Views Bangladesh

Views Bangladesh Logo

আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের ভার্চুয়াল তর্কে ঘৃণা স্পষ্ট হয়ে উঠছে

Mahbub  Sarkar

মাহবুব সরকার

মঙ্গলবার, ২৩ জুলাই ২০২৪

র্জেন্টিনার চক্রটা শুরু হতে পারত ২০১৪ সালে। জার্মানির কাছে হারে উল্টো হতাশা দীর্ঘ হয়েছে। বিশ্বকাপ ফাইনালে আলবিসেলেস্তেদের হারানোর আগে সেমিতে ব্রাজিলকে উড়িয়ে আসে জার্মানরা। ৭-১ গোলে বিধ্বস্ত হওয়ার পর ব্রাজিল সমর্থকরা যে কষ্ট পেয়েছে, আর্জেন্টিনার ফাইনাল হারের দুঃখটা বোধকরি তার চেয়ে বড়! ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ লাতিন দুই দেশের কাছে ছিল হতাশার অধ্যায়। সে হতাশা কাটাতে আর্জেন্টিনা সময়ের সঙ্গে দলটা গুছিয়ে এনেছে; উল্টো পথে হেঁটে অতীত গৌরব ধুলায় মেশানোর উপক্রম ব্রাজিলের! তারপরও ২০২১ সালের কোপা ফাইনালে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনাকে মুখোমুখি দাড় করিয়ে দিয়েছিল।

‘সুপার ক্লাসিকো’ মঞ্চে অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়ার একমাত্র গোলে ব্রাজিলকে হারিয়ে শিরোপা উল্লাস করে আর্জেন্টিনা। ১৯৫০ সালে ট্র্যাজেডির সাক্ষী হয়ে থাকা মারাকানা স্টেডিয়ামে স্বাগতিক দর্শকদের সামনে হার হজম করতে হয়েছিল ব্রাজিলকে। কোপা আমেরিকা শিরোপা দিয়ে রিও ডি জেনিরোর মারাকানায় যে চক্র শুরু হয়েছিল, কাতারের লুসাইল স্টেডিয়াম হয়ে মিয়ামির হার্ড রক স্টেডিয়ামে এসে সেটা শেষ হতে পারত। ২৮ ম্যাচ না হারার রেকর্ড গড়া কলম্বিয়া আলবিসেলেস্তেদের দূরন্ত যাত্রার সমাপ্তি রেখা টানতে পারেনি। ‘কোপা-বিশ্বকাপ-কোপা’ দারুণ এক চক্র সম্পন্ন করল আর্জেন্টিনা। সঙ্গত কারণে দলটির সমর্থকরাও চাঙ্গা। সাফল্যের বিচারে সাম্প্রতিক সময়ে পিছিয়ে থাকলেও, সমর্থকদের লড়াইয়ে কিন্তু আর্জেন্টিনাকে একচুল ছাড় দিতে নারাজ ব্রাজিল ভক্তকুল।

একদল ইট ছুড়ছে, পাটকেল ছুড়ে জবাব দিচ্ছে আরেক দল। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল সমর্থকদের উন্মাদনা। সেটা কখনো মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, ফুটবল সমর্থন রূপ নেয় হানাহানিতে। কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক মেগা আসরে সেটা চরম আকার ধারণ করে। এবারের কোপা আমেরিকা ঘিরে অবশ্য হানাহানির খবর পাওয়া যায়নি; কিন্তু দুই দলের সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরস্পরের প্রতি অশ্রদ্ধা-ঘৃণা স্পষ্ট করছেন। উরুগুয়ের কাছে হেরে ব্রাজিল সেমিফাইনালের আগেই বিদায় নিয়েছে। তাতে সাম্প্রতিক সময় ব্যর্থতার পাকচক্রে বন্দি এ দলকে ঘিরে কটাক্ষও বেড়েছে।

৯ জুলাই মো. ইমান হোসেন নামের এক আর্জেন্টিনা সমর্থক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ব্রাজিল এখনো টুর্নামেন্ট থেকে আউট হয়নি। তারা কানাডা, কলম্বিয়া ও উরুগুয়ে হয়ে বারবার ফিরে আসবে।’ এ সমর্থকের খোঁচা স্পষ্ট- আর্জেন্টিনা যখন যে দলের বিপক্ষে খেলবে, ব্রাজিল সমর্থকরা তখন সে দলকে সমর্থন দেবে। কাজী রবিন নামের অপর এক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘ব্রাজিলের সঙ্গে দেবীদ্বার সরকারি প্রাইমারি স্কুলের একটা প্রীতি ম্যাচ দেখতে চাই।’ সেলেসাওদের ছন্নছাড়া নৈপুণ্যর কারণেই আর্জেন্টিনা সমর্থকের এ খোঁচা। ব্রাজিল সমর্থক ক্রীড়া সাংবাদিক শামসুর রহমান নিজের ভেরিফায়েড ফেজবুক ওয়ালে লিখেছেন, ‘ব্রাজিল সাপোর্টার হয়ে বলছি, এই দলটা চরম ভুয়া খেলতেছে। কোপা জেতার যোগ্য না! বিশ্বকাপে কি করবে কে জানে!’

উরুগুয়ের কাছে ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল হারের পর এসএইচ মামুন নামের এক প্রবাসী আর্জেন্টিনার সমর্থক ফেসবুকে লিখেন, ‘ব্রাজিলের ভাগ্য ভালো উরুগুয়ে তাদের বাঁচিয়ে দিল। নাহলে সেমিতে কলম্বিয়ার জেমস রদ্রিগেজ একাই ব্রাজিলকে…!’ উরুগুয়ের কাছে পাঁচবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ব্রাজিল কোয়ার্টার ফাইনাল হারের পর ফিরোজ আহমেদ সুমন লিখেছেন, ‘শোকাহত ব্রাজিল পরিবারের সমর্থকদের প্রতি জানাচ্ছি গভীর সমবেদনা।’ মাঠের খেলায় বাজে সময় কাটানো ব্রাজিলের কূটনৈতিক দিককে ফোকাস করা পারভেজ অভি নামের এক ফেসবুক ব্যবহারকারী সামনে টেনে আনলেন ফিলিস্তিনের সঙ্গে ব্রাজিলের মুক্ত বাণিজ্যের ঘোষণা-সংক্রান্ত বিষয়। আল শাহরিয়ার রুবেল ব্রাজিল সমর্থকদের কটাক্ষ করে লিখেছেন, ‘পিও ভাইয়েরা হতাশ হইয়েন না, স্পেনের ওপর ভরসা রাখুন। আপনাদের হাতে এখনও স্পেন আছে।’

তার ইঙ্গিত ফিনালিসিমার দিকে। ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন ও কোপা চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনা যে লড়াইয়ে মুখোমুখী হবে, তাকে ফিনালিসিমা বলা হয়। ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলা আর্জেন্টিনা ২০২১ সালের কোপা আমেরিকা এবং ২০২২ সালের কাতার বিশ্বকাপ জিতেছে। সাফল্যের কেবিনেটে সর্বশেষ সংযোজন সদ্যসমাপ্ত কোপা আমেরিকা। সুসময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কারণে লিওনেল মেসিদের নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উপহাস খুব একটা দেখা যাচ্ছে না; কিন্তু চায়ের আড্ডা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কিংবা অফিস আদালতে দুই দলের সমর্থকদের তর্ক-বিতর্ক চলছে অবিরাম। কখনো সেটা সুস্থ যুক্তি তর্কের সীমা ছাড়ায়।

বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১৬ হাজার কিলোমিটার দূরের ব্রাজিল এবং ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরের আর্জেন্টিনাকে ঘিরে কেন এমন অশ্রদ্ধা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত আক্রমণের মতো ঘটনা ঘটছে? জানতে চাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের (বিকেএসপি) সিনিয়র রিসার্চ অফিসার হিসেবে কর্মরত ক্রীড়া মনোবিদ নুসরাত শারমীনের কাছে। উত্তরে তিনি বলেছেন, ‘খেলাধুলা দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত। জাতি হিসেবে আমরা আবেগপ্রবণ। সে আবেগ কোথায় প্রকাশ করতে হবে, কোথায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে- অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমরা বুঝি না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা সমর্থকরাও হয়তো অতিমাত্রায় আবেগ প্রবণ হয়ে যাচ্ছেন। এ কারণে তাদের আচরণ, কথাবার্তা অনেক ক্ষেত্রে হয়তো স্বাভাবিক সীমার মধ্যে থাকছে না।’

খেলাধুলায় জয়-পরাজয় ছিল, আছে এবং থাকবে। প্রায় প্রতিটি খেলার শেষে দুই দলের খেলোয়াড়-কর্মকর্তাদের করমর্দন করতে দেখা যায়, অনেক ক্ষেত্রে একে অপরকে আলিঙ্গন করেন। যা ভ্রাতৃত্বের বন্ধনকে আরও অটুট করে। বাংলাদেশের আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল সমর্থকদের মাঝে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না বরং সেটা ঘৃণা এবং প্রতিহিংসায় ভরপুর হয়ে থাকছে। তার পেছনে কি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ঘাটতি কাজ করছে?- প্রশ্নের জবাবে নুসরাৎ শারমীন বলছিলেন, ‘পারস্পরিক সম্মানবোধ থাকলে কিন্তু যে কোনো কাজে জটিলতার ঝুঁকি কম। এখানেও সেই আবেগের প্রসঙ্গ আসছে। আমরা অনেক ক্ষেত্রে আবেগপ্রবণ হয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাই। বিপত্তিটা বাঁধে সেখানেই।’

ফিফা বিশ্ব র্যাংকিংয়ে শীর্ষে আছে আর্জেন্টিনা। কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেই শীর্ষ স্থান ধরে রেখেছে লিওনেল স্কালোনির দল। তালিকার চার নম্বরে অবস্থান করছে ব্রাজিল। আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের বাইরে এ তালিকায় ইউরোপের অধিপত্য পরিষ্কার। শীর্ষ দশে ইউরোপের বাইরের দলসংখ্যা ওই দুটিই- আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল। ট্রান্সফার মার্কেট ডটকম যে তথ্য প্রকাশ করেছে, তাতে সবচেয়ে দামি দলের তালিকার শীর্ষে কিন্তু ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার কোনো দলই নেই। ১ দশমিক ৫২ বিলিয়ন পাউন্ড মূল্য নিয়ে সবচেয়ে দামি দলের তালিকার শীর্ষে আছে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় স্থানে থাকা ব্রাজিল দলের মূল্য ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন পাউন্ড। ৮০৫ মিলিয়ন পাউন্ড মূল্য নিয়ে তালিকার অষ্টম স্থানে আছে আর্জেন্টিনা।

ওই তালিকার শীর্ষ দশে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা ছাড়া বাকি দলগুলোও ইউরোপের। ওপরের দুটি কেবলই গাণিতিক হিসেব, তা লাতিন দুই দেশের বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা বোঝানোর জন্য যথেষ্ট নয়। গোটা বিশ্বেই ছড়িয়ে আছে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার সমর্থক; কিন্তু বাংলাদেশের মতো দুই দলের সমর্থকদের মাঝে ট্রল করা, আক্রমণাত্মক হওয়ার ঘটনা অন্যান্য দেশে খুব একটা দেখা যায় না। আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলকে ঘিরে যাদের মধ্যে যুদ্ধংদেহী মনোভাব লক্ষ্য করা যায়; তাদের অধিকাংশই বছরজুড়ে বৈশ্বিক ফুটবলের খুব বেশি খোঁজ-খবর রাখেন না। নির্দিষ্ট কিছু আসর ঘিরে; বিশেষ করে বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকার মতো আসরেই তাদের সরব হতে দেখা যায়। নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার বাসিন্দা মাসুম সরকার কট্টর ব্রাজিল সমর্থক হিসেবে পরিচিত।

আশির দশক থেকে ফুটবলের খোঁজ-খবর রাখা এ ফুটবলামোদি নির্দিষ্ট আসরকে ঘিরে সরব হওয়া সমর্থকদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা দুই দলেই বিপুলসংখ্যক বসন্তের কোকিল মার্কা সমর্থক আছেন, যারা সরব হন কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপ মৌসুমে। তাদের উৎপাত এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে, ওই সময় ফুটবলের সৌন্দর্যই উপভোগ করা কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়! অথচ বছরজুড়ে এরা কিন্তু ঘুমকাতুরে অবস্থায় থাকেন। ফুটবল নিখাদ বিনোদনের মঞ্চ। এ মঞ্চটা আমাদের দেশের অতি উৎসাহী কিছু সমর্থক নষ্ট করে দিচ্ছেন। এক পক্ষ আরেক পক্ষের সঙ্গে রীতিমতো যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছেন। ঘটছে ব্যক্তিগত আক্রমণের মত ঘটনা। খেলাধুলার মতো নিখাদ বিনোদনের মাধ্যমে এমনটা কারও কাম্য নয়।’

ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার মাঠের দ্বৈরথের ঝাঁঝ দুই দেশের তারকাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের জনপ্রিয়তায় খুঁজে পাওয়া যাবে না। আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসির ইনস্টাগ্রাম অনুসারীর সংখ্যা ৪৩৩ মিলিয়ন। একই প্ল্যাটফর্মে ব্রাজিলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার নেইমার। ইনস্টাগ্রামে যার অনুসারীর সংখ্যা ২০৪ মিলিয়ন। ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীদের মধ্যে জনপ্রিয়তার তালিকায় তৃতীয় স্থানে আছেন মেসি। তার এক ধাপ ওপরে আছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (৫৫১ মিলিয়ন)। ফোবর্সের মে মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বের সর্বোচ্চ আয় করা ক্রীড়াবিদদের তালিকায়ও আর্জেন্টিনার তুলনায় পিছিয়ে আছে ব্রাজিল। ৩৬ বছর বয়সি মেসির অন-ফিল্ড আয় ৬৫ মিলিয়ন ডলার, অফ-ফিল্ড আয় ৭০ মিলিয়ন।

মোট ১৩৫ মিলিয়ন আয় নিয়ে সর্বোচ্চ আয় করা ক্রীড়াবিদদের তালিকার তৃতীয় স্থানে আছেন আর্জেন্টিনা অধিনায়ক। গলফার জন রাহম (২১৮ মিলিয়ন) দ্বিতীয় স্থানে আছেন। শীর্ষে আছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো (২৬০ মিলিয়ন)। ১০৮ মিলিয়ন আয় করা নেইমার আছেন তালিকার সপ্তম স্থানে। সামাজিক মাধ্যমে অনুসারীর সংখ্যা কিংবা আয়ের দিক দিয়ে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার লড়াই অসম হতে পারে; কিন্তু মাঠের খেলা এবং দর্শকদের লড়াইয়ে তার প্রভাব নেই। সেটা সবসময় ভিন্ন মাত্রায় পৌঁছায়।

মাহবুব সরকার: ক্রীড়া সাংবাদিক ও বিশ্লেষক।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ