Views Bangladesh Logo

কবরস্থানই এখন পাখিদের অভয়ারণ্য

পাখি এবং বন্য প্রাণীর নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করতে সরকারি হিসাব অনুযায়ী ১২টি অভয়ারণ্য থাকার কথা। তবে প্রকৃতপক্ষে অভয়ারণ্য বলতে যা বুঝায়, তা পরিপূর্ণভাবে আজও গড়ে ওঠেনি। যার ফলে, কবরস্থানগুলোই এখন পাখিদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। রাজধানীর কয়েকটি কবরস্থান ঘুরে দেখা যায় এমন চিত্র। বড় গাছের ডালে ডালে বসে আছে শালিক, ঘুঘু, ময়না, চড়ুই ও বেনে বউ। আবার একই সঙ্গে দেখা মেলে শকুন, বাজ এবং পেঁচার মতো শিকারি পাখি। অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বন অধিদপ্তরের কাছে রাজধানীর বিভিন্ন কবরস্থানে কী ধরনের বন্যপাখি আছে, তার কোনো জরিপ নেই।

রাজধানীর রায়ের বাজার বধ্যভূমি কবরস্থানে সরেজমিন দেখা যায়, কবরস্থানটি এত বড় যে, পাখিগুলো এ স্থানটিকে নিরাপদ আবাসস্থল হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখানে দেখা মিলল ঘুঘু, কোকিল, বক, কাঠঠোকরা, হলুদ পাখী, মাছরাঙা, চড়ুই, দোয়েলসহ নানা প্রজাতির পাখি। এসব পাখির পাশাপাশি দেখা গেল শকুন, বাজ, চিল এবং পেঁচার মতো শিকারি পাখিও। এসব প্রজাতির পাখি আয়েশ করে বসে আছে গাছের ডালে ডালে। তবে, মানুষের আগমন টের পাওয়া মাত্র দিগন্তে উড়ে যাচ্ছে। পাখির বিষয়ে কথা হলো কবরস্থানে আসা এক নারীর সঙ্গে। তিনি বললেন, ‘এখানে এখন অনেক বেশি শিকারি পাখির দেখা মেলে। এত শিকারি পাখি একসঙ্গে দেখেছি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। আর দ্বিতীয়বার দেখছি বেশ কয়েকমাস ধরে।’

নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে উনি বললেন, ‘গতকাল হাঁটছি কবরস্থানের রাস্তা ধরে হঠাৎ কয়েক গজ দূরে করুণ শব্দ ভেসে আসছে, থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম, যা দেখলাম, সে দৃশ্য দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। দেখতে পেলাম শিকারি বাজ, সেটার এক পায়ে ঝুলছে একটি সাপ আর আরেক পায়ের নখ দিয়ে সেটা ধরে রেখেছে একটা ঘুঘু। মুহূর্তেই শিউরে উঠলাম। হাতে থাকা মোবাইল ফোন দিয়ে একটা ছবি তুলতে চাইলাম কিন্তু আর সাহস দেখাতে পারলাম না। এর মধ্যেই শিকার পায়ে গেঁথে পাখিটি দ্রুত উড়ে গেল। আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল। বাজটা উড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আচমকা ডানা ঝাপটানির শব্দ শুনে ফিরে তাকাতেই দেখলাম, কয়েকটি শকুন ডানা নাড়ছে।’

রায়ের বাজার কবরস্থানে যারা নিয়মিত আসেন, তাদের মধ্যে কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল প্রায় একইরকম অভিজ্ঞতার কথা। হঠাৎ এখানে একসঙ্গে এত শিকারি পাখি বাস করার কারণ জানতে চাইলে, প্রাণিসম্পদ বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক আশরাফ আলী বলেন, শীতকালে বাজ পাখির সংখ্যা অন্যান্য সময়ের তুলনায় বেশি হয়। কারণ, বাজ এক প্রজাতির পরিযায়ী পাখি। যেমন, হিমালয়ী বাজ, হিমালয়ের আশপাশের দেশ যেমন নেপাল ভুটান, ভারত, পাকিস্তান ও দক্ষিণ তিব্বতের আবাসিক পাখিটি শীতে উত্তর-পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে পরিযায়ী হয়। তিনি আরও বলেন, কিছুটা জাপানি বাজের মতো দেখতে পাখিটি দৈর্ঘ্যে ৪৫-৫৩ সেন্টিমিটার।’

পরিচালক আরও বলেন, পদ্মা ও যমুনা নদীর বিরানচর থাকার কারণে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগেও এ প্রজাতির কিছু পাখি দেখতে পাওয়া যায়। রাজশাহীর পদ্মা নদীর চরে কালাজাং ও লোহারজং সারস পাখি খুঁজতে গিয়ে ২০১৬ সালে এদের দেখা মেলে। পঞ্চগড়েও এই বাজপাখির অস্তিত্ব রয়েছে। পুরুষ পাখি ওজনে ৬৩০-৮১০ গ্রাম আর স্ত্রী ৫১৫-৯৭০ গ্রাম হয়। এরা আকাশে বা মাটিতে অথবা গাছের আগডালে বসে খাবারের সন্ধান করে। ভূমিতে থাকা ইঁদুর, সাপসহ সরীসৃপ, পাখি, অমেরুদণ্ডী প্রাণী ইত্যাদির ওপর হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়ে পায়ের ধারালো নখ দিয়ে শিকার করে। এদের আবাসন এলাকা হচ্ছে গাছের ডাল, পাহাড়ের চূড়া। এরা কাঠি ও পাতা দিয়ে মাচানের মতো বাসা তৈরি করে বসবাস করে। দুই থেকে তিনটি ধূসরাভ-সাদাটে ডিম পাড়ে, যা ৩৩-৩৮ দিনে ফোটে। বাচ্চা ৪৩-৬০ দিনে উড়তে শিখে।’

বাড়িঘর, রাস্তা, শিল্পকারখানা গড়তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাখির আবাসস্থল উল্লেখ করে তিনি বলেন, অত্যধিক শব্দ পাখিদের জন্য ক্ষতিকর। নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংস করায় পাখিদের অভয়ারণ্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে, এসব পাখি নিরাপত্তার স্বার্থে কবরস্থানের মতো নিরিবিলি জায়গা বেছে নিয়েছে বসবাস করার জন্য। এ কারণেই ইদানীং কবরস্থানগুলোতে বিভিন্ন প্রজাতির পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীর আনাগোনা লক্ষ্যণীয়।

এ ব্যাপারে কথা বলতে আগারগাঁও বন অধিদপ্তরে যোগাযোগ করা হলে কোনো কর্মকর্তাকেই পাওয়া যায়নি। গত রোববার (২ ফেরুয়ারি) গিয়ে জানা যায়, বন অধিদপ্তরের প্রধান বন সংরক্ষক মো. আমির হোসাইন চৌধুরী দেশে নেই। বন সংরক্ষক বন্যপ্রাণী ও প্রকৃতি সংরক্ষক (অঞ্চল ঢাকা) এমরান আহমেদের খোঁজ করা হলে জানা যায় তিনিও সুইজারল্যান্ডে আছেন। এরপর যোগাযোগ করা হয় বন পরিচালক সানাউল্লাহ পাটোয়ারীর সঙ্গে, জানা যায় তিনিও ঢাকার বাইরে আছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, নির্বিচারে বন-জঙ্গল ধ্বংস, জলাভূমির সংখ্যা হ্রাস, ব্যাপক হারে পাখি শিকার ইত্যাদি কারণে দেশে আশঙ্কাজনক হারে কমছে পাখির সংখ্যা। বর্তমান সময়ে দেশে বিপদাপন্ন পাখি প্রজাতির সংখ্যা ৬৮ হাজারের বেশি। দশ প্রজাতির পাখি রয়েছে মহাবিপন্নের তালিকায়। তার মধ্যে অন্যতম একটি পাখি হলো শকুন। পঞ্চাশ বছর আগে এদেশে শকুনের সংখ্যা ছিল লক্ষাধিক। বর্তমানে অনেক কম।

তারা বলেন, পাখিদের এই শোচনীয় অবস্থায় তাদের নিরাপত্তার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের নজরদারি বাড়াতে হবে, বেআইনিভাবেই পাখি শিকার যা দণ্ডনীয় ফৌজদারি অপরাধ। ১৯৭৪ সালে বন্যপ্রাণী রক্ষা আইন ও ২০১২ সালে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইনে দণ্ডের বিধান রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, পাখি নিধনের সর্বোচ্চ শাস্তি এক বছর জেল, ১ লাখ টাকা দণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত। একই অপরাধ ফের করলে শাস্তি ও জরিমানা দ্বিগুণ। মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এই আইনের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ