Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

মুসলিম আইনে অভিভাবকত্ব

Md J R Khan Robin

মো. জে আর খান রবিন

সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

রবি ‘হিজানাত’ শব্দ থেকে অভিভাবক তথা গার্ডিয়ান শব্দটি এসেছে। হিজানাত শব্দের অর্থ লালন-পালন, তত্ত্বাবধান ও দায়িত্ব গ্রহণ। অভিভাবক বলতে সে ব্যক্তিকে বুঝায়, যে ব্যক্তির কাছে কোনো নাবালক কিংবা নাবালিকার শরীর, সম্পত্তি বা উভয়ের তত্ত্বাবধান রয়েছে এবং প্রতিপাল্য বলতে তাকে বুঝায়, যার শরীর সম্পত্তি বা উভয়ের জন্য অভিভাবক রয়েছে। মুসলিম আইনের ৩৪৮-৩৬৮ ধারায় এবং ১৮৯০ সালের অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইনে অভিভাবক ও প্রতিপাল্য বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সাধারণত অভিভাবকত্ব নাবালক-নাবালিকার শরীর, সম্পত্তি ও বিয়ের ক্ষেত্রে বিবেচিত হয়। মুসলিম আইনে ১৫ বছরে পদার্পণ করেনি এমন কোনো নাবালক-নাবালিকাকে বুঝালেও অন্যান্য আইনে নাবালক-নাবালিকা বলতে, যার বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হয়নি এমন কাউকে বুঝায়। উল্লেখ্য, কোনো নাবালক-নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির বিষয়ে অভিভাবক নিযুক্ত হয়ে থাকলে তার বয়স ২১ বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত নাবালক বা নাবালিকা হিসেবে বিবেচিত হবে। (ধারা-৩৪৮)।

এবার দেখা যাক, মুসলিম আইনে কে, নাবালক-নাবালিকার শরীর, সম্পত্তি ও বিয়ের অভিভাবক হিসেবে উপযুক্ত:
প্রথমত, নাবালক-নাবালিকার শরীর মুসলিম আইনে পুত্র সন্তানের বয়স ৭ (সাত) বছর পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তানের বয়ঃসন্ধি বা পূর্ণ যৌবনপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত ‘মা’ তার হেফাজতে রাখার অধিকারী হলেও তিনি স্বাভাবিক ও আইনানুগ অভিভাবক নন। পিতা বা দাদা বা তাদের নিযুক্তীয় নির্বাহকই বৈধ ও আইনানুগ অভিভাবক (ধারা-৩৫২)। মায়ের মৃত্যুর পর বা কোনো যৌক্তিক কারণে ‘মা’ এ অধিকার হারালে নাবালক-নাবালিকার নানি, দাদি, আপন বোনসহ অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের মহিলার ওপর অভিভাবকত্বের দায়িত্ব বর্তায় (৩৫৩)।

অন্যদিকে মাসহ অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের নারীরা বিভিন্ন কারণে হেফাজতের বা অভিভাবকের দায়িত্ব হারান। যেমন; নাবালকের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত নয়, এমন কোনো নিষিদ্ধ ধাপের কাউকে বিয়ে করলে, মাতা-পিতার বাসস্থান থেকে অন্যত্র চলে গেলে, অনৈতিক জীবনে জড়িয়ে পড়লে, নাবালক/নাবালিকাকে সঠিক পরিচর্চা না করলে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করলে, পিতাকে নাবালক ও নাবালিকার কাছে যেতে বাধা দিলে (ধারা-৩৫৪)। তা ছাড়া পুত্র সন্তানের বয়স ৭ বছর এবং কন্যা সন্তানের বয়োঃপ্রাপ্তির পর পিতার হেফাজতের অধিকার সৃষ্টি হয়। পিতার অবর্তমানে দাদা এবং তাদের অবর্তমানে অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের পুরুষদের ওপর এ অধিকার বর্তায়।

এ ক্ষেত্রে শর্ত থাকে, কোনো পুরুষই অবিবাহিত বালিকার হেফাজতের অধিকারী হবেন না, যদি না, সে ওই বালিকার সহিত মুসলিম আইনের ২৬০-২৬১ ধারা অনুযায়ী নিষিদ্ধ ধাপের আত্মীয় সম্পর্কের হয় (ধারা-৩৫৫)। উল্লেখ্য ‘মা’ বা অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের নারীরা যে কারণে হেফাজতের দায়িত্ব হারান, প্রায়ই একই কারণে পিতা ও অন্যান্য নিকটতম আত্মীয়ের পুরুষরাও হেফাজতের দায়িত্ব হারান। পিতা বা নিকটতম পুরুষ আত্মীয়ের অবর্তমানে অভিভাবক নিয়োগের দায়িত্ব আদালতের ওপর বর্তায় (ধারা-৩৫৭)। এ ছাড়াও নাবালিকা স্ত্রীর অভিভাবক হিসেবে উপযুক্ত হলেন তার মা (ধারা-৩৫৬)।

দ্বিতীয়ত, নাবালক-নাবালিকার সম্পত্তি:
সম্পত্তির ক্ষেত্রে নাবালক-নাবালিকার পিতা ও দাদা বৈধ ও আইনগত অভিভাবক এবং তাদের অবর্তমানে তাদের নিযুক্তীয় ব্যক্তিও অভিভাবক নিযুক্ত হতে পারেন (ধারা-৩৫৯)। এ ধরনের অভিভাবক যৌক্তিক কারণে নাবালক-নাবালিকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি আদালতের অনুমতি ছাড়াই হস্তান্তর করতে পারেন (ধারা-৩৬২ ও ৩৬৬)। বৈধ ও আইনগত অভিভাবকের অবর্তমানে নাবালক-নাবালিকার মঙ্গলার্থে আদালত নাবালক-নাবালিকার পিতৃকুল বা মাতৃকুলের পক্ষ থেকে যে কাউকে সম্পত্তির জন্য অভিভাবক নিযুক্ত করতে পারেন (৩৬০) এবং এ ধরনের অভিভাবক বৈধ কারণে নাবালক-নাবালিকার স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তররে ক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি ছাড়া করতে পারবেন না (ধারা-৩৬৩)। অন্যদিকে অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে একজন অভিভাবক তার নিজের সম্পত্তি যেভাবে দেখাশোনা করেন, ঠিক অনুরূপভাবে নাবালক-নাবালিকার সম্পত্তিও দেখাশোনা করবেন (ধারা-৩৬৭)।

তা ছাড়া আইনগত অভিভাবক না হওয়া সত্ত্বেও কখনো কখনো কেউ স্বেচ্ছায় নাবালক-নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির হেফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তাকে বাস্তবিক বা কার্যত অভিভাবক বলা হয় (ধারা-৩৬১)। এ ধরনের অভিভাবকেরও নাবালকের সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষমতা নেই (ধারা-৩৬৪) এবং অস্থাবর সম্পত্তির ক্ষেত্রে এ ধরনের অভিভাবকের ক্ষমতা আইনানুগ অভিভাবকের ক্ষমতার সমান (ধারা-৩৬৮)।

তৃতীয়ত, নাবালক-নাবালিকার বিয়ে: নাবালক-নাবালিকার বিয়ের ক্ষেত্রেও পিতা, দাদা যতই ঊর্ধ্বগামী হোক, তাদের ওপর বর্তায়। এদের অবর্তমানে মাসহ মাতৃকুলের জ্ঞাতিগণের ওপর বর্তায় (ধারা-২৭১)। যদিও বর্তমানে প্রচলিত আইনে নাবালক-নাবালিকার বিয়ে আইনগতভাবে দণ্ডনীয় অপরাধ।

নাবালক-নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তির জন্য যে কোনো ব্যক্তি যৌক্তিক কারণে অভিভাবক নিযুক্ত হওয়ার লক্ষ্যে পারিবারিক আদালতে আবেদন করতে পারেন (ধারা-৩৪৯)। আবেদনকারীর অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের দৈহিক ও মানসিক যোগ্যতা, চরিত্র ও স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য, আর্থিক অবস্থা এবং নাবালক/নাবালিকার সার্বিক মঙ্গলসহ উল্লিখিত বিষয়গুলো বিবেচনা করে আদালত নাবালকের শরীর ও সম্পত্তির অভিভাবক নিয়োগের আদেশ প্রদান করে থাকেন (ধারা-৩৫০-৩৫১)।

পরিশেষ বলা যায়, কোনো নাবালক-নাবালিকাকে যোগ্য উত্তরাধিকারী হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই অভিভাকের ভূমিকা অপরিসীম। একজন অভিভাবকের দায়িত্ব হলো নাবালক/নাবালিকার শরীর ও সম্পত্তি সঠিকভাবে দেখাশোনা মাধ্যমে তাকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা।

লেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ