সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার
গোলাম সারওয়ার ছিলেন আপসহীন সাংবাদিক ও সম্পাদক
বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগতে সবাই যাকে শিক্ষাগুরু হিসেবে মান্য করেন, তিনি সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার। এই গুণী সাংবাদিকের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট তিনি আমাদের ছেড়ে চিরবিদায় নিয়েছেন। তার ৮১তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’ আয়োজন করেছে ‘গোলাম সারওয়ার সংখ্যা’। এই গুণী সাংবাদিকের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন নিয়ে ‘ভিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক রাশেদ মেহেদী কথা বলেছেন গোলাম সারওয়ারের জামাতা মিয়া নাঈম হাবিবের সঙ্গে। তিনি যুগান্তর এবং সমকাল দুটি পত্রিকারই প্রতিষ্ঠার সময় শ্বশুর গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমাদের সাংবাদিকতার শিক্ষাগুরু গোলাম সারওয়ার দীর্ঘদিন ‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক ছিলেন। সম্ভবত, এত দীর্ঘ সময় একটি পত্রিকায় কেউ বার্তা সম্পাদক ছিলেন না। তারপর তিনি ‘দৈনিক যুগান্তর’ পত্রিকা প্রকাশ করলেন, সেই পত্রিকার সম্পাদক হলেন। সম্পাদক হিসেবে তার নতুন অধ্যায় শুরু হলো এবং তিনি সফল হলেন। তখন ‘যুগান্তর’-এর সার্কুলেশন খুব ভালো ছিল, প্রথম আলোকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর তার সম্পাদনায় যাত্রা শুরু করল আরও একটি জাতীয় দৈনিক ‘সমকাল’। এই যে বার্তা সম্পাদক থেকে সম্পাদক হিসেবে সাফল্যমণ্ডিত উজ্জ্বল অধ্যায়, এ বিষয়ে জানতে চাই।
মিয়া নাঈম হাবিব: আমি পারিবারিক জায়গা থেকে বলি, বার্তা সম্পাদক থেকে সম্পাদক হয়ে তিনি কতটা সফল হবেন আমার ধারণা ছিল না। তিনি যখন ‘ইত্তেফাক’-এ ছিলেন, তখন ওই পত্রিকার মালিক পক্ষের দুই ভাইয়ের দ্বন্দ্বের জন্য ওখানে কাজের পরিবেশ নিয়ে তিনি চিন্তিত ছিলেন, সাংবাদিকতার পেশাদারিত্ব অক্ষুণ্ন রেখে আদৌ ইত্তেফাক-এ কাজ করতে পারবেন কি না। আমি যতটুকু জানি, তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদের কাছে গিয়েছিলেন যমুনা গ্রুপের কর্ণধার নুরুল ইসলাম বাবুল। তোফায়েল আহমেদকে বাবুল সাহেব জানিয়েছিলেন, তিনি একটা পত্রিকা করতে চান। তখন তোফায়েল সাহেব বাবুল সাহেবকে বলেছিলেন, ‘তুমি যদি ‘ইত্তেফাক’-এর বার্তা সম্পাদক গোলাম সারওয়ার ভাইকে নিতে পারো, তাহলে খুব ভালো হবে। ‘ইত্তেফাক’-এর বিশিষ্ট সাংবাদিক শাহজাহান সরদার তখন ওখানে ছিলেন। তিনি গোলাম সারওয়ারকে ফোন করে জানালেন, যমুনা গ্রুপের বাবুল সাহের পত্রিকা করবেন। ওনারা চান আপনি সম্পাদক হিসেবে এই পত্রিকার দায়িত্ব নেন। গোলাম সারওয়ার জানালেন কিছু চেক-আপ করাতে তাকে আমেরিকা যেতে হবে। তার ফ্যামিলির সবাই আমেরিকা থাকে। তাদের সঙ্গে কথা বলে তিনি জানাবেন। তারপর তিনি আমেরিকা চলে গেলেন। একদিন বাসার সবাইকে ডেকে বললেন, আমি ‘ইত্তেফাক’ ছেড়ে দিয়ে সম্পাদক হিসেবে নতুন পত্রিকায় যোগদান করতে চাই, তোমরা কী বলো? আমরা কেউ রাজি হলাম না। ‘ইত্তেফাক’ এত বড় একটা পত্রিকা, আর সেখানে তিনি দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন।
শুধু ওনার মেয়ে রত্না বললেন, আব্বা, ‘দিস ইজ ইউর সেকেন্ড লাইফ। আমার মনে হয় তুমি যেটাতে হাত দিবা সেটাই ভালো হবে, তোমার যদি ইচ্ছে হয় তুমি নতুন পত্রিকা করতে পারো।’ মেয়ের সমর্থন পেতেই তিনি সিদ্ধান্ত জানালেন, নতুন পত্রিকা করবেন।
তখনকার একটা মজার গল্প আছে, গল্পটা সবাইকে বলতেই হয়। তিনি তার নাতিকে ডেকে বললেন, কাগজ-কলম নিয়ে আসো, আর একটা মগ নিয়ে আসো। তারপর তিনি কাগজে কিছু পত্রিকার নাম লিখলেন, নামগুলো ফোল্ড করে মগের মধ্যে রেখে তার মেয়েকে বললেন, তুমি একটা কাগজ তোলো। একটা কাগজ তোলা হলো। দেখা গেল সেটাতে লেখা- ‘যুগান্তর’! তিনি বললেন, আমার পত্রিকার নাম হবে ‘দৈনিক যুগান্তর’। তারপর আমাকে ডায়েরি বের করতে বললেন। তোফায়েল আহমেদকে ফোন করে কথা বলতে বললেন। তোফায়েল আহমেদ তাকে বললেন, সারওয়ার ভাই আপনি আসেন, ‘ইত্তেফাক’ ছেড়ে দিচ্ছেন, গুড নিউজ। আপনি নতুন পত্রিকা করেন, দোয়া রইল। পত্রিকা বের হওয়ার পরে আপনার সঙ্গে আবার কথা হবে।
তারপর তিনি ঢাকায় চলে এলেন, আমাকে বলে আসলেন, তুমি দেশে চলে আসো, আমাকে কিছু কাজে হেল্প করো। তিনি দেশে আসার দুই মাস পরে আমি ঢাকায় এলাম। এসে দেখি তিনি ‘ইত্তেফাক’ ছেড়ে দিয়েছেন। ক্যাম্প অফিস করছেন রাজমণি ঈশা খাঁয়। তখন তিনি লোকজন হায়ার করছেন নানা জায়গা থেকে। তার সঙ্গে আমার যাত্রা শুরু সেখান থেকে। নির্দিষ্ট সময় ‘যুগান্তর’ প্রকাশ হলো। ১৩-১৪ মাসের মাথায় ‘যুগান্তর’ উঠে গেল প্রচার সংখ্যার শীর্ষে ।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা জানি যুগান্তরের বার্তা সম্পাদকের পদটি দীর্ঘদিন ফাঁকা ছিল, সেই জায়গাটা তিনি কীভাবে পূরণ করলেন?
মিয়া নাঈম হাবিব: যুগান্তর-এর জন্য তখন অলমোস্ট ৯০ ভাগ লোক নেয়া হয়ে গেছে; কিন্তু বার্তা সম্পাদকের পদটি খালি। তিনি একজনকে খুব পছন্দ করতেন, ওনার খুব ইচ্ছে ছিল, মনজুরুল আহসান বুলবুল ওনার পত্রিকার বার্তা সম্পাদক হবেন। তিনি আমাকে বললেন, বুলবুলের সঙ্গে তো তোমার দেখা হয়, ওকে একটু বলো। ও যেন যুগান্তরে চলে আসে। পদটা আমি খালি রেখেছি ওর জন্য। আমি বুলবুল ভাইকে বললাম, আপনার গুরু তো আপনার জন্য পদ খালি রেখে বসে আছেন। বুলবুল ভাই বললেন, আমি একটু ময়মনসিংহ যাব, মায়ের সঙ্গে কথা বলব, এসেই আমি সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করব। দুদিন পরেই তিনি ময়মনসিংহ থেকে এসে গোলাম সারওয়ারের সঙ্গে দেখা করলেন। বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন যুগান্তরে।
‘দৈনিক যুগান্তর’ সম্ভবত ২০০০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যাত্রা শুরু করল। যেদিন ডামি বের হবে, আমাকে বলছিলেন, ওই সময় ডামি বের হবে, তুমি আসবে। খেয়াল ছিল না বলে আমি সেদিন আসতে পারিনি। তিনি আমাকে কল দিচ্ছেন, তুমি না আসা পর্যন্ত আমরা ডামি খুলব না। ওখানে বাবুল সাহেব, বাবুল সাহেবের স্ত্রী সালমা ইসলাম সবাই দাঁড়িয়ে আছেন। ডামি কেউ ওপেন করেন না। আমি যাওয়ার পরে গোলাম সারওয়ার ডামি ওপেন করলেন। এটা আমার জীবনে অনন্য ঘটনা।
ভিউজ বাংলাদেশ: সেই ‘যুগান্তর’ আবার সারওয়ার ভাই ছেড়েছিলেন, ছাড়লেন কেন?
মিয়া নাঈম হাবিব: তিনি চেয়েছিলেন, যুগান্তর পত্রিকা হবে পাঠকের জন্য এবং সত্য প্রকাশে অবিচল থাকবে। এটার সঙ্গে তিনি কখনোই কোনো আপস করতেন না। পরিবার, দল, মত কারও সঙ্গেই না। সাংবাদিকতায় পেশাদারিত্ব বজায় রাখতেন। তিন বছর তিনি যুগান্তরকে পেশাদারিত্বের সঙ্গে চালাতে পেরেছিলেন। যুগান্তরের মালিক বাবুল সাহেব তার কিছু ব্যবসায়িক এবং ব্যক্তিগত ইস্যু পত্রিকায় প্রকাশ করতে চাইতেন। গোলাম সারওয়ারের কাছে এটা ছিল সাংঘাতিক অগ্রহণযোগ্য। এটা নিয়েই ওনার মনের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেল। একটা সময় যখন তিনি আর পারছিলেন না, তখন চিন্তা করলেন, না, এই পত্রিকায় থাকবেন না। নতুন কিছু চিন্তা করবেন। এভাবেই ‘যুগান্তর’ ছেড়ে দিলেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: ‘দৈনিক সমকাল’-এর ব্যাপারে কীভাবে আগ্রহী হলেন?
মিয়া নাঈম হাবিব: মিডিয়ার অনেকেই জেনে গিয়েছিলেন যে গোলাম সারওয়ার ‘যুগান্তর’ ছেড়ে দিচ্ছেন। অনেকই তার সঙ্গে বিনিয়োগ করার জন্য উৎসাহ দেখালেন। তার সঙ্গে এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তখন আমি কিছুটা পরিচিত হয়ে গেছি ওনার মেয়েজামাই হিসেবে। তখন ইত্তেফাকের এক সাংবাদিক ছিলেন ফারাজী আজমল হোসেন। তিনি একদিন আমাকে ফোন করে বললেন, আপনি একটু প্রেস ক্লাবে আসেন, আপনার সঙ্গে একটু কথা আছে। প্রেস ক্লাবে গেলে আমাকে বললেন, এক ভদ্রলোক আছেন, এ. কে. আজাদ, তিনি হামীম গ্রুপের কর্ণধার, তিনি একটা পত্রিকা করতে চাচ্ছেন। সারওয়ার ভাইকে বলেন এ বিষয়ে চিন্তা করতে। এ. কে. আজাদ তখন এত পরিচিত ছিলেন না। তারপর আমি আব্বাকে (গোলাম সারওয়ার) বললাম, চলেন আমরা আজাদ সাহেবের সঙ্গে কথা বলে দেখি। আপনার যদি পছন্দ হয় তাহলে করবেন, পছন্দ না হলে করবেন না। না করে দেবেন। তারপর আমরা এ. কে. আজাদ সাহেবের বাসায় গেলাম, কথাবার্তা বললাম। দুজনের মধ্যে সমঝোতা হলো। তারপরে সমকালের যাত্রা শুরু হলো। ডিক্লারেশন পাওয়া নিয়ে শুরুতে অনেক বাধা-বিপত্তি ছিল। তবে গোলাম সারওয়ারের দৃঢ়তায় সে বাধা কাটতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
ভিউজ বাংলাদেশ: ডিক্লারেশনে কী ধরনের বাধা ছিল?
মিয়া নাঈম হাবিব: যমুনা গ্রুপের বাবুল সাহেব ভাবলেন, গোলাম সারওয়ার যদি পত্রিকা করেন তাহলে এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে যুগান্তরে। যুগান্তর অলরেডি দাঁড়িয়ে গেছে। গোলাম সারওয়ারের কারণেই এর এত জনপ্রিয়তা। এ জন্য সমকাল যেন ডিক্লারেশন না পায়, সে ব্যবস্থা করতে লাগলেন। যতভাবে পারেন ডিক্লারেশন আটকাতে লাগলেন। এ কারণে সমকাল-এর ডিক্লারেশন পেতে ৬ মাস দেরি হয়েছিল। তবে সমকালের প্রতিষ্ঠা ঠেকানো যায়নি। আমি নিজে প্রায় তিন মাস বাংলাদেশের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে, উপজেলায়, এমন কী ইউনিয়নে সফর করেছি। প্রচুর মিটিং করেছি। শেষ পর্যন্ত গোলাম সারওয়ারের সম্পাদনায় সমকাল অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস নিয়ে মাথা উঁচু করেই দাঁড়িয়ে যায়।
ভিউজ বাংলাদেশ: ‘সমকাল’ নামটা কীভাবে এলো?
মিয়া নাঈম হাবিব: ‘সমকাল’ নামটা কীভাবে এলো আমি জানি না। গোলাম সারওয়ার নিজেই ‘সমকাল’ নামটা দিয়েছেন। ‘সম্ভবত অনেক আগে সমকাল’ নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা ছিল। নামটা সেখান থেকেই পেয়েছেন।
ভিউজ বাংলাদেশ: আমরা দেখেছি তিনি মাঝখানে কিছুদিন সমকালে ছিলেন না, এর কারণ কী?
মিয়া নাঈম হাবিব: এটা ছিল প্রাইস নিয়ে। তখন বাজারে নতুন চার-পাঁচটা পত্রিকা বেরিয়ে গেছে। গোলাম সারওয়ার তখন প্রকাশক এ. কে. আজাদ সাহেবকে বললেন, পত্রিকার দাম একটু কমাতে হবে; কিন্তু প্রকাশক এ. কে. আজাদ সাহেব বললেন, পত্রিকার দাম কমালে আমাদের অনেক লস গুনতে হবে। আমরা এই লস গুনতে পারব না। এটা নিয়ে ওনাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব হলো। আব্বা বললেন, আমি কাজ করব না। আব্বাকে আবার যুগান্তরে ডাকা হলো। বাবুল সাহেবের ছেলে এমডি শামিম আমাকে বললেন যুগান্তরের অবস্থা তো খারাপ, সারওয়ার সাহেবেকে একটু আসতে বলেন। আব্বা দুই বছরের জন্য আবার যুগান্তরে গেলেন। যুগান্তরে থাকতেই আবার আজাদ সাহেব বললেন, ‘আপনি সমকালে চলে আসেন, তা না হলে তো সমকাল শেষ।’ তখন তিনি আবার সমকালে চলে এলেন। সমকালে আসার পরও ওনাকে অনেকেই বলেছেন, নতুন পত্রিকা করার জন্য। তিনি রাজি হলেন না। তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, আর পত্রিকা করবেন না। এটাই শেষ। মনে পড়ে, তিনি সমকালে বসেই একদিন বলেছিলেন, আমার যেন মৃত্যু হয় এই বার্তাকক্ষেই।
ভিউজ বাংলাদেশ: ‘যুগান্তর’ এবং ‘সমকাল’ পত্রিকায় তিনি অনেক মানুষ নিয়োগ দিয়েছেন। সাংবাদিক, কর্মকর্তা-কর্মচারী নির্বাচনের ক্ষেত্রে তিনি কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিয়েছেন?
মিয়া নাঈম হাবিব: আমি সমকালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছিলাম এবং রিক্রুটমেন্ট টিমের মধ্যেও আমি ছিলাম। আমরা একই বাসায় থাকি, আমি ওনার মেয়েজামাই; কিন্তু আমার কোনো ব্যক্তিগত মতামত ওনাকে কখনো দিতাম না। কারণ আমি জানতাম, উনি এত বেশি প্রফেশনাল, একজন পিওন নেয়ার ক্ষেত্রেও যাচাই-বাছাই করতেন। একজন পিওনের কী কী পেশাদারি গুণ থাকতে হবে সেগুলো তীক্ষ্ণতার সঙ্গে নজর রাখতেন। সাংবাদিকদের বেলায়ও কেউ বললে বা আমি যদি বলতাম একে একটু দেখেন, তিনি দেখতেন; কিন্তু পছন্দ না হলে নিতেন না। তবে তিনি কাজের খুব মূল্যায়ন করতেন। যেমন যুগান্তরে কাজ করতেন মিজানুর রহমান খান। যুগান্তরের সহ-সম্পাদক ছিলেন। ওনার বেতন ছিল কম। উনি আমাকে একদিন বললেন, ‘আমি মনে হয় আর কাজ করতে পারছি না। আমি অস্ট্রেলিয়ান অ্যাম্বাসিতে একটা কাজ পেয়েছি, বেতনও ভালো; কিন্তু লজ্জায় সারওয়ার ভাইকে বলতে পারছি না।’
আমি আব্বাকে জানালাম। আব্বা বললেন, ‘আমাকে সাত দিন সময় দাও।’ আব্বা ওনাকে বিশেষ প্রতিনিধি পদন্নোতি দিয়ে বেতন বাড়িয়ে দিলেন। ওনাকে বিশেষ প্রতিনিধি করতে গিয়ে তখনকার বাস্তবতায় আরও দুজনকে বিশেষ প্রতিনিধি করতে হলো। কারণ ওই দুজন ছিলেন সিনিয়র। ওই দুজন সিনিয়র হলেও মিজানুর রহমান খানের মেধার কাছে কিছুই ছিলেন না। শুধুমাত্র মিজানুর রহমান খানকে রাখার জন্য ওই দুজনকে বিশেষ প্রতিনিধি করলেন। কারণ যুগান্তরে মিজানুর রহমান খানকে দরকার আছে। সমকালেও দেখছি এক তরুণ সাংবাদিক শাহাদাত হোসেন পরশকে বিশেষ প্রতিনিধি করলেন। আমি একদিন বাসায় বসে বলছিলাম, আব্বা পরশকে যে বিশেষ প্রতিনিধি করলেন, আরও দুই-এক বছর পরে করলেও পারতেন, আরও তো সিনিয়র কয়েকজন আছে। আব্বা আমাকে বললেন, ‘দেখো, সাংবাদিকতা এমন একটা বিষয়, যার জন্য বয়সের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পারদর্শিতা। সেটা আমি বুঝতে পারি; কিন্তু তুমি বুঝতে পারবা না। এত সিনিয়র লোক থাকতে আমাকে মাত্র ৩২ বছর বয়সে কীভাবে ইত্তেফাকের মতো পত্রিকার বার্তা সম্পাদক করা হলো! তাও দুই ভাইয়ের সমন্বয়ে। অতএব, এখানে বয়সের কোনো ব্যাপার নেই, এখানে বিবেচ্য বিষয় হলো সক্ষমতা।’
ভিউজ বাংলাদেশ: আর একটা বিষয় হলো, পত্রিকার মার্কেটিং। মধ্যবিত্তের একটা পাঠরুচি তৈরি করে সারওয়ার ভাইকে পত্রিকার মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে বরাবরই সফল হতে দেখেছি। সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
মিয়া নাঈম হাবিব: এখানে বলি, যুগান্তরে থাকতে আমার গাড়ি ছিল না। তিনি যখন অফিসে আসতেন তখন ওনার গাড়ি নিয়ে আমি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় যেতাম। আবার রাতের বেলা একসঙ্গে বাসায় আসতাম। একদিন ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, এত অল্প সময়ে যুগান্তর কীভাবে এতটা জনপ্রিয় করলেন? তিনি বললেন, ‘দেখো, যুগান্তর করার আগে একটা কথা আমার মাথায় ঘুরেছে, যেটা আমি চেষ্টা করেছিলাম ইত্তেফাকে; কিন্তু ইত্তেফাকে অতটা পারিনি। আমি যেহেতু যুগান্তরের সম্পাদক, তাই আমার সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা আছে, তখন আমার মাথায় একটা বিষয়ই ছিল, একটা পত্রিকা যখন কোনো ঘরে যাবে, তখন সেই পত্রিকাটি ওই ঘরের মালিক, ছেলে-মেয়ে, স্ত্রী, গৃহকর্মী, ড্রাইভারও পড়বে। আমি পাঠকের ভেতরে ওই ভাবে পত্রিকাটা দিতে চেয়েছি। যুগান্তর আমি সেইভাবে তৈরি করেছি।’
ভিউজ বাংলাদেশ: তিনি যুগান্তরে যেভাবে মার্কেটিং পলিসি নিয়েছিলেন, সমকালে তার থেকে কিছুটা ভিন্নতা দেখেছি আমরা। ‘সমকাল’ ছিল কিছুটা বুদ্ধিজীবী ঘরানার, পরিশীলিত চিন্তাশীল পাঠকের পত্রিকা। শিক্ষক, ছাত্র, পেশাজীবী পাঠকদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয়। এই বিষয়ে আপনার মতামত কী?
মিয়া নাঈম হাবিব: ঠিকই বলেছেন। যুগান্তর যে ধারায় করেছিলেন, সমকাল সেভাবে করেননি। বরং নতুন একটা চিন্তাধারায় তিনি সমকাল তৈরি করেছিলেন। প্রচারের শীর্ষে নিতে হবে, এমন একটা চিন্তাধারা নিয়ে যুগান্তরের মার্কেটিং করেছিলেন। আর সমকালকে একটি রুচিশীল পত্রিকা হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছেন। আপনি হয়তো জানেন, বিবিসি জরিপে একটানা ৫ থেকে ৬ বছর ‘সমকাল’ গুণগত মানের বিচারে বাংলাদেশে প্রথম অবস্থানে ছিল। দ্বিতীয় স্থানে ছিল ‘ডেইলি স্টার’। তৃতীয় স্থানে ছিল ‘প্রথম আলো’। অথচ তখনকার সময়ে সমকালের সার্কুলেশন ছিল প্রথম আলোর তিন ভাগের একভাগ।
ভিউজ বাংলাদেশ: গোলাম সারওয়ার ২০১৮ সালে আমাদের ছেড়ে বিদায় নিয়েছেন, এখনো যেটা বলা হয়, বাংলাদেশে গোলাম সারওয়ারের সমকক্ষ সাংবাদিক-সম্পাদক দ্বিতীয় কেউ নেই। তিনি সাংবাদিকতায় নিজেই প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিলেন। গোলাম সারওয়ারের কর্মজীবন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও অনুপ্রেরণা হয়ে কাজ করবে। এ ক্ষেত্রে তার পরিবার ও রাষ্ট্র কী ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে?
মিয়া নাঈম হাবিব: গোলাম সারওয়ার আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন পাঁচ বছর হয়ে গেছে। এই পাঁচ বছরে রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। আমার খুব কষ্ট লাগে এবং অবাক লাগে। গোলাম সারওয়ারকে যদি বিভিন্ন কর্মশালা, সেমিনার, বইপত্রে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হয়, তাহলে বাংলাদেশের সাংবাদিকতার জগৎ আরও বিকশিত হবে। অনেক তরুণ সাংবাদিক উপকৃত হবেন। আব্বা একটা কথা প্রায়ই বলতেন, মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি, একেকজন সাংবাদিক একেকজন মুক্তিযোদ্ধা। প্রত্যেক সাংবাদিককে প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধের জন্য কাজ করতে হয়। আমার আরও কষ্ট লাগে, যে সমকাল তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং যে সমকালের সম্পাদক থাকা অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, সেখানেও তার মৃত্যুর পর যথাযথ মর্যাদা পাননি। সমকালের কোথাও গোলাম সারওয়ারের নাম, ছবি দেখা যায় না। গোলাম সারওয়ারকে প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে যথাযথ সম্মান দিলে সমকালের মর্যাদাই বরং বাড়ত। তবে সাংবাদিকতায় গোলাম সারওয়ারের অবদান, তার কীর্তির কথা ছড়িয়ে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হলে পরিবারের পক্ষ থেকে তার প্রতি সক্রিয় সমর্থন দেওয়া হবে।
ভিউজ বাংলাদেশ: আপনাকে ধন্যবাদ।
মিয়া নাঈম হাবিব: আপনাকেও ধন্যবাদ।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে