চিকিৎসা-ব্যবস্থা উন্নত করার জন্য স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণা প্রয়োজন
আধুনিক রাষ্ট্রে জ্ঞান উৎপাদন হয় মূলত প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা থেকে। আর জ্ঞানচর্চার জন্য গবেষণার কোনো বিকল্প নেই। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে জ্ঞানচর্চায় যেমন উৎসাহ নেই, তেমনি গবেষণায়ও নেই। কোনো দেশ জ্ঞানচর্চায় পিছিয়ে থাকলে গবেষণায়ও পিছিয়ে থাকবে অনিবার্যভাবে। আজকের উন্নত দেশগুলো যে পৃথিবীকে নেতৃত্ব দিচ্ছে তার কারণ তাদের উন্নত গবেষণাকর্ম; কিন্তু সম্প্রতি দেশে কিছু কিছু ক্ষেত্রে গবেষণা চলমান থাকলেও আমাদের স্বাস্থ্য খাতে গবেষণা খুবই সীমিত- এমনই হতাশা ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের একটি বক্তব্য গত বছর ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছিল, ‘কোনো বিজ্ঞানী নেই, গবেষক নেই, দার্শনিক নেই। যেদিকেই তাকাবেন, শুধুই প্রশাসক’। কথা হচ্ছে, গবেষক নেই কেন? এটা কি ব্যক্তিগত আগ্রহের অভাব নাকি রাষ্ট্রীয় সহযোগিতার অভাব?
রাষ্ট্রের অসহযোগিতা যে আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রাপ্ত তথ্যমতে, বাংলাদেশ গবেষণায় পিছিয়ে থাকার মূল কারণ- পুরোনো আমলের কারিকুলাম, শিক্ষকদের একটা অংশের বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানের অভাব, দলীয় বা ‘প্রশাসন অনুগত’ শিক্ষক নিয়োগ ইত্যাদি। শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতে প্রয়োজনের তুলনায় বাজেট-বরাদ্দ অনেক কম। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে মোট বরাদ্দ ছিল জিডিপির তুলনায় ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। যা ছিল বাংলাদেশে শিক্ষায় বরাদ্দ ১৫ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন, দক্ষিণ এশিয়ায় সবার নিচে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত জিডিপির শতাংশ হিসেবে বাংলাদেশে শিক্ষা খাতে গড় ব্যয় ছিল ৪১টি স্বল্পোন্নত দেশের মধ্যে পঞ্চম সর্বনিম্ন।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) বৈশ্বিক জ্ঞান সূচকের (গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্সের) তালিকায় বাংলাদেশ প্রতি বছর তলানির দিকেই থাকে। উদ্ভাবনী সূচকে অবস্থা আরো খারাপ। বৈশ্বিক উদ্ভাবনী সূচক বা গ্লোবাল ইনোভেশন ইনডেক্সে (জিআইআই) ২০২৩ সালে তিন ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। ২০২২ সালে জিআইআই সূচকে ১৩২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০২তম। ২০২৩ সালে ১৩২টি দেশের মধ্যে তিন ধাপ পিছিয়ে ১০৫তম অবস্থানে নেমে এসেছে বাংলাদেশ।
এহেন অবস্থায়, দেশে স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণায় জোর দেওয়ার জন্য গত সোমবার (১১ মার্চ) চিকিৎসকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিজ্ঞান ও উন্নত প্রযুক্তির এই যুগে যেসব দেশ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এগিয়ে যাচ্ছে তারাই অর্থনৈতিকভাবে দ্রুত উন্নতি করতে পারছে। কাজেই আমাদের উন্নতি করতে হলে অবশ্যই গবেষণা একান্তভাবে প্রয়োজন।’
যারা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণায় জড়িত থাকবেন তাদের জন্য সরকার বিশেষ প্রনোদনা প্যাকেজ দেবে বলেও জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। অনেক হতাশার মধ্যেও এটা একটা আশার কথা। চিকিৎসক হিসেবে যারা সরকারি চাকরি করছেন, তাদের উদ্দেশ্যেও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, প্রাইভেট প্র্যাকটিস একটু কমিয়ে গবেষণার দিকে নজর দিতে।
আমরাও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পেষণ করতে বলতে চাই, দেশে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে গবেষণা খুবই কম এ কথা সত্য। যেখানে আধুনিক এ সময়ে উন্নত বিশ্ব মেডিকেল শিক্ষায় এগিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন গবেষণা করে। সেখানে দেশের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে গবেষণা এত কম কেন? সে ক্ষেত্রে সংকট তো কোনো না কোনো অবস্থানে আছে। তথ্য বলছে, দেশের মেডিকেল শিক্ষার উন্নয়নে আধুনিক দক্ষ শিক্ষক, অবকাঠামো, যন্ত্রপাতি, ল্যাবরেটরি, গবেষণা-উপকরণের যেমন সংকট আছে, তেমন সংশ্লিষ্টদের গবেষণা করার মনোভাবের ঘাটতি আছে। দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী মেডিকেল শিক্ষা অর্জন শেষ করেই অর্থের পেছনে ছুটতে থাকেন। তারপার একসময় গবেষণার কথা ভুলে যান।
সামগ্রিকভাবে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। তবে, এই পিছিয়ে থাকার একমাত্র কারণ ফান্ড নয়। মূল সমস্যা হলো চিকিৎসক বা মেডিকেল-প্রফেশনালদের মধ্যে গবেষণার সংস্কৃতি বিকশিত হওয়ার সুযোগ না থাকা। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া তাদের মধ্যে গবেষণার আকর্ষণ ও সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। তাই এই ফান্ড ব্যবহারের একটি মূল উদ্দেশ্য হওয়া উচিত তাদের মধ্যে গবেষণার সক্ষমতা বাড়ানো। আর তার জন্য একাডেমিক গবেষণার ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে। আমাদের মনে রাখেতে হবে, উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে হলে আমাদের অবশ্যই একটি জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গড়ে না উঠলে স্বাস্থ্যবিষয়ক গবেষণায়ও অগ্রগতি হবে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বিষয়টি নিয়ে ভাবনার এখনই মোক্ষম সময়।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে