Views Bangladesh Logo

বিলুপ্তির পথে কুটির শিল্পের গৌরব শীতল পাটি

প্লাস্টিক ও সস্তা বিকল্প পণ্যের চাপে হারিয়ে যাচ্ছে এক সময় ঘরে ঘরে চলা জনপ্রিয় কুটির শিল্প শীতল পাটি। হারাতে বসেছে এই শিল্পের ঐতিহ্য এবং ধীরে ধীরে বিদায় নিয়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন শিল্পী-কারিগররা।

বাংলার গ্রীষ্মকালীন ঐতিহ্যের প্রতীক এই পাটি শুধু আরামদায়কই নয়, শতবর্ষী সংস্কৃতিরও বাহক। আগেকার দিনে বিয়ে-শাদিতে শীতল পাটি না দিলে মনোমালিন্য দেখা দিতো। এক যুগ আগেও মেয়ের বিয়ের আগেই মায়েরা শীতল পাটি বানিয়ে তুলে রাখতেন সযত্নে। অনেকে আবার বিয়েতে দিতে হাঁস, মুরগি, ডিম বিক্রি করে কিনে আনতেন এই পাটি।

সাংবাদিক মনির হোসেন বলেন, শহুরে জীবনের ব্যয়বহুল ব্যস্ততা, প্লাস্টিকের আধিক্য, সাধ্যের বাইরে দামের কারণে শীতল পাটির কদর এখন আর নেই বললেই চলে। এর সুবিধা সম্পর্কে জানে না নতুন প্রজন্মও। কেউ তো কিনছেনই না, আগ্রহও হারিয়েছেন অনেকে। অন্যপক্ষে কেউ কেউ ধুঁকে ধুঁকে ব্যবসা চালিয়ে নিলেও নিজেদের গুটিয়ে নিচ্ছেন বেশিরভাগ শিল্পীই। ফলে বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে হাজার বছরের শিল্পটি।

চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ঐতিহাসিক জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে বসা এবারের মেলায় শীতল পাটি নিয়ে এসেছিলেন মাত্র ৩০ জন বিক্রেতা। তবে তাদেরকে আগের বছরের চেয়েও বেশি লোকসানে পড়তে হয়েছে। তিনদিনের মেলায় অন্য ব্যবসা জমলেও জমেনি শীতল পাটির ব্যবসা। কোনোমতেই গাড়ি, ভাড়া, খাওয়া দাওয়ার অর্ধেক খরচ তুলতে না পেরে চট্টগ্রাম ছেড়েছেন বেশিরভাগ শিল্পী।

একেকজন বিক্রেতা কমপক্ষে শতাধিক পাটি নিয়ে বাসে-ট্রেনে বরিশাল, ভোলা, সিলেট ও সিরাজগঞ্জ থেকে এসে লালদিঘির পাড়ে পসরা সাজিয়ে বসেন বিক্রির আশায়। কিন্তু বিক্রি এতোটাই কম হয়েছে যে, হোটেলে থাকা-খাওয়ার টাকাও শোধ করতে পারেননি। মনের দুঃখে এ পেশা ছাড়ার কথাও জানিয়েছেন অনেকে।

ভোলা থেকে আসা শাহ আলম বলেন, শীতল পাটি তৈরিতে কয়েক পর্বের কাজ থাকে। কয়েকজনের হাত ঘুরে পাটিগুলো বাজারে আসে। শীতল পাটির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তুলতুলে নরম থাকবে, ফিনিশিং হবে অন্যরকম, চিকন ভাঁজে ছোট করে ফেলা যাবে। এতে ঘুমাতেও তাই অনেক আরাম।

বরিশালের গণেশ দত্ত জানান, ৩৫ শতাংশ জমিতে পাটির কাঁচামাল বেত গাছের চাষ করেছেন তিনি। তিনজন কর্মীর শ্রমে এক একটি ছোট আকারের পাটি তৈরিতে খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার ২০০ টাকা, মাঝারিগুলোতে দেড় হাজার থেকে দুই হাজার টাকা আর বড়গুলোতে আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার টাকা। অথচ ক্রেতারা সেই দামে কিনতে নারাজ। দুদিনে তার বিক্রি ২০ হাজার টাকাও ছাড়ায়নি, যেখানে মেলায় অংশ নিতেই খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকারও বেশি।

গণেশ বলেন, বেতের ক্ষেতে কঠোর পরিশ্রমে ঘাম ঝরান গৃহস্থ পুরুষেরা। আর সারাদিনই পাটিগুলো বানানোর কাজ করেন নারীরা। অথচ লাভবান হতে পারেন না। একেক জন শ্রমিককে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি দেয়া হলেও তাদেরও সংসার চলে না। আবার এর বেশি মজুরি দিলে মালিকেরও লোকসান বেশি হয়।

সিলেটের কালাচান দাস বলেন, ‘আমাদের অঞ্চলের শীতল পাটিই সবচেয়ে বিখ্যাত। শীতল পাটির আলাদা পল্লীও রয়েছে। অন্তত শতাধিক পরিবার শীতল পাটি বুননে জড়িত, যারা কেবল এ থেকেই রোজগার করে সংসার চালান’।

তিনি বলেন, ‘পাহাড়ি জঙ্গলে বেতের চাষ করি। প্রথমবার গাছ লাগানোর পর বড় হতে তিন বছর লাগে। প্রথম পর্যায়ে (নতুন করে লাগালে) তিন বছরে আমরা একবার বেত কেটে নিয়ে আসি। এরপর থেকে প্রতি বছর বেত কাটা যায়। বেতগুলো পানিতে ভিজিয়ে গরম পানিতে সিদ্ধ করা হয়। তারপর এগুলোকে চেঁচেঁ চিকন আঁশ বের করা হয়। সবশেষে শৈল্পিক রূপ দিয়ে নানা ডিজাইনের শীতল পাটি বানানো হয়’।

তিনি আরও বলেন, ‘শীতল পাটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র, হাঁস মোরগ, গরু, ছাগল, ভেড়া, ঘোড়া সবকিছুই আঁকতে পারি। তবে আজকাল এসবের কদর কেউ করছেন না। মজুরি খরচও উঠে আসছে না। চিন্তা-ভাবনা করছি, ছেড়ে দেব। কিন্তু বংশ পরম্পরায় এই শিল্পকে লালন আর ছোটবেলা থেকে শীতল পাটি তৈরি করে আসছি। তাই এ শিল্পে মায়া বসে গেছে’।

প্রায় সব কারিগর-শিল্পীই অভিন্ন ভাষায় বলেন, ‘আর কখনও আসব না। এবার নিজের হাতেই এ পেশার সমাপ্তি টানছি। আমাদের সন্তানেরাও এতে যুক্ত হতে চায় না’।


মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ