দেশের গণতন্ত্র কি বিপদমুক্ত হলো?
শেষ হয়ে গেল অনেক আলোচনার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কেমন হলো সেই নির্বাচন, তা নিয়ে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে অন্যবারের তুলনায় এবার বেশি আগ্রহী বিদেশিরাও। সবার আগ্রহের আপাতত সমাপ্তি। তবে চলছে এই নির্বাচন নিয়ে নানা বিশ্লেষণ।
দেশের অন্যতম জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল বিএনপির অংশগ্রহণহীন এবারের নির্বাচনে তেমন কোনো চমক নেই। সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বা নিয়ম রক্ষার এই নির্বাচনে যেমনটি আগে থাকতেই শোনা গিয়েছিল, ভোটের ফলাফল তেমনটাই হয়েছে। আওয়ামী লীগের বাইরে যে কয়টি রাজনৈতিক দল সমাঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, নির্বাচনের ফলাফলে তাদের শোচনীয় দশা ফুটে উঠেছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিকরা যে ছয়টি আসনে ছাড় পেয়ে নৌকা প্রতীকে ভোট করেছে, তার চারটিতেই জয়ের মুখ দেখতে পায়নি তারা। কেবল রাশেদ খান মেনন আর রেজাউল করিম তানসেন জয়ী হয়েছেন। বিজয়ী হয়েছেন বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক।
জাতীয় পার্টির আসন কমে হয়েছে ১১টি। জেপি চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু। আরও হেরেছেন ফজলে হোসেন বাদশা, শমসের মবিন চৌধুরী, তৈমূর আলম খন্দকার, কাদের সিদ্দিকী, শেরীফা কাদের, শামীম হায়দার পাটোয়ারী, মশিউর রহমান রাঙ্গা, মেজর (অব.) আখতারুজ্জামানের মতো অভিজ্ঞ নেতারা । দলের প্রতীক ও সমর্থন পেয়েও জিততে পারেননি বেশ কয়েকজন মন্ত্রী।
তাদের মধ্যে আছেন বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী, ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান। হেরে গেছেন জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী মমতাজ, মেহের আফরোজ চুমকি, আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পদক আবদুস সোবহান ওরফে গোলাপ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাশ। পক্ষান্তরে আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জিতেছেন রেকর্ড ৬২টি আসনে। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা এতগুলো আসনে কখনো জেতেনি।
এবারের নির্বাচনে ভোটারদের অংশগ্রহণ খুব একটা আশাব্যঞ্জক নয়। নির্বাচন কমিশন সূত্রে বলা হয়েছে, ভোট প্রদানের হার ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে সংশয় আছে। আমাদের দেশে ভোটের হার বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। তবে দ্বাদশ নির্বাচনের সবচেয়ে বড় বড় সীমাবদ্ধতার দিক হলো ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাই অংশ নিয়েছে। বিএনপি এবং এর সমমনা দলগুলো অংশ নেয়নি।
কাগজ-কলমে এবারের নির্বাচনে ২৮টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। তার মধ্যে বেসরকারিভাবে ঘোষিত ২৯৮টি আসনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মাত্র পাঁচটি দলের প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। দল পাঁচটি হলো আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও কল্যাণ পার্টি। বাকি ২৩টি দলের কোনো প্রার্থী জয়ের দেখা পাননি। সংবিধান অনুযায়ী, আমরা পাঁচ বছর পরপর নির্বাচন করে থাকি। দুনিয়ার সব গণতান্ত্রিক দেশে এই প্রক্রিয়া আছে। সেখানে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়; কিন্তু বিএনপি ও এর সমমনা দলগুলো অংশ না নেওয়ার কারণে এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ ধরনের কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল না। আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররাই শুধু নির্বাচনে অংশ নেওয়ার কারণে এ নির্বাচন যেন হয়ে যায় অনেকটাই ক্ষমতার ‘নবায়ন।’
বিএনপি এবারও ভোট বর্জন করেছে। বিএনপির এই সিদ্ধান্তে শরিক হয়েছে জামায়াতসহ আরও কয়েকটি দল। বিএনপি নানা ধরনের কর্মসূচির মাধ্যমে চেষ্টা করেছে নির্বাচনি গণতন্ত্রের আবহ নষ্ট করতে। তারা ধারাবাহিকভাবে হরতাল, গণকারফিউ, অসহযোগ ইত্যাদি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। ভোটরদের ভোটকেন্দ্রে না যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। নির্বাচনের দুদিন আগে রাজধানীতে একটি ট্রেনে আগুন দেয়া হয়। এই ঘটনায় অন্তত চারজন দগ্ধ হয়ে মারা যায়। এই ঘটনায় বিরোধীদের দিকেই সন্দেহের আঙুল উঠেছে।
কারণ ভীতি ও ত্রাসের সঞ্চার করে ভোটারদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে যদি ভোটকেন্দ্রকে শূন্য রাখা যায়, তাহলে বিরোধীরা সুষ্ঠু নির্বাচন হচ্ছে না বলে অভিযোগ তোলার সুযোগ পেত। ভোট বাতিলের দাবি তুলতে পারত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে আনতে পারত; কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। কিছুটা কম হলেও ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়েছে। যেসব জায়গায় আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী ছিল সেসব জায়গায় তো রীতিমতো উৎসবের আমেজে ভোট এবং হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে।
এবারের নির্বাচন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলের তৎপরতা ও আগ্রহের বিষয়টিও ছিল লক্ষ্যণীয়। নানা কারণে শুধু ভারতই নয়, চীন-আমেরিকা-রাশিয়া, এমনকী ইউরোপের দেশগুলোও ব্যাপক তৎপরতা প্রদর্শন করে। বিএনপি নেতৃত্ব আশা করেছিল, মার্কিন প্রশাসনের একটা অংশ থেকে তারা সমর্থন পাবে। মার্কিন প্রশাসনের শেখ হাসিনাবিরোধী একটা অংশ অবশ্য বরাবরই বলেছে, শেখ হাসিনা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছেন, ফলে দুর্নীতি ও গণতন্ত্রহীনতা চরমে পৌঁছেছে। এ ধরনের বক্তব্য বিএনপি নেতৃত্বকে উজ্জীবিত করেছে।
তবে শেখ হাসিনা এবার বিএনপিকে মোকাবিলার পাশাপাশি ড. ইউনূস ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও শক্ত হাতে সামলেছেন। হাসিনাবিরোধী শক্তি সেই ২০০৭ সাল থেকেই চেয়েছে নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে; কিন্তু বিএনপি এবং বিরোধীদের এই প্রচেষ্টা সফল হয়নি। এর পেছনে কাজ করেছে শেখ হাসিনার আপসহীন ভূমিকা। আমেরিকার বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা যখন ভোটের আগে ঘন-ঘন ঢাকায় এসে নাক গলানো শুরু করে, তখন শেখ হাসিনা সার্বভৌম স্বার্থ নিয়ে আপস করেননি।
উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে ড. ইউনূসের রয়েছে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ছিলেন ড. ইউনূসের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, সহপাঠী। তিনি বরাবরই ড. ইউনূসকে সমর্থন জুগিয়েছেন। হাসিনা প্রশাসনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছেন। ইউনূসের দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলে কিছু নোবেলজয়ী সেই দুর্নীতির তদন্ত প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে বিবৃতি দেন। আর সেই যৌথবিবৃতিকে সমর্থন করে টুইট পর্যন্ত করেন হিলারি। তার ‘হিলারি ফাউন্ডেশন’ ও ইউনূসের ‘গ্রামীণ ব্যাংক’–এই দুই সংস্থার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ও আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভান অতীতে হিলারির অধস্তন ছিলেন। হোয়াইট হাউস বা পেন্টাগন না থাকলেও তাই স্টেট ডিপার্টমেন্টের একাংশ হাসিনাবিরোধী অবস্থান নেয়।
তার প্রভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবাধ ও শান্তিপূর্ণ ভোট না হলে ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি করে। হিলারি ক্লিনটনের বর্তমান ডেমোক্র্যাটিক শাসনে প্রভাব প্রতিপত্তি যা আছে–ট্রাম্পের রিপাবলিক জামানায় ছিল না। এবারের নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনীতিবিদ হিসেবে শেখ হাসিনার বিচক্ষণতারও প্রমাণ মিলেছে। তিনি জানেন আমেরিকা ছাড়া বাংলাদেশের গতি নেই। কারণ বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার আর্থিক নির্ভরতা রয়েছে। তারা যদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহলে মস্ত বড় বিপদে পড়তে হবে। কারণ বাংলাদেশের রপ্তানি আমেরিকা ও ইউরোপে ভারতের চেয়েও অনেক বেশি।
তাই তিনি সংসদে মার্কিন দাদাগিরির কঠোর সমালোচনা করলেও সদ্ভাব বজায় রাখার অন্য পথগুলোও খোলা রেখেছেন। তিনি খুবই মুনশিয়ানার সঙ্গে আমেরিকার এই রণকৌশলের মোকাবিলা করেছেন। সবদিক সামলে চলার চেষ্টা করছেন শক্ত হাতে। দ্বাদশ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার ক্ষমতা আরও অপ্রতিহত ও নিরঙ্কুশ হয়েছে নিঃসন্দেহে। প্রশ্ন একটাই, তাতে দেশের গণতন্ত্র কি বিপদমুক্ত হলো?
লেখক: কলামিস্ট
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে