সরকারি কর্মকর্তারা সব নাটের গুরু হওয়া সত্ত্বেও জবাবদিহির বাইরে
অনেক দিন আগে যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন হোটেলের চারদিকে দেখলাম বড় বড় ক্রেন দিয়ে উঁচু উঁচু ইমারত তৈরি করছে। রাতারাতি বড় বড় শহর গড়ে উঠছে। আর বর্তমানে আমি যখন বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় চলাফেরা করি, তখন প্রায়ই বড় বড় বাড়িঘর বা অট্টালিকা তৈরি হচ্ছে দেখে হৃদয়ে পুলক অনুভব করি। দেশের আনাচে-কানাচে উন্নয়নের কাজ হচ্ছে, গ্রামে-গঞ্জে ইলেকট্রিক বাতি জ্বল জ্বল করছে, মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন হচ্ছে। বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশেও বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দেখে যারপরনাই আনন্দিত হই। তবে কিছুসংখ্যক দুর্নীতিপরায়ণ সরকারি আমলা ও টাউট-বাটপারদের জন্য দেশটি বদনামের ভাগী হচ্ছে। ফলে বিদেশিরা আমাদের উপদেশ দেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এটা জাতির জন্য খুবই লজ্জাজনক।
সরকারের অনেক বড় বড় প্রজেক্ট এদের কারণে যথা সময়ে শেষ হচ্ছে না, তাতে জনগণের হয়রানি যেমন বাড়ছে, সরকারের খরচও বাড়ছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ অবশ্যই প্রয়োজন। এবারের বাজেটের ২৩ শতাংশ খরচ হবে ঋণবাবদ সুদ মেটাতে, ২২ শতাংশ খরচ হবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বাবদ (যা আগামীতে ২৮ শতাংশ হবে বলে শোনা যাচ্ছে), অর্থাৎ বাজেটের অর্ধেকই খরচ হবে অনুন্নয়ন খাতে। একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য এমনটি হওয়া মোটেই কাম্য নয়। বরং ব্যাংক ঋণ যাতে সরকারকে অধিকতর নিতে না হয়, তার জন্য রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন। এটা বৃদ্ধি করতে হলে যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে এ বাজেটে তার কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয়নি।
গতানুগতিক নিয়মে এটা বৃদ্ধি করা সম্ভব কি না, তাতে সন্দেহ আছে। বরং কালো টাকাকে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার যে প্রস্তাব করা হয়েছে, তা সৎভাবে যারা আয় করে ৩০ শতাংশ আয়কর দেন, তাদের জন্য হতাশার এবং নৈতিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এমন নীতি অসৎ উপায়ে উপার্জন করতে উৎসাহ দিতে পারে। কালো টাকা বা অদৃশ্য আয়ের একটি বড় কারণ হচ্ছে মার্কেট মেকানিজমের ওপর খবরদারি করা। কি অদৃশ্য কারণে ১ কোটি টাকার বাড়ি বা ফ্ল্যাট বিক্রি করে বলতে হয় মাত্র ২৫ লাখ টাকা পেয়েছি এবং এই ২৫ লাখের ওপর চড়াদামে ট্যাক্স দিতে হয়। এর ফলে ৭৫ লাখ টাকা অপ্রদর্শিত বা কালো টাকা হয়ে পড়ে।
মার্কেট মেকানিজমের ওপর এমন খবরদারির প্রয়োজন আছে কি? সুতরাং কালো টাকাকে সাদা করার জন্য ১ কোটিকে ১ কোটি বলতে হবে এবং এই ১ কোটি টাকার ওপর ট্যাক্স দিতে হবে, ২৫ লাখের ওপর নয়। ট্যাক্সের পরিমাণ চড়াদামে না রেখে সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে এলে সরকারের আয়ও বাড়বে আর জনগণকে কালো বা অদৃশ্য টাকার ঝকমারি থেকে মুক্তি দেয়া সম্ভব। দ্বিতীয়ত, আমাদের আমলাতন্ত্র অনেক ব্যাপক ও মাথা ভারী হয়ে উঠেছে এবং এদের ক্ষমতাও আকাশচুম্বী।
আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাবস্থায় একজন ডিসিকে একটি কমিটি করতে বলেছিলাম, কয়েক মাস পার হবার পরও কমিটি যখন হয়নি তখন ডিসিকে জিজ্ঞেস করলাম ওই কমিটিটি দিতে এত দেরী করছেন কেন? তিনি বললেন, ‘স্যার, সরকার আমাকে শত শত কমিটির দায়িত্ব দিয়েছে, তাছাড়া প্রটোকল ডিউটিও আছে। কখন যে কোন মিটিং ডাকব আর কমিটি করব, সেই সময় তো আমার নেই। বস্তুত একজন ডিসির ওপর শত শত দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। দিনে দিনে তার ওপর দায়িত্ব আরও বাড়ছে। তাই তারা সঠিকভাবে দেখভাল করার সময় পান না। অপর পক্ষে, নির্বাচিত জন প্রতিনিধিদের কোনো নির্দিষ্ট দায়িত্ব নেই।
তাদের একমাত্র দায়িত্ব হচ্ছে ‘তদবির’ করা। তদবির ছাড়া তাদের ওপর কোনো দায়িত্ব নেই যদিও এলাকার উন্নয়ন এবং নিজ এলাকায় সুশাসনের ব্যত্যয় হলে জন প্রতিনিধিকে দোষীসাব্যস্থ করা হয়। সরকারি অফিসাররা সব নাটের গুরু হওয়া সত্ত্বেও তারা জবাবদিহির বাইরে। যদি কোনো জনপ্রতিনিধি দুর্নীতি করতে চান, তিনি একা তা করতে পারবেন না। তাকে অবশ্যই সরকারি কর্মচারী বা অফিসারের সহায়তা নিয়ে জনগণের সম্পদ লুট করতে হবে। বিভিন্ন তথ্যমতে দেখা গেছে, বিদেশে সরকারি কর্মচারীদের বাড়িঘর বেশি এবং লুটের টাকা পাচারে তারা অনেক দক্ষ। রাজনীতিবিদরা তাদের কাছে নস্যি। ব্যবসায়ীদের সরকারি কর্মচারীরাই ঘুষ দিতে বাধ্য করেন। স্পিডমানি না দিলে কাজ সহজে অগ্রসর হয় না।
সিলেটের এক প্রবাসী আমাদের অনেক অনুরোধে এবং সরকারের মন্ত্রী মিনিস্টারদের আহ্বানে বাংলাদেশে কিছু বিনিয়োগ করেন। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অনেকের চাকরি হয়েছে এবং তিনি সরকার নির্ধারিত আয়কর রীতিমতো দিয়ে যাচ্ছেন। তবে আয়কর বিভাগের কোনো কোনো অফিসার তাতে অসন্তুষ্ট। তারা তাকে ঘুষ দিতে পীড়াপিড়ি করেন। তিনি ঘুষ নিতে অস্বীকার করলে তার বিরুদ্ধে বানোয়াট রিপোর্ট তৈরি হয় এবং তাকে ধমক দেয়া হয় এই বলে যে, আপনি যদি আমাদের দেশের এই অলিখিত নিয়ম না মানেন, তাহলে আপনি আপনার ব্যবসা বিদেশে নিয়ে যান। ওই অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার পরও তিনি এখনো দিব্যি সরকারি চাকরিতে বহাল আছেন।
ট্যাক্সপেয়ারদের টাকা খরচ করতে সরকারি অফিসারদের গায়ে লাগে না। গরিবের ট্যাক্সের পয়সা দিয়ে ঈদ কিংবা পহেলা বৈশাখে বড় সাহেবদের দামি গিফট দেয়া এখন একটা রেওয়াজ হয়ে গেছে। তারা অযথা খরচ করেন বেশি। এটা কমানোর জন্য সরকারের অনেক দপ্তর বা অফিস বন্ধ করে দেওয়া যায় কি না, সেটা বিবেচনা করার জন্য সংসদীয় কমিটি কাজ করতে পারে যাতে we must not suck the blood of the poor people. তাতে সরকারের খরচ যেমন কমবে, মানুষের হয়রানিও কমবে এবং কাজগুলো একাধিক দপ্তরের মাত্রাতিরিক্ত মাতব্বরির ফলে দীর্ঘায়িত হবে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগান প্রেসিডেন্ট হিসেবে খুব নাম করেন। তিনি সিনেমার নায়ক ছিলেন। তিনি সরকারি নিয়মকানুন খুব বুঝতেন না। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় যে কাজকর্ম দীর্ঘায়িত হয়, তা তিনি টের পান। তাই তিনি দুটি কাজ করে জনগণের হৃদয়ে চিরঞ্জীব হয়ে আছেন। একটি হচ্ছে ইস্ট ও ওয়েস্ট জার্মানির মধ্যকার প্রাচির ভেঙে ফেলা- "tear down the walls", বার্লিন ওয়াল এবং অন্যটি হচ্ছে মার্কিন আমলাতন্ত্রকে তিনি কেটেছেঁটে ছোট করেন। যেসব দপ্তর প্রয়োজন নেই, তা তিনি শক্ত হাতে বন্ধ করে ট্যাক্সের টাকা বাঁচান। তিনি আজও তাই নমষ্য। কর্মচারীর এবং আইন কানুনের আধিক্য কমলে দুর্নীতির প্রতিযোগিতা ও মহোৎসব হয়তো কমতে পারে। তৃতীয়ত, দেশে কর্মসংস্থান বাড়ানো খুবই দরকার। হাজার হাজার ছেলেমেয়ে বৈধ ও অবৈধপথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে চাকরির অন্বেষণে।
তাই কর্মসংস্থান বাড়ানোর জন্য বহুবিধ উদ্যোগ নেয়া একান্ত দরকার। সরকার যদি কম ব্যাংক ঋণ নেয়, তাহলে প্রাইভেট সেক্টর অধিকতর ব্যাংক ঋণ নেয়ার সুযোগ পাবে এবং যেহেতু অধিকাংশ কর্মসংস্থান প্রাইভেট সেক্টরে সৃষ্টি হয়, সুতরাং ক্রাউডিং আউট (crowding-out) করা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে যে, সুদের হার অতিরঞ্জিত থাকলে বিনিয়োগ কম হবে।
আওয়ামী লীগ দল সব সময়ই জনগণের মঙ্গল চায় এবং তারা জনগণের ইচ্ছাকেই প্রতিষ্ঠিত করে। এদেশের যত বড় বড় অর্জন যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টি, একে শক্ত ভিতের ওপর প্রতিষ্ঠিত করা, একে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনে, এদেশকে দারিদ্র্যমুক্ত করা, এদেশের কালো আইন ইনডেমনিটির স্থলে আইনের ক্ষেত্রে সব মানুষের সমঅধিকার নিশ্চিত করা বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা, এদেশকে জঙ্গিবাদ বা সন্ত্রাসবাদ মুক্ত করা, এদেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থাকে সমুন্নত করা এবং অর্থনৈতিক মুক্তি বা জীবনমানের উন্নয়ন সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের সম্ভব হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ সরকারকেই দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গঠনে মূল ভূমিকা নিতে হবে এবং একই সঙ্গে আমলাতন্ত্রের দৌরাত্ম্যকে লাগাম টেনে জনগণের সেবক বা বন্ধু হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। এগুলোর দায়িত্ব দেশের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকেই নিতে হবে।
রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় পরিচয় যে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা, যিনি সব সময় অকুতোভয়, নির্ভীক। তার ধমনিতে, তার প্রতিটি শিরায় শিরায় ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয় মানবকল্যাণ, জনগণের মঙ্গল। সুতরাং তিনিই পারবেন এ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্তি দিতে। শোষণমুক্ত, দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ শেখ হাসিনার হাতেই সম্ভব।
লেখক: সংসদ সদস্য, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও সভাপতি, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে