Views Bangladesh Logo

মহান মে দিবস: আসবে কি নতুন আলো

Kamrul  Hasan

কামরুল হাসান

বিপুল উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে আজ দেশে পালিত হচ্ছে ১৩৯তম আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস বা মে দিবস। মে দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়বো এ দেশ নতুন করে’। ৫ আগস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ বছর নতুন করে আশায় বুক বেঁধেছেন শ্রমিকরা, দেখছেন ভাগ্য উন্নয়নের নতুন স্বপ্ন।

গত ৮ আগস্ট ক্ষমতায় এসেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ঘোষণা করেন নতুন প্রত্যয়ে দেশ গড়ার। তারই অংশ হিসেবে গত ১৭ নভেম্বর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদকে প্রধান করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি শ্রম সংস্কার কমিশন গঠন করা হয়।

তবে গত ৯ মাসে অর্ধশতাধিকের ওপরে শ্রমিক আন্দোলন এবং শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নের কোনো দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ না আসায় অনেকে হতাশা প্রকাশ। আবার অনেক শ্রমিক নেতা এবং বিশ্লেষকরা বলছেন, মুক্তিযুদ্ধের পরে শ্রমিকদের জীবনমান এবং সার্বিক পরিস্থিতি উন্নয়নের এতটা উপযুক্ত পরিবেশ আগে আসেনি।

তারা এখন গত ২১ এপ্রিলে শ্রম সংস্কার কমিশনের জমা দেয়া প্রতিবেদন সাপেক্ষে সরকার কি পদক্ষেপ নেয় তার দিকেই চেয়ে আছেন। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে শ্রমিক স্বার্থ সম্পর্কিত শুরু করা পদক্ষেপগুলো অব্যাহত রাখার ওপরেও গুরুত্ব আরোপ করেছেন তারা।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি আনোয়ার হোসাইন বলেছেন, ‘বিগত দেড় যুগেরও বেশি সময়ে শ্রমিকদের শুধু ব্যবহার করাই হয়েছে; কিন্তু তাদের উন্নয়নে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তাইতো সরকার পতনের পরে আমরা এত অস্থিরতা দেখছি। বেতন বৃদ্ধির উন্নয়ন দেখানো হলেও আসলে তাদের জীবনমান প্রকৃতপক্ষে নিম্নগামীই হয়েছে। এদিকে শ্রমজীবী মানুষের আয় দিন দিন কমে যাচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুতের অভাবে কলকারখানা বন্ধ হচ্ছে। এখনো প্রতিদিন শ্রমিক ছাঁটাই চলছে, বেকার হচ্ছে হাজার হাজার শ্রমিক। শ্রমিকের জীবনে অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা আসলেও কোথাও ছিল না।’

‘অবস্থা আরও বেগতিক রূপ ধারণ করেছে যখন পতিত হাসিনা সরকারের লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে সরকারি পাট ও চিনিকলগুলো বন্ধ করে হাজার হাজার শ্রমিককে পথে বসিয়েছে এবং তাদের স্ত্রী সন্তানসহ পুরো পরিবার অর্ধহারে, অনাহানে দিনাতিপাত করছে।’

তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-শ্রমিক-জনতা গণঅভ্যুত্থানে অগনিত শ্রমিকের আত্মদান হাসিনার সরকারের পতনকে ত্বরান্বিত করে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের ৭১ জন নেতাকর্মী, ৩০ জন রিকশা শ্রমিক ও অসংখ্য নাম না জানা শ্রমিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন।’


এদিকে সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, 'যদি গার্মেন্ট সেক্টরের কথা বলি তবে গত কয়েক বছরে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত হয়েছে। তবে কাজের পরিবেশের কিন্তু তেমন উন্নত হয়নি। একইভাবে ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার যেমন পূর্ণগতি পায়নি তেমনি সমষ্টিগত দর কষাকষির পরিবেশও তৈরি হয়নি। আবার ইউনিয়নে যোগদান করলে শ্রমিকদের হুমকি দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে অহরহই।'

নাজমা আক্তারের মতে গার্মেন্ট ব্যবসা সম্প্রসারে যে সস্তাশ্রমের আখ্যান প্রচার করা হয় সেটারও পরিবর্তনের প্রয়োজন আছে। একই সাথে কারখানার মালিক ও সরকারকে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা এবং শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নেও গুরুত্ব দিয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ওসমান আলী বলেন, 'শ্রমিকদের অধিকারে যা কথা বেশিরভাগই গার্মেন্টকর্মী কেন্দ্রিক। মাঝেসাজে কিছুটা কথা হয় পরিবহন শ্রমিকদের নিয়ে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের প্রতি সৃষ্ট বিরূপ ও অসম্মানজনক মনোভাবের কারণে তাদের অধিকারের দিকে নজর দেয়া হয় না। যে কারণে যুগ যুগ ধরে আন্দোলন করেও চালক বা তাদের সহকারীদের জন্য নিয়োগপত্র নিশ্চিত করা যায়নি। আর স্বাস্থ্যগত এবং মানবিক অধিকারতো অনেক দুরাগতই।'

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) পরিচালক নাজমা ইয়াসমিন বলেন, ‘প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা কিছুটা সুবিধা ভোগ করতে পারলেও অপ্রাতিষ্ঠানিক, কৃষি, গৃহভিত্তিক এবং দিনমজুররা তাদের অধিকার থেকে সম্পূর্ণভাবে বঞ্চিত। আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা বলে সরকার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু তা আর প্রতিপালন করে না। বাংলাদেশ হবার পরে, শ্রমিকদের অবস্থা উন্নয়নে এই প্রথম কোনো প্রতিবেদন তৈরি করা হলো যা এপ্রিলের ২১ তারিখে জমা পড়েছে। সরকার তাদের আন্তরিকতা দেখাচ্ছেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তীতে এদেশের শ্রমিকদের ভাগ্যাকাশে পরিবর্তন হয় কিনা, তা সরকারের কার্যক্রমেই বলে দিবে। একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এটাও নিশ্চিত করতে হবে যেনো নির্বাচিত সরকার এলে তারা এই সরকারের নেয়া পদক্ষেপ অব্যাহত রাখে।'

যোগাযোগ করা হলে শ্রম সংস্কার কমিশনের প্রধান সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ভিউজ বাংলাদেশকে বলেন, ‘সব শ্রমিকের আইনি সুরক্ষা ও স্বীকৃতি নিশ্চিতের পাশাপাশি সকলের জন্য পরিচয়পত্র এবং আয়ের নিশ্চয়তা, মর্যাদাকর-শোভন কর্ম পরিবেশ, মর্যাদাকর জীবনযাপন উপযোগী ন্যায্য মজুরি (লিভিং ওয়েজ), উন্নয়নে ন্যায্য অংশীদারত্ব ও হিস্যা প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতই এই প্রতিবেদনের লক্ষ্য।'

একই সঙ্গে অবসর, কর্মঅক্ষমতা, অসুস্থতা, মাতৃত্বকালীন সময় বা যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় সামাজিক নিরাপত্তা প্রাপ্তি এবং কোনো না কোনো সামাজিক নিরাপত্তা স্কিমে অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে বলা হয়েছে।

তিনি বলেন, 'এসব সুবিধা প্রাপ্তিতে সরকারি প্রচেষ্টার যেন ত্রুটি না থাকে, তাই শ্রম খাত সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানভিত্তিক প্রস্তাবনাও করা হয়েছে। শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম অধদপ্তরের নাম পরিবর্তন করে শ্রম পরিদর্শন অধিদপ্তর এবং শ্রম ও শিল্প সম্পর্কিত অধিদপ্তর হিসেবে প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দক্ষতা এবং কর্মসংস্থান উন্নয়ন অধিদপ্তর এবং শ্রমিকের সামাজিক নিরাপত্তা এবং কল্যাণ বিষয়ক অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথাও বলা হয়েছে।'

আজ সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন যে, শ্রম অধিকার এবং শ্রমিক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে, শ্রমিক ও মালিক উভয় পক্ষের স্বার্থ রক্ষা করে শিগগিরই শ্রম আইন সংশোধন করা হবে।

আগামী জুনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সঙ্গে বৈঠক শেষে এ বিষয়ে চূড়ান্ত হবে বলেও জানান তিনি।

শ্রম সংস্কার কমিশনের দেয়া প্রতিবেদনের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রতিবেদন জমা পড়েছে। পর্যালোচনা শেষে যেগুলো আশু বাস্তবায়ন দরকার তা করা হবে এবং বাকিগুলো পরবর্তী সরকার এসে সম্পন্ন করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।

মতামত দিন

মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে

ট্রেন্ডিং ভিউজ