরা প্রতিবাদে সোচ্চার থাকুক। কারণ পুরো বিশ্বেই মেয়েরা নিরাপদ নয়।

উন্নত দেশেই হোক কিংবা অনুন্নত, মেয়েরা অনিরাপদ সবখানেই। ব্যাড টাচের শিকার হয়নি এমন মেয়ে সম্ভবত নেই। একদল মানুষরূপী পুরুষ হায়েনার মতো ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে, সুযোগের অপেক্ষায় থাকে। রাস্তায়, বাসে, কর্মক্ষেত্রে এমনকি নিজের বাড়িতেও সুরক্ষিত নয় নারী। পরিবারেই যৌন হয়রানির শিকার হয় অর্ধেক শিশু ও নারী। এই পৃথিবীতে নারী-পুরুষের চমৎকার রিলেশন থাকলেও আজ পর্যন্ত কোনো নারী নিজেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ ভাবতে পারেনি। ভয়ের আবরণ নিয়েই নারীকে নিজের অবস্থান শক্ত করতে হয়।

তাই যখন থেকে মোটামুটি কিছুটা বুঝতে শিখেছি, জোর গলায় বলতে শিখেছি, তখন থেকে যে কথার গুরুত্ব দিয়েছি সবচেয়ে বেশি, তা হলো জন্মের পর থেকেই মেয়েদের আত্মরক্ষার কৌশল শেখার অনুপ্রেরণা দেয়া। জানি, এটাই সমাধান নয়, তারপরও জোর গলায় সমর্থন করি। গ্রামের মেয়েদের সাঁতার শেখার মতো অপরিহার্য একটি বিষয় আত্মরক্ষার কৌশল শেখা। হ্যাঁ, এটিই মেয়েদের প্রথম শিক্ষা। ওড়না পরতে শেখার আগেই নিজেকে রক্ষা করার কৌশল রপ্ত করা। পিরিয়ড শুরু হওয়ার আগেই নিজেকে প্রটেক্টিভ হতে শেখা। বলা নেই, কওয়া নেই, বাচ্চা একটি মেয়ে হঠাৎ করেই যেন প্রেগন্যান্ট হয়ে না যায়, সেসব প্রতিরোধ করতে শেখা। ভুক্তভোগী মেয়েরা সারাজীবন ট্রমার মধ্যে কাটায়। স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে না পারার কারণে তাদের বিহেভ প্যাটার্নেও অসামঞ্জস্যতা দেখা যায়। আত্মরক্ষার কৌশল শেখার গুরুত্ব এ কারণেই। আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রতিপক্ষকে অন্তত বুঝিয়ে দিতে হবে যে, মোটেই দুর্বল কেউ নয় সে। কারণ মেয়েরা দুর্বল, এই কনসেপ্ট নিয়েই পুরুষ বেড়ে ওঠে। আর প্রতিদিন নতুন নতুন নারী নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই।

১৯৯৫ সালের ২৩ আগস্ট রাতে ঢাকা থেকে ঠাকুরগাঁওগামী ছেড়ে যাওয়া একটি বাসে চড়েছিল ইয়াসমিন আক্তার নামে ১৬ বছরের এক কিশোরী। মেয়েটি ধানমন্ডির এক বাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ করত। দিনাজপুরের দশমাইল মোড় এলাকায় পৌঁছে সে অন্য গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছিল। ঠিক তখনই সেখানে টহলরত পুলিশের একটি ভ্যান উপস্থিত হলে স্থানীয় ব্যক্তিরা ইয়াসমিনকে পরামর্শ দেয় পুলিশের গাড়িতে দিনাজপুর শহরে যেতে। কারণ তার গন্তব্যস্থল ছিল দিনাজপুর। প্রথমে মেয়েটি পুলিশের ভ্যানে যেতে রাজি না হলেও জায়গাটি নিরাপদ ছিল না বিধায় শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও রাজি হয়েছিল। পুলিশের ভ্যানে একজন এএসআই এবং দুজন কনস্টেবল ছিল। স্থানীয়রা ভেবেছিলেন পুলিশের গাড়িতে মেয়েটি নিরাপদেই বাড়ি পৌঁছাবে। এর পরদিন সকালে কিশোরীর মৃতদেহ পাওয়া যায় গোবিন্দপুর নামক জায়গায়।

মৃতদেহ পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে ক্ষোভে-বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দিনাজপুর। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিস ও স্থাপনায় ভাঙচুর করা হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে দিনাজপুর শহরে কারফিউ জারি করা হয়। একপর্যায়ে ঘটনার দুদিন পর এলাকাবাসী কোতোয়ালি থানা আক্রমণ করে সারারাত থানা অবরুদ্ধ করে রাখে। মানুষের বিক্ষোভকে কেন্দ্র করে দিনাজপুরের প্রশাসন কার্যত অচল হয়ে পড়েছিল। ইয়াসমিন আক্তারের গায়েবানা জানাজায় হাজার হাজার মানুষ অংশ নিয়েছিল। বিক্ষোভে দিনাজপুর শহরে কর্মরত সব পুলিশ একটা সময় গা-ঢাকা দিয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করেছিল। আজও দিনাজপুরের মানুষ বহুল আলোচিত ইয়াসমিন ধর্ষণের কথা স্মরণ করে। আর জি কর হাসপাতালের ঘটনাও মানুষ মনে রাখবে, ভুলবে না।

১০ জানুয়ারি ২০২০ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধর্ষণের ঘটনাও ছিল বহুল আলোচিত। সরকার সমর্থক ও বিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো প্রতিবাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নেমেছিল সেদিন।

নিরাপত্তাহীনতার কারণে কত মেয়ে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়ে ঘরে বসে থাকে পরিসংখ্যান কিন্তু নেই। কুমিল্লার সেনানিবাস এলাকায় সোহাগী জাহান তনুকে ধর্ষণের ঘটনার তদন্তসহ আরও বহু ধর্ষণের ঘটনার বিচার এ পর্যন্ত হয়নি। ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীদের আইনগত সহায়তা দেয় বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র। তাদের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা ছিল ১৪১৩টি যা তার আগের বছরের তুলনায় দ্বিগুণ। মানবাধিকারকর্মীরা মনে করেন, নানা প্রশ্ন ও সমস্যার প্রেক্ষাপটে ধর্ষণের অনেক মামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযুক্তকে চিহ্নিত করার পরও বিতর্ক হয় বলে সমাধান করা সমস্যা হয়ে যায়। আস্থার ব্যাপারটিও থাকে।

রাজধানীর খিলক্ষেতে স্বামীর সঙ্গে ঘুরতে গিয়ে এক নারী দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে থানায় অভিযোগ করলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত সাতজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। স্বামীর সঙ্গে থেকেও একটি মেয়ে নিরাপদ নয়, ভাবা যায়? কতজনের কথা স্মরণ করব!

কলকাতার আর জি কর হাসপাতালে ধর্ষণের ঘটনাটি জেনেই মন বিতৃষ্ণায় ভরে গেছে, ঘেন্না হচ্ছে। বিষয়টি তো শুধু কলকাতার নয়, সারা বিশ্বের। সভ্য সমাজের!

কী ভয়ংকর কথা! রাতের ডিউটি সেরে ৩৬ বছর বয়সী তরুণ ডাক্তার মৌমিতা আর জি কর হাসপাতালের সেমিনার কক্ষে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। পরদিন সেই সেমিনার কক্ষে মৌমিতার মৃতদেহ পাওয়া যায়। মাথার কাছে খোলা ল্যাপটপ, উল্টে পড়া পানির বোতল এবং অনাবৃত শরীরের নিম্নাংশ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মৌমিতার বাসায় মৌমিতা আত্মহত্যা করেছে বলে ফোন করে জানালেও পরিবার ও অন্যরা কেউ বিষয়টি মেনে নেয়নি। শুরু হয় প্রতিবাদের দানা বাঁধা। বিস্তার লাভ করে সেই প্রতিবাদ। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে প্রমাণিত হয় মৌমিতা গণধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

মৌমিতার এই মৃত্যু পৃথিবীর কোনো নারী মেনে নিতে পারবে না। আর সে কারণেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েরাও ‘রাত দখল’ করে তাদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে!

শোনেন, এভাবে মৃত্যুর ঘটনায় চিৎকার করতে ইচ্ছে হয়, ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে হয়, মুচড়ে দিতে ইচ্ছে হয়; কিন্তু ক্ষোভে নিজের হাত কামড়ানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারি না আমরা। যেসব মা এসব পশুর জন্ম দেন, তাদের বাঁদরগুলো বড় হতে হতে কত বড় নরখাদকে পরিণত হয়েছে, টেরও পান না। কজন নীতিগত শিক্ষা দেন ছেলেকে। মেয়েদের সম্মান করার কথা কজন শেখান ছেলেদের? যদি সম্মান করা শেখাতেন তা হলে প্রতিদিনের খবরে আমাদের এসব দেখতে হতো না। শেখানো তো দূরের কথা, উল্টো ধর্মের নামে, সামাজিকতার নামে মেয়েদের শৃঙ্খলিত করার যে প্রবণতা তাতে সম্মান করার মানসিকতা উধাও হয়ে যায়।

তাই মেয়েদেরই আত্মরক্ষার কৌশল রপ্ত করতে হবে। নিজেকে দুর্বল না ভেবে সবল হওয়ার শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি নিতে হবে শিশুকাল থেকেই। মায়েরা, মেয়েদের নিষেধের লিস্ট না ধরিয়ে সবল হতে সাহায্য করুন।

আনোয়ারা আজাদ: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ