সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার
বার্তাকক্ষে গোলাম সারওয়ার
সম্পাদক গোলাম সারওয়ার জীবনের সবচেয়ে বেশি সময় কাটিয়েছেন সংবাদপত্রের বার্তাকক্ষে। দৈনিক সমকালে দীর্ঘ ৮ বছর এই অসাধারণ মানুষটির সান্নিধ্যে কাজ করার সময় তার যে যাপিত জীবন দেখেছি, সেখানে দিনের বেশির ভাগ সময় তিনি বার্তাকক্ষেই পার করতেন। সর্বশেষ অসুস্থও হয়ে পড়েন তার প্রিয় বার্তাকক্ষেই। সেই অসুস্থতা থেকে আর ফিরে আসেননি আমাদের মাঝে।
সকালে ঠিক ১১টায় তিনি অফিসে আসতেন। সম্পাদক হিসেবে তার নিজের যে অফিসকক্ষ ছিল, সেখানে বসতেন। নির্বাহী সম্পাদক, উপ-সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদক, ফিচার সম্পাদকসহ বার্তাকক্ষের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে বৈঠক করতেন। মূলত ওইদিন প্রধান শিরোনামে কোন রিপোর্ট যাবে, দ্বিতীয়, তৃতীয় শিরোনাম কী হবে, বিশেষ রিপোর্ট কয়টি জমা পড়েছে, রিপোর্টিং ইভেন্টে গুরুত্বপূর্ণ কিছু আছে কি না, ঢাকার বাইরে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী খবর এসেছে, এসব বিষয় নিয়ে নিবিড় আলোচনা করতেন। প্রথম পাতা, শেষ পাতা, তৃতীয় পাতাসহ খবরের পাতাগুলোর গোছানো একটা পরিকল্পনা করতেন। এরপর সম্পাদকীয় কী হবে, উপ-সম্পাদকীয় কি যাচ্ছে, ফিচার পাতার আধেয় কি নির্বাচিত হয়েছে, সেসব নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা করে চূড়ান্ত করতেন। পরের কিছুটা সময় বিজ্ঞাপন, সার্কুলেশন বিভাগের প্রধানদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। সবশেষে প্রশাসনিক কোনো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয় নিয়ে প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে আলোচনা করতেন।
সবকিছু শেষ করতেন দুপুর ১টার মধ্যে। এরপর অফিস থেকে বের হতেন। বেশিরভাগ দিনেই তার গন্তব্য ছিল জাতীয় প্রেস ক্লাব। নিজের কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ থাকলেও সেটার জন্য সেই দুপুর ১টার পরই বের হতেন। সকাল ১১টা থেকে ১টা পর্যন্ত তিনি অফিসে আসেননি, এমন ঘটনা হাতে গোনা দু-এক দিন হতে পারে। এমনকি বিদেশ গেলেও, ওই দেশের সঙ্গে সময়ের যত ব্যবধানই থাকুক, সকাল ১১টার সময় তার ফোন পেতেন নির্বাহী সম্পাদক, বার্তা সম্পাদক কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্যরা।
বিকেল ৪টায় অফিসে ফিরতেন সারওয়ার ভাই। ফিরেই কিছুক্ষণ একান্তে সময় কাটাতেন নিজের কক্ষে। সে সময়টার দৈর্ঘ্য ১০ থেকে ১৫ মিনিটের বেশি হতো না। এরপর বিশেষ রিপোর্টগুলো নিয়ে ডাকতেন বার্তা সম্পাদক, প্রধান প্রতিবেদকসহ অন্যদের। খুব গুরুত্বপূর্ণ রিপোর্ট হলে তিনি নিজেই সম্পাদনার দায়িত্ব নিতেন। বাকিগুলো অন্যদের মাঝে ভাগ করে দিতেন। ঠিক সন্ধ্যা ৬টায় ঢুকতেন বার্তাকক্ষে। এখানে তার নিজের একটা ওয়ার্কিং ডেস্ক ছিল। সম্পাদক গোলাম সারওয়ার সেখানে চেয়ারে বসার পর বার্তাকক্ষের অন্যরা যিনি যে প্রান্তেই থাকেন না কেন, সতর্ক হয়ে যেতেন। প্রথম কয়েক মিনিট পুরো বার্তাকক্ষে যেন পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। মোটামুটি যে যার চেয়ারে কর্মমুখর হয়ে যেতেন। কান সজাগ থাকত, যে কোনো সময় ডাক আসতে পারে সম্পাদকের। সকালে যে সম্পাদককে বেশ ফুরফুরে মেজাজে দেখা যেত, বার্তাকক্ষে তার অবয়ব গম্ভীর হয়ে উঠত। কারও কোনো ভুল কিংবা গাফিলতি পেলে মুহূর্তেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে পারেন সম্পাদক। যে কারণে সারওয়ার ভাই বার্তাকক্ষে এলে বাকিদের সবার চোখেমুখেও বেশ সিরিয়াস একটা ভাব দেখা যেত। বার্তাকক্ষে যতক্ষণ থাকতেন, সারওয়ার ভাই খবর-সংক্রান্ত বিষয়ের বাইরে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেন না। যদি খবরের বাইরে অন্য কোনো জরুরি বিষয় থাকত, তাহলে ব্যক্তিগত কক্ষে চলে যেতেন।
বার্তাকক্ষে ঢুকে সারওয়ার ভাই ইভেন্ট রিপোর্টগুলোর দিকে মনযোগ দিতেন। প্রতিটি রিপোর্ট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতেন। যদি কোনো ইভেন্ট রিপোর্ট খুব বেশি পছন্দ হতো কিংবা গুরুত্বপূর্ণ মনে করতেন, সেটা তিনি নিজেই যত্ন নিয়ে সম্পাদনা করতেন। এমন অনেক দিন গেছে, যেদিন সকালের বৈঠকে নির্ধারণ করা লিড রিপোর্ট বদলে দিয়েছেন বার্তাকক্ষের চেয়ারে বসে। আসলে সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বার্তাকক্ষেই প্রতিদিন নতুন প্রাণে জেগে উঠতেন। আর সে কারণেই সুদীর্ঘ পেশাগত জীবনে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এ বার্তাকক্ষের চেয়ারে বসেই। এ চেয়ারে বসেই দিনের গুরুত্বপূর্ণ ছবিগুলো নির্বাচিত করতেন প্রকাশের জন্য, কোনো রিপোর্টের জন্য গ্রাফিক্স প্রয়োজন হলে নিজেই তার থিম চূড়ান্ত করতেন।
রাত সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে সারওয়ার ভাই মেকআপ রুমে চলে যেতেন। তার সঙ্গে বার্তা সম্পাদকও চলে আসতেন। এ রুমেই কম্পিউটারে সারওয়ার ভাইয়ের নির্দেশনায় দিনের পত্রিকাটি নিজস্ব চেহারায় জীবন্ত হয়ে উঠত। মেকআপ রুমে সারওয়ার ভাই আরও বেশি সিরিয়াস। কোন রিপোর্ট কোথায় বসবে, কোন ছবি কীভাবে কোন পাতায় বসবে, সবকিছুই তিনি ঠিক করতেন। যদি শেষ মুহূর্তে নতুন কোনো খবর আসত, এ রুমে বসেই তিনি সেগুলো সম্পাদনা করতেন। এ রুমে তার সঙ্গে যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, অতিরিক্ত বার্তা সম্পাদক কিংবা সিনিয়র সাব-এডিটরও থাকতেন। শেষ মুহূর্তের খবর যেগুলো অবশ্যই সেদিনের পত্রিকায় প্রকাশ হবে, সেগুলো তিনি নিজে কিংবা বার্তাকক্ষের দায়িত্বশীলদের দিয়েই সম্পাদনা করাতেন। বেশিরভাগ সময় মেকআপ রুমে তার সামনে বসেই সম্পাদনা করতে হতো। যদি কোনো রিপোর্টের জন্য সংশ্লিষ্ট রিপোর্টারকে প্রয়োজন হতো, তাকেও মেকআপ রুমে ডেকেই নির্দেশনা দিতেন।
পত্রিকার প্রথম সংস্করণের মেকআপ চূড়ান্ত করে ছাপাখানায় পাঠানো হতো ১১টার দিকে। এরপর সারওয়ার ভাই মেকআপ রুম থেকে বের হয়ে ব্যক্তিগত কক্ষে যেতেন। খুব বেশি হলে দশ মিনিট তারপরই বের হতেন, বার্তাকক্ষে ফিরে আসতেন। এবার দ্বিতীয় সংস্করণ চূড়ান্ত করার পালা। সেটা চূড়ান্ত করতে করতে রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বেজে যেত। এর মধ্যে হঠাৎ কোনো নতুন গুরুত্বপূর্ণ খবর এলে পরিস্থিতি বদলে যেত। সেই রিপোর্ট রিপোর্টার কিংবা সাব-এডিটর লেখার পর নিজে একবার সম্পাদনা করতেন। তারপর প্রথম সংস্কণের মেকআপ কোথায় কতটা বদল করতে হবে, সেটা নির্ধারণ করে দিয়ে তারপর অফিস থেকে বের হতেন। এই কাজ শেষ করতে যদি রাত তিনটাও বেজে যায়, সারওয়ার ভাই শেষ না করে বের হতেন না কখনো।
যেসব দিনে খুব বেশি বড় ইভেন্ট হতো, সারওয়ার ভাই সারা রাতই অফিসে থাকতেন। যেমন ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিসান রেস্তোরাঁয় ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার রাতে সারওয়ার ভাইসহ আমরা সবাই বার্তাকক্ষে। ঘটনাস্থলে থাকা রিপোর্টার রিপোর্ট পাঠাচ্ছেন, আপডেট দিচ্ছেন, আমার ওপর দায়িত্ব, সেগুলো সমন্বয় করা। রাত দুইটা পর্যন্ত প্রায় টানা দশ থেকে বারোটা রিপোর্ট সম্পন্ন হলো। এরপর আমি সারওয়ার ভাইকে এক ফাঁকে বললাম, দ্বিতীয় সংস্করণ তো রেডি হয়ে গেছে, এখন কি আর থাকব। সারওয়ার ভাই কড়া চোখে একবার আমার দিকে তাকালেন। আমি দ্বিতীয় আর কোনো শব্দ উচ্চারণ করলাম না। বুঝে গেলাম, থাকতে হবে। পরের দিন সকাল ৭টায় সারওয়ার ভাইয়ের গাড়িতে তার পাশে বসেই বাসায় রওনা হলাম। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি। ঘুম ভাঙল সারওয়ার ভাইয়ের ফোনেই। দেখি সকাল সোয়া দশটা। সারওয়ার ভাই বললেন, তিনি অফিসে রওনা হয়েছেন। আমি যেন বারোটার মধ্যে অবশ্যই অফিসে আসি। একটি-দুটি ঘটনা নয়, খবরের জন্য গুরুত্বপূর্ণ দিনগুলোতে দেখেছি, সারওয়ার ভাইয়ের মধ্যে অসম্ভব এক প্রাণশক্তি ভর করত। তিনি সবকিছু ভুলে যেতেন। খবর আরও কত সমৃদ্ধ করে পাঠকের কাছে পৌঁছানো যায়, সেই চিন্তায় নিমগ্ন থাকতেন, অস্থির হয়ে উঠতেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারে রানা প্লাজা বিধ্বস্ত হলো। সারওয়ার ভাই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে ফোন করলেন, যত দ্রুত সম্ভব সাভারে যেতে বললেন। ব্যস্ত জনপদে মুহূর্তেই সৃষ্টি হওয়া সেই অবিশ্বাস্য ধ্বংসস্তূপ, করুণ আর্তনাদের দিন পার করে রাত বারোটায় বাসার দিকে রওনা দেব ঠিক করলাম। আমার সঙ্গে সহকর্মী শাহাদাত হোসেন পরশ। সারওয়ার ভাইকে ফোন করলাম। তিনি বললেন, পরশকে ওখানেই থাকতে বলো, তুমি সোজা অফিসে চলে আস। অফিসে পৌঁছলাম রাত দুইটার দিকে। সারওয়ার ভাই বার্তা কক্ষে তার টেবিলে বসে গভীর মনযোগ দিয়ে কোনো একটা রিপোর্ট সম্পাদনা করছেন। আমার কাছে জানতে চাইলেন, আর কোনো আপডেট রিপোর্ট দেয়ার আছে কি না, আমি সর্বশেষ পরিস্থিতি জানালাম। সারওয়ার ভাই পরশকেও ফোন করলেন। ফোন রেখে সারওয়ার ভাই দুই হাতে মুখ ঢেকে কয়েক সেকেন্ড কিছু একটা ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘উদ্ধার কাজ শেষ করতে কয় দিন লাগবে? কোনো আইডিয়া পেয়েছো, কারও সঙ্গে কথা বলেছ?’ ‘আমি বললাম, আমি ফায়ার সার্ভিসের সঙ্গে কথা বলেছি। ঢাকার ডিসির সঙ্গে কথা বলেছি। তারা বলেছেন, এক সপ্তাহ লাগতে পারে। সারওয়ার ভাইয়ের চোখ বড় হয়ে গেল। তোমার ২০০৫ সালের স্পেকট্রাম ভবন ধসের কথা মনে আছে। সেখানেই তো প্রায় দশ দিন লেগেছে। রানা প্লাজার ঘটনা তো আরও বড়, তাই না? তাহলে দুই সপ্তাহের কমে কোনোভাবেই হওয়ার কথা না।’ সারওয়ার ভাইয়ের কথাই ঠিক হয়েছিল। রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজ শেষ হতে টানা ১৮ দিন লেগেছিল। এই ১৮ দিন সারওয়ার ভাই রাত তিনটার আগে বার্তাকক্ষ থেকে বের হননি।
সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে কাজের এমন স্মৃতি অনেক। আজ যখন ক্লিকবেট সাংবাদিকতার অনাচার চারদিকে, যখন সংবাদ মাধ্যমের আয়নায় মানুষের প্রকৃত জীবনচিত্রের বদলে কোনো নায়ক-নায়িকার ঘরের ভেতরে খুব সাধারণ ঝগড়ার খবর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, যখন সাংবাদিকের চোখ কেবলই ওপর তলার মানুষের হাজার কোটি টাকার বিয়ের খবরে আটকে থাকে, যখন কুসংস্কারকে উসকে দেয়া অপতথ্য তথাকথিত প্রথম শ্রেণির সংবাদ মাধ্যমে বড় শিরোনামে ছাপা হয়, তখনই সম্পাদক গোলাম সারওয়ারের অভাবটা একজন পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে খুব বেশি অনুভূত হয়। গোলাম সারওয়ার ‘সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলতে শিখিয়েছেন’। সংবাদ মাধ্যমে সত্যিকারের পেশাদারিত্ব টিকিয়ে রাখতে বার্তাকক্ষে গোলাম সারওয়ারের মতো দৃঢ় ব্যক্তিত্বের খুবই প্রয়োজন। সাংবাদিকতায় গোলাম সারওয়ারকে নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার, তিনিই বাতিঘর হয়ে সংবাদ মাধ্যমকে স্বমর্যাদায় পথ দেখাতে পারেন, আজ এবং আগামী দিনেও।
লেখক: সাংবাদিক ও টেলিযোগাযোগ-তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিশ্লেষক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে