ভুলে গেছি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলকে?
১৯৭১ সালের ২৭ মার্চ। কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল করা হলো। যখনই কারফিউ শিথিল করা হয়, তখনই আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বাইসাইকেল নিয়ে প্রথমে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, পরে পলাশী ফায়ার সার্ভিস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠ, রোকেয়া হল, ব্রিটিশ কাউন্সিলের চারদিকে ঘুরেছেন- লাশের পর লাশ দেখেছেন। তারপর তিনি জঘন্যতম গণহত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ওইদিন বিকেলে একজন বিহারির বাসায় জোর করে ঢুকে বন্দুক নিয়ে নেন এবং একটি ছোট দল গঠন করেন। দলকে বোঝান- ‘আমাদের আরও অস্ত্রের প্রয়োজন।’ এর মধ্যে কয়েকজন বিহারির বাসা থেকে অস্ত্র ছিনতাই করেন। পরে এ অস্ত্রগুলো দিয়ে জিঞ্জিরায় প্রথম মুক্তিযুদ্ধের ঘাঁটি করেন।
[মুক্তিযুদ্ধের আগুনমুখো গল্প : হাবীব ইমন]
দুই।
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘মাগো আর তোমাকে ঘুমপাড়ানি মাসি হতে দেব না’, ‘সেই রেললাইনের ধারে মেঠো পথটার পাড়ে দাঁড়িয়ে’, ‘একতারা লাগে না আমার দোতারাও লাগে না’, ‘ও মাঝি নাও ছাইড়া দে ও মাঝি পাল উড়াইয়া দে’, ‘সুন্দর সুবর্ণ তারুণ্য লাবণ্য অপূর্ব রূপসী রূপেতে অনন্য’, ‘এই দেশ আমার সুন্দরী রাজকন্যা’, ‘একাত্তরের মা জননী, কোথায় তোমার মুক্তিসেনার দল’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘আমার বাবার মুখে’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকব’- গানগুলোর সৃষ্টির সঙ্গে যে মানুষটার নাম চলে আসে, তিনি আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। কেন জানি না অগ্নিঝরা স্বাধীনতা মাসে তার কথা মনে পড়ছে।
হয়তো অনেকের তার কথা মনে নেই। জীবদ্দশায় সেই আশঙ্কাই করেছিলেন তিনি, প্রয়াণের ঠিক এক বছর আগে একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেছিলেনও। কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে বিমানবন্দরে বসে ফেসবুকে নিজের তোলা ছবিটি পোস্ট করেন। ছবির ক্যাপশনে লিখেছিলেন, ‘আমাকে যেন ভুলে না যাও... তাই একটা ছবি পোস্ট করে মুখটা মনে করিয়ে দিলাম।’
তিন।
একজন কিশোর মুক্তিযোদ্ধা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। জীবন-মরণ মাঝখানে থেকে যুদ্ধ করেছেন। গোলাম আযম মামলার সাক্ষ্য দিয়েছেন তিনি। ২০১৯ সালের ৯ মার্চ রাতে তার অনুজ মিরাজ আহমেদের মরদেহ কুড়িল উড়াল সেতুর পাশ থেকে উদ্ধার করা হয়। তখন থেকে তিনি একদম চুপচাপ হয়ে যান। তার ভাইয়ের মৃত্যুর পর তিনি সরকারের কাছে তার নিরাপত্তা বৃদ্ধির আবেদন করেন এবং এটাও উল্লেখ করেন যে সাক্ষ্য দেওয়ার পর তিনি বেশ কিছু হত্যার হুমকি পেয়েছেন।
চার।
আর কখনো আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুলের জীবনের সবকটা জানালা খুলবে না; কিন্তু দেশের জানালা খুলে দিয়েছেন তিনি, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে। একের পর এক অসাধারণ গান রচনা করেছেন তিনি। সৃষ্টি করেছেন। ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘ধ্রুপদি’ নামে একটা বই লিখেছেন তিনি। ওই বইতে তার অনেক গীতি কবিতা রয়েছে। আমাকে তিনি সে বইটা দিয়েছিলেন তার স্বাক্ষরিত শুভেচ্ছাসহ।
২০১০ সালের কথা বলছি। আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আমাকে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। মগবাজারের তার সেই বাসায় অনেক কথা বলেছিলেন। সংগীত নিয়ে তিনি একটা গবেষণাধর্মী বইয়ের কাজ করছেন বলে জানালেন।
সাক্ষাৎকারে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল বলেছিলেন, ‘আমি ২ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের নেতৃত্বে যুদ্ধ করি। তখন আমার বয়স সাড়ে ১৪ বছর। আগরতলায় আমরা প্রশিক্ষণ নিই। মনে পড়ে, আমরা চারজন একসঙ্গে রেকি করতাম- মানিক, মাহবুব, খোকা আর আমি। কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত রাস্তায় পাকিস্তানি হানাদাররা কতগুলো দুর্গ করেছে, সেগুলো দেখে আসতাম। একসময় পাকিস্তানিদের হাতে ধরা পড়েছিলাম, ওরা আমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল।’
মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নিয়মিত গান করেন। প্রথমে শুধু দেশের গানই করতেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি একজন গিটারবাদক ছিলাম। যুদ্ধের দিনের কথা মনে হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত সেই রোমহর্ষক দিনগুলোর স্মৃতি, হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য। যাদের হারিয়েছি, অনুভব করলাম, তাদের জন্য কিছু করা দরকার। সেই থেকে টানা আট বছর আমি শুধু দেশের গান করেছি। অন্য গান করিনি।’
কথা ছিল বুলবুল ভাই আমাকে নিয়ে তার গ্রামের বাড়ি যাবেন। কেন জানি তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করলেন। কখনো তার গ্রামে যাওয়া হয়নি। আমাকে পেয়ে তার পিতৃভূমিতে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। তার প্ল্যান ছিল যেতে যেতে আমার সঙ্গে তিনি আড্ডা দেবেন। সেই যাওয়াটা আর কখনো হয়নি। ২০১৯ সালের ২২ জানুয়ারি এ মহান সংগীতসাধক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত হোন। তার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।
হাবীব ইমন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক। প্রেসিডিয়াম মেম্বার, বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে