সাংবাদিকতার বাতিঘর গোলাম সারওয়ার
গোলাম সারওয়ার ছিলেন ব্যবহারিক সাংবাদিকতার শিক্ষক
১ এপ্রিল গোলাম সারওয়ার ভাইয়ের জন্মদিন। ১৯৪৩ সালের ১ এপ্রিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বরিশাল জেলার বানারীপাড়ায় তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সারওয়ার ভাই কখনো জন্মদিন পালন করতে চাইতেন না। তিনি এটা নিয়ে ফান করতেন। আমরা যদি জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে চাইতাম তিনি বলতেন, আরে, আমি যদি মানুষকে বলি আজ আমার জন্মদিন, মানুষ মনে করে এটা এপ্রিল ফুল, যার ফলে তিনি জন্মদিন পালন করতেন না কখনো। পরবর্তীতে ওনার ছেলেমেয়েরা বড় হওয়ার পর তারা আয়োজন করত।
বাংলাদেশে তো কয়েকটা ঘরানার সাংবাদিকতা, কয়েকটা ধারা। আমার যা মনে হয়, প্রবীণদের যে ধারা- জহুর হোসেন চৌধুরী, আবদুস সালাম, মানিক মিয়া- সারওয়ার ভাই ওই ঘরানার পরবর্তী পুরুষ। ওই ধারার সঙ্গে মিলিয়ে আমি নিজেকে মনে করি সারওয়ার ভাইয়ের পরবর্তী পুরুষ। ওই ধারার প্রতিনিধি আমরা দু-চারজন আছি। যাদের মধ্যে সততা, মেধা, নৈতিকতাবোধ, মূল্যবোধ, পেশাদারিত্ব সব একসঙ্গে পাওয়া যাবে। এখন যারা সাংবাদিকতা করেন, তাদের মধ্যে অনেক ভালো সাংবাদিক আছেন; কিন্তু এই সব গুণ একসঙ্গে পাওয়া মুশকিল।
সারওয়ার ভাইয়ের মধ্যে এই সব গুণ একসঙ্গে ছিল। তিনি সম্পাদক হয়েছিলেন জীবনের শেষ দিকে। আজীবন তিনি সহ-সম্পাদক, বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি প্রথম সম্পাদক হন, দৈনিক যুগান্তর পত্রিকার। এর আগে দীর্ঘ দুই যুগ তিনি কর্মরত ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকে। পরে ২০০৫ সালে দৈনিক সমকাল পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।
সম্পাদক হলেও তিনি বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতেন। প্রতিদিন রাতে নিউজ রুমে না বসা, কপি না দেখা তার জন্য অসম্ভব ছিল। আজকাল আমরা অনেক সম্পাদককে দেখি তিনি অফিসে যান না, টেলিফোনে কাজ সারেন। অনেক বার্তা-সম্পাদককে তো দেখিই না। বড় বড় অনেক পত্রিকায় বার্তা সম্পাদকের অস্তিত্ব নেই। সম্পাদকই বার্তা সম্পাদক। বার্তা সম্পাদক হচ্ছেন একটি পত্রিকার তরুণ সাংবাদিকদের প্রথম শিক্ষক। তিনি হাতে-কলমে শিক্ষা দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা সাংবাদিকতা পড়ি, সেখান থেকে অনেকে স্নাতক হয়ে আসে, তাত্ত্বিকভাবে সমস্ত কিছু জানে; কিন্তু বার্তাকক্ষ হলো তার প্রথম ক্লাসরুম, যেখান থেকে সে ব্যবহারিক সাংবাদিকতা শেখে।
আমাদের ব্যবহারিক সাংবাদিকতার আরেক শিক্ষক ছিলেন এ বি এম মূসা। ওই ঘরানা ধরেই সারওয়ার ভাইও ব্যবহারিক সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক ছিলেন। উনি কপি দেখতেন, কপি পড়তেন, হেডিং পড়তেন, পত্রিকার মেকআপ করতেন, এবং চট করে ভুলত্রুটি সব ধরতে পারতেন। হয়তো ক্লাসরুমের মতো লেকচার দিতেন না; কিন্তু যার শেখার সে শিখে নিত।
তিনি যখন দৈনিক ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক, আমি তখন দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক। দুটিই তখন প্রভাবশালী পত্রিকা। প্রতি রাতে কাজ করার সময় আমি ফোন করতাম, জিজ্ঞেস করতাম, সারওয়ার ভাই, আজকে কোন নিউজটা বড় করছেন? তিনি বলতেন না যে, কোনটা প্রথম লিড বা সেকেন্ডে লিড করছেন। আমাকে ধরতে হতো। আবার তিনিও কখনো কখনো জিজ্ঞেস করতেন, বুলবুল, আজ কোনটা বড় করছো? আমি বলতাম, এটা বড় করছি। তিনি বলতেন, কত বড় করছো? আমি বলতাম, অনেক বড়। সবচেয়ে বড় বলতাম না। মানে সরাসরি কপি না করেও আমরা একে-অপরের নিউজের গুরুত্বটা জেনে নিতাম।
একটা বড় অভিজ্ঞতার কথা বলি, তখন এরশাদের আমল; সেনাবাহিনীর একটা গ্রুপ নারায়ণগঞ্জে একটা গ্রামে খুব অত্যাচার করেছে। আমাদের রিপোর্টার বংশী সাহা খোঁজ-খবর নিয়ে একটা রিপোর্ট পাঠিয়েছেন। তথ্য সব আমার হাতে; কিন্তু আমি নিউজটা করব কি করব না বুঝতে পারছিলাম না। খুব সেনসেটিভ নিউজ। প্রকাশ করলে ঝুঁকি আছে। আবার মালিক পক্ষের সঙ্গেও খুব বেশি পরামর্শ করা যায় না, তাহলে ভাববে ছেলেটা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। পেশাগতভাবে আমার একটু দুর্বলতা প্রকাশ পায়। পেশাগত মানুষের কাছে এই পরামর্শ নেয়া যায়। তো আমি সারওয়ার ভাইকে ফোন করলাম, সারওয়ার ভাই, নারায়ণগঞ্জের ঘটনা তো হাতে আছে, কী করি? তিনি বললেন, তুমি স্টোরি পাইছো? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, খাড়াও, আমি দেখতাছি। একটু পরে উনি ফোন করে বললেন, আমার কাছে স্টোরি নেই; কিন্তু ছবি আছে। বাড়িঘর যে ভাঙছে, মানুষজন আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দৌড়াচ্ছে এরকম ছবি আছে। তো কী করবা? আমি বললাম, আপনি বলেন, আমি কি বলব? আমি তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। তিনি বললেন, তুমি স্টোরিটা পাঠাও। আর তোমার যে লোক আসবে, তার কাছে আমি ছবি পাঠিয়ে দিচ্ছি। আসো, দুই ভাই মিলে নিউজটা ছাপাইয়া দিই।
পরদিন শুধু ইত্তেফাকে ও সংবাদেই নিউজটা ছাপা হলো। তার জন্য আমাদের দুজনের ভোগান্তিও হলো। আমাদের বিশেষ জায়গায় নিয়ে যাওয়া হলো। ধমকাধমকি করল। এই উদাহরণটা দিলাম এই কারণে যে, এত সিনিয়র হয়েও জুনিয়র আমাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, সেটা বোঝানোর জন্য। এটা হলো পেশাগত ঐক্য। পেশাগত ঐক্যটা হয় কার সঙ্গে? যখন বিশ্বাস ও আস্থার সম্পর্ক থাকে। সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার আস্থা ও বিশ্বাসের সম্পর্ক ছিল। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, বিশ্বাস করতেন। আমিও তাকে বিশ্বাস করতাম।
এক সময় সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে আমার এমন সম্পর্ক হয়েছিল, সারাদিন সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে যে যত কথাই বলুক না কেন, আমি জানতাম, রাতের বেলা উনি আমাকে ফোন করবেন এবং সারাদিন একশ লোকের সঙ্গে কথা বলে তিনি যা সিদ্ধান্ত নিতেন, আমি এক কথায় সব সিদ্ধান্ত ঘুরিয়ে দিতে পারতাম। তিনি এতটাই বিশ্বাস করতেন আমাকে।
তিনি আমার অভিভাবকতুল্য ছিলেন। তিনি একেবারে ‘জাত সাংবাদিক’ ছিলেন। তার পক্ষপাতিত্ব ছিল, বিশেষ রাজনীতির প্রতি তার দুর্বলতা ছিল, আওয়ামী লীগের প্রতি তো ছিলই; কিন্তু নিউজ করার ক্ষেত্রে তিনি বেশ শক্ত একটা অবস্থান নিতেন। তার উদাহরণ, আমরা যখন যুগান্তরে একসঙ্গে কাজ করি, তখনকার একটা ঘটনা বলি। যে কটা নিউজ দিয়ে যুগান্তর জনপ্রিয় হলো, তার মধ্যে একটা ছিল, আজকের যে ডা. ইকবাল, প্রিমিয়াম ব্যাংকের মালিক, তিনি আওয়ামী লীগের নেতা, তেজগাঁও অঞ্চলের এমপি ছিলেন, শান্তিনগরে এক মিছিলে তিনি প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে ওপর দিকে গুলি ছোড়েন। এই স্টোরিটা আমাদের কাছে ছিল। ছবিটাও আমাদের কাছে ছিল। আমি আর সারওয়ার ভাই দুপুরের মধ্যে সিদ্ধান্ত নিলাম, এটা আজকের লিড হবে। অবশ্যই লিড হবে।
আওয়ামী লীগ তখন ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ছিলেন ডা. আবদুল মালেক। তাদের কাছে খবর গেল যে ইকবাল সাহেবের নিউজটা যুগান্তরের কাছে আছে। তখন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা ভাবলেন সারওয়ার ভাইকে যদি সন্ধ্যাবেলা অফিস থেকে নিয়ে যাওয়া যায়, তাহলেই কাজ হবে, নিউজটা আর ছাপা হবে না। আমাকে অনেকে চিনতেন না। আমি তো সারওয়ার ভাইয়ের তুলনায় অনেক জুনিয়র; কিন্তু আমরা তো দুপুরবেলাতেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি এটা ছাপব। তো সন্ধ্যার পর ডা. মালেক সাহেব নিজে এসে সারওয়ার ভাইয়ের সঙ্গে কী কথার্বাতা বললেন, তাকে অফিস থেকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় সারওয়ার ভাই আমাকে বললেন, বুলবুল, আমি একটু মালেক ভাইয়ের সঙ্গে যাচ্ছি। আমাদের যা কথা ছিল সব ঠিক আছে। মালেক ভাই তো আর জানেন না কী ঠিক আছে। মালেক ভাই আর সারা রাত সারওয়ার ভাইকে ছাড়লেন না। আলাপের নাম করে আটকে রাখলেন। ভেবেছেন সম্পাদককে আটকে রাখলে তো আর নিউজ ছাপা হবে না।
পরদিন আট কলামে নিউজটা ছাপা হলো। পাগল হয়ে যাওয়ার অবস্থা সবার। এই যে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সারওয়ার ভাই যে নিউজটা ছাপলেন সম্পাদক হিসেবে এটাই ওনার সততা ও পেশাদারিত্ব। আমি যতদিন ওনার সঙ্গে কাজ করেছি উনি কোনোদিন আমাকে বলেন নাই, এই নিউজটা সত্য হওয়া সত্ত্বেও রাজনৈতিক কারণে তুমি ফেলে দাও। যার ফলে বার্তা সম্পাদক হিসেবে তার ওপর আমার একটা বড় আস্থা ছিল। পরে আমি যদি ভালো সাংবাদিক হয়ে থাকি, তার ভিত্তি শিক্ষকের মতো তিনি তৈরি করে দিয়েছেন।
আমি মনে করি সাংবাদিক হিসেবে সারওয়ার ভাই এখনো আমাদের সামনে উদাহরণ হয়ে আছেন। তিনি খুব আবেগী মানুষও ছিলেন। খুব মানবিক বোধ ছিল। এক সময় তিনি যুগান্তর ছেড়ে সমকালে চলে গেলেন, সমকাল ছেড়ে আবার যুগান্তরে এলেন, আবার সমকালে গেলেন। ওই সময়টাতে আমি ছিলাম না। আমি যুগান্তর ছেড়ে টেলিভিশনে চলে যাই। সে সময়টা তার অনেক মনোকষ্টের কারণ ছিল। বাংলাদেশে সাংবাদিকতা মানে হচ্ছে নানা ধরনের কুমিরের সঙ্গে লড়াই করা। তিনি ওই সময় যখন ঘর বদল করছেন, তখন একদিন বলেছিলেন, বুলবুল, নানা জায়গায় গেলাম; কিন্তু পেশাদারিত্বের সঙ্গে মনের মতো করে সাংবাদিকতাটা করতে পারলাম না। মালিকপক্ষের দু-একজনকে নির্দেশ করে তিনি কথাটা বলেছেন, তাদের নাম আমি আর এখন বললাম না।
সারওয়ার ভাই রিসোর্স পারসনগুলো চিনতেন। কাকে কীভাবে কাজে লাগানো যায় জানতেন। তার মধ্যে কোনো আত্মভণিতা ছিল না। তিনি নিজেই সব জানেন এমন ভাব কখনো প্রকাশ করতেন না। যে জানতো, যার গুণ ছিল তাকে যথার্থ মূল্যায়ন করতেন। আজকের সাংবাদিকদের বড় সমস্যা, সবাই সব জানে। ভালো সাংবাদিকতা করার জন্য যা যা গুণাবলি প্রয়োজন তার সব তার মধ্যে ছিল। সাংবাদিকতার পেশাদারিত্বের জায়গায় তিনি কখনো আপোষ করেননি। সব পারেন নাই, কখনো কখনো চাপে কাজ করতে হয়েছে। তবে, না পারার চাপটা ছিল, সেই চাপটা টের পেতাম।
সাংবাদিকদের সামনে তো কোনো রোলমডেল নেই এখন। রোলমডেল হওয়ার মতো মানুষ কমে গেছে। আমার ধারণা, সারওয়ার ভাইরাই রোলমডেল হওয়ার মতো শেষ প্রজন্ম। তিনি তার পত্রিকার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিতেন। কেউ ভুল করলে ভুলটা তার কাঁধে চাপিয়ে না নিয়ে নিজের কাঁধে নিতেন। এই দায়িত্ব নেয়ার প্রবণতাই তাকে বড় করেছে।
সততার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন অনুকরণীয়। আমি তার কোনো অসততার কথা জানি না। নীতিবোধ ছিল অটল। মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আজীবন শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। শিক্ষকতা দিয়ে তার কর্মজীবন শুরু। পরে ওখান থেকে ইত্তেফাকে চলে আসেন। তিনি নিজেকে ইত্তেফাকের ছাত্রই মনে করতেন। তিনি বাংলার ছাত্র ছিলেন। সাহিত্যমনা ছিলেন। খুব আড্ডাবাজ মানুষ ছিলেন। আর খুব রসিক মানুষও ছিলেন। প্রচুর গান শুনতেন। তার মোবাইলের রিংটোন ছিল ‘আমি কান পেতে রই’।
লেখক: সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে