বাজারের আগুন সরকারকেই নেভাতে হবে
বাজারের আগুন নিয়ে বাংলার মানুষ চিরকালই দিশেহারা। যুগের পর যুগ, বছরের পর বছর ধরে বাজারের আগুনের সঙ্গে বাংলার মানুষকে লড়াই করতেই হয়। শোনা যায় বেগুনের দর বেড়ে গিয়েছিল বলে কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বাজারে গিয়ে খুব চেঁচামেচি করেছিলেন। বাজারদর নিয়ে বাংলার মানুষের চিরকালেই মাথাব্যথার একটা বড় কারণ এই অঞ্চলে উৎপাদনের চেয়ে মানুষ বেশি, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। ফলে খেয়ে-পরে টিকে থাকার চিন্তাটাই প্রধান।
সাধারণত দেশে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা হলেই বাজার চলে যায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ইংরেজ আমলে যেমন এটা হয়েছে, পাকিস্তান আমলে হয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশের মানুষ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক উত্থান-পতন দেখেছে। ১৯৭৪- এর দুর্ভিক্ষ দেখেছে। শেখ মুজিবুর রহমান ও জিয়াউর রহমানর মৃত্যুর পরও বাজার অপ্রত্যাশিতভাবে অস্থিতিশীল হয়েছে।
এরশাদ আমলে বাজার সব সময়ই ছিল নাাগলের বাইরে। এরপর নব্বই দশকে উপসাগরীয় যুদ্ধ বাজার আরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। স্মরণে আছে, উপসাগরীয় যুদ্ধের পর লবণ ও কেরাসিন তেলের দাম যে বেড়েছিল আর কমেনি। সে সময় বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ কেরোসিন তেলের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ফলে কেরোসিনের হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধি পুরো জাতিকে পাগল বানিয়ে দিয়েছিল।
এরপর আরও তিনটি দশক গেছে। বাংলাদেশে কয়েক দফা গণতান্ত্রিক শাসন গেছে; কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বরং দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। সম্প্রতি বাজারদর চলে গেছে একেবারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ডিমের ডজন ১৭০ টাকা, পেঁয়াজ ১২০ টাকা, আলু ৬০ টাকা, কাঁচামরিচ ৪০০ টাকা। এমন কোনো তরকারি নেই যার দাম ৮০ টাকার নিচে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব পণ্যই নাাগলের বাইরে। নিম্নআয়ের মানুষ তো বটেই, মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তরাও এখন হিমসিম খাচ্ছে নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতে।
শুধু খাওয়া-পরার খরচ নয়, অন্যান্য ব্যয়নির্বাহ আছে। শহরাঞ্চলে বাস করলে তো আরও শেষ। বাসাভাড়া, চিকিৎসা ব্যয় আর সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটাতেই আয়ের অধিকাংশ চলে যায়, সেখানে আর দুবেলা ভালো-মন্দ খাবে কী? গ্রামের অবস্থা আরও করুণ। পর্যাপ্ত আয় নেই, এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম মোটামুটি একই।
অথচ, মানুষের আশা ছিল গণঅভ্যুত্থান চলে সিন্ডিকেট ভাঙবে, দ্রব্যমূল্য কমবে। প্রথম কদিন এরকম শোনাও গিয়েছিল। ইলিশ আর ভারতে রপ্তানি হবে না, আমরাই খাব কম দামে পেট ভরে। ইলিশ কি খাওয়া গেছে? সবজিসহ নিত্যদিনের প্রয়োজনীয় সব দ্রব্যেরই দাম বাড়ছে হু হু করে। কোনোভাবেই সরকার পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সিন্ডিকেট ভাঙতে পারছে না। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, নতুন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর দুই মাসে ছয়টি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়েছে। কমেছে মাত্র দুটির।
পণ্যমূল্য বাড়ার কারণ মুদ্রাস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হারে লাগাম তুলে নিয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ কমানোর পদক্ষেপ নিয়েছে; কিন্তু বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, সুদের হারে লাগাম তুলে নেয়ার পদক্ষেপ ঠিকই আছে। তাতে বাজারে টাকার সরবরাহ কমবে। পণ্যের চাহিদা কমবে। মূল্যস্ফীতি কমার সম্ভাবনাও আছে; কিন্তু অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রে এই নীতি ততটা কার্যকর নয়। কারণ সেসব পণ্যের চাহিদা সব সময়ই থাকে। বাজারে টাকার সরবরাহের ওপর ওই সব পণ্যের চাহিদা, জোগান ও দাম ততটা নির্ভর করে না। এসব পণ্যের দাম কমাতে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ দরকার।
অর্থনীতির সূত্র আমরা জানি, বাজারে জোগান বাড়লে চাহিদা কমে, চাহিদা কমলে দামও কমে। তাই পণ্যমূল্য কমানোর বড় উপায় উৎপাদন বাড়ানো অথবা আমদানির মাধ্যমে বাজারের চাহিদা বাড়ানো। ভোক্তা যদি পর্যাপ্ত পণ্য হাতে না পায়, তাহলে দাম বাড়বেই। মানুষকে নিত্যদিনের প্রয়োজন মেটাতেই হবে। কম খেয়ে পুষ্টিহীনতায় ভুগলে তো হবে না।
তাই আমরা চাই, যে করেই হোক জনসংখ্যার বিচারে বাংলাদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি বাড়ানো হোক। জিনিসপত্র যে করেই হাতে নাগালে আনা হোক। একটা কথা সরকারকে মনে রাখতে হবে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য না কমাতে পারলে সরকার বারবারই প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বাজারের আগুন নেভাতে হবে সরকারকেই।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে