বাল্যবিবাহ রোধে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে
একবিংশ শতাব্দীর দুদশক পেরিয়ে যাবার পরও কোনো দেশে যদি বাল্যবিবাহের হার ৫০ শতাংশ থাকে, তা নিশ্চিতভাবেই সেই দেশ-জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জার বিষয়। কারণ বাল্যবিবাহ একটি দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য, যৌতুক, সামাজিক প্রথা, ধর্মীয় ও সামাজিক চাপসহ অনেক নেতিবাচক দিককেই স্পষ্টভাবে অঙুলিনির্দেশ করে। আর সে দেশে বাল্যবিবাহ যদি প্রতি বছর ২ শতাংশ হারে কমে, তা আরও আতঙ্কজনক বিষয়। যেমনটা ঘটছে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে। এই হারে কমলে বাল্যবিবাহ নির্মূলে বাংলাদেশের লাগতে পারে ২১৫ বছর। প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কী ২১৫ বছর অপেক্ষা করবে না কী বাল্যবিবাহ রোধে আরও কঠোর হবে?
গত ৫ জুন মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়, ইউএনএফপিএ ও ইউনিসেফ আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৮ বছরের কম বয়সে বাল্যবিবাহের হার ২০০৬ সালে ৬৪ শতাংশ, ২০১২ সালে ৫২ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ৫১ শতাংশ ছিল। সেই হিসাবে দেশে এখন ৪ কোটি ১৫ লাখ মেয়ে ও নারী বিবাহিত এবং সন্তানের মা। বাল্যবিবাহ কেবল একটি মেয়ের জীবনকেই ধ্বংস করে না, উত্তর প্রজন্মকেও তার দায় বহন করতে হয়।
বাংলাদেশে ‘বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৭-এর ৬নং আইনে স্পষ্ট বলা আছে, ‘বিবাহের ক্ষেত্রে ২১ (একুশ) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো পুরুষ এবং ১৮ (আঠারো) বৎসর পূর্ণ করেন নাই এমন কোনো নারী’ বাল্যবিবাহের অন্তর্ভুক্ত হবেন এবং এই আইন ভঙ্গ করা দণ্ডনীয় অপরাধ। তার জন্য জরিমানসহ জেল খাটারও শাস্তির বিধান রয়েছে।
এই আইন করা সত্ত্বেও বাল্যবিবাহের দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। এ হার আফগানিস্তানে ৩৫, ভারতে ২৭, পাকিস্তানে ২১, নেপালে ১০ ও শ্রীলঙ্কায় ৪ শতাংশ। বিবিএসের ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩-এর প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বাল্যবিবাহের হার প্রায় ৪২ শতাংশ। ১৫ বছরের কম বয়সীদের বাল্যবিবাহের হার ৮ শতাংশ।
বাল্যবিবাহের কারণ অশিক্ষা, দরিদ্রতা, সামাজিক প্রথা, ধর্মীয় চাপের পাশাপাশি আরও একটি বড় কারণ আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ নেই। বিবাহ রেজিস্ট্রেশনের ক্ষেত্রে এখনো অনেক অঞ্চলে জন্ম-সনদ বাধ্যমূলকভাবে ব্যবহার করা হয় না। পরিবারের সহযোগিতাতেই কাজি বা হুজুর অপ্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েদের বিয়ে পড়িয়ে থাকেন। অনেক সময় মিথ্যা বলেও মেয়ের বয়স বেশি দেখানো হয়। এতে করে ওই বিবাহিত নারী জীবন-মরণের হুমকির মধ্যে পড়ে।
পরিবার ও সমাজের সহযোগিতা ছাড়া বাল্যবিবাহ সম্ভব নয়। আর সবাই এই অপরাধের সুযোগ পায় আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগের অভাবে। তাই বাল্যবিবাহ রোধে সরকারকে আরও বেশি কঠোর হতে হবে। শুধু আইন প্রয়োগের মধ্য দিয়ে নয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসায়, গণমাধ্যমে, সমাজের সর্বস্তরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে আরও বেশি সচেতনতামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।
বাল্যবিবাহ রোধ না করা গেলে তা দেশের আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিকাশে অত্যন্ত ক্ষতিকর হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রাকে তা অনিবার্যভাবে বিঘ্ন ঘটাবে। ২০৪১ সালের মধ্যে সরকার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করেছে, আমরা আশা করব, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার আগেই সরকার বাল্যবিবাহ সম্পূর্ণ নির্মূল করবে।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে