ধ্বংস হয়ে গেছে বগুড়ায় ঐতিহাসিক ‘টাউন ক্লাব’
বগুড়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক অফিসের পাশাপাশি ঐতিহাসিক ‘টাউন ক্লাব’-কেও বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এর আগে, ৫ আগস্ট ক্লাবটিতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়। এতে ক্লাবের বহু পুরনো নথি, ছবি, আসবাবপত্র ও বিভিন্ন ট্রফি পুড়ে যায়।
বৃহস্পতিবার (৬ জানুয়ারি) রাত আটটার দিকে বগুড়ার সাতমাথা টেম্পল রোডে আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের পাশে অবস্থিত টাউন ক্লাবটি দ্বিতীয়বারের মত হামলার শিকার হয়।
যেভাবে শুরু হামলা
ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে, একদল লোক বগুড়া চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রবেশ করে এবং শেখ হাসিনার নামফলক একটি হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে ফেলে। পরে রাত ৮টার দিকে সাতমাথা টেম্পল রোডে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) অফিসে প্রথম হামলা চালানো হয়। এরপর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে ঢুকে সেখানে থাকা কিছু কাঠের বেঞ্চ ও চেয়ার বের করে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।
ধীরে ধীরে হামলাকারীদের সংখ্যা ৭০ থেকে ৮০ জনে পৌঁছে যায়। তারা নওয়াববাড়ি ও স্টেশন রোড থেকে সাতমাথায় এসে একত্রিত হয়। এ সময় তারা টাউন ক্লাব, ছাত্র ইউনিয়ন ও জাসদ অফিসেও হামলা চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা আরও জানান, হামলার সময় কেউ কেউ বলতে শোনা যায়, বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা থেকে একটি বুলডোজার আসছে। সেই বুলডোজার দিয়ে সব অফিস ভেঙে ফেলা হবে। পরে রাত ৯টার দিকে সত্যিই সেখানে একটি বুলডোজার আনা হয়।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপস্থিত অনেকেই হামলাকারীদের ‘টাউন ক্লাব’এর ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানাতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তারা কারও কথা শোনেনি।
ঐতিহাসিক ‘টাউন ক্লাব’
১৮৯৬ সালে প্রতিষ্ঠিত বগুড়ার টাউন ক্লাব ছিল একটি ঐতিহ্যবাহী সংগঠন। এটি এলাকার কয়েকটি প্রভাবশালী পরিবার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়। ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে ২৭ জন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, যাদের অধিকাংশই প্রয়াত। ক্লাবটি জেলা ক্রীড়া সংস্থায় নিবন্ধিত ছিল এবং বহু গৌরবময় ট্রফি অর্জনের ইতিহাস রয়েছে তার। কুচবিহার মহারাজা ট্রফি, গৌর গোবিন্দ মহারাজা ট্রফি, সৈয়দপুর রেলওয়ে ট্রফি অর্জন ছাড়াও ইস্ট বেঙ্গল ও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অনেক সদস্যও একসময় টাউন ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে ক্লাবটির ২০০ জনের বেশি সদস্য রয়েছেন এবং এটি সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে নিবন্ধিত। ক্লাবের ভবনটি জেলা পরিষদ থেকে লিজ নেয়া জমির ওপর নির্মিত ছিল।
টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামাল শামীম জানান, কেন ক্লাবটিতে হামলা ও অগ্নিসংযোগ চালানো হয়েছে, তা স্পষ্ট নয়। ক্লাবের পাশে আওয়ামী লীগ অফিস থাকায় অনেকে সেখানে যেতেন। এটি হয়তো একটি কারণ হতে পারে, অথবা হয়তো ভুলবশত ক্লাবটি গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে।
হামলার পেছনের কারণ
হামলার সময় ধারণ করা একটি ভিডিওতে এক হামলাকারীকে বলতে শোনা যায়, ‘বগুড়ার মাটি বাংলা ভাইয়ের (নিষিদ্ধ সংগঠন জেএমবি নেতা সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই) ঘাঁটি’। ওই সময় টাউন ক্লাব ও বিভিন্ন রাজনৈতিক অফিসে হামলা চালানো হচ্ছিল।
এ বিষয়ে টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামাল শামীম বলেন, ‘আমি নিজেও হামলাকারীদের মুখে শুনেছি- বগুড়ার মাটি বাংলা ভাইয়ের ঘাঁটি।’
হামলার অন্যতম নেতৃত্বে ছিলেন নূর মোহাম্মদ জুবায়ের
বগুড়ার হামলায় নেতৃত্বদানকারীদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন নূর মোহাম্মদ জুবায়ের। গত নভেম্বরে তিনি ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’র ব্যানারে শাক-সবজি বিক্রি করেছিলেন। ভাঙচুরের সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত বছর ১৭ জুলাই ও ৩ আগস্ট আমরা আওয়ামী লীগ অফিসে হামলা চালিয়েছিলাম।’ এবার তারা পিনাকী ভট্টাচার্যের নির্দেশে কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
একজন সাংবাদিক জুবায়েরকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আওয়ামী লীগ অফিস ছাড়াও অন্যান্য অফিস কেন ভাঙা হচ্ছে?’ জবাবে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ অফিস ছাড়া অন্যরা (ভুক্তভোগীরা) চাইলে তাদের অফিস নতুন করে গড়ে তুলতে পারে।’
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, হামলার সময় কোনো আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হামলাকারীদের বাধা দেয়নি। এমনকি ঘটনাস্থলেও কোনো পুলিশ সদস্যকে দেখা যায়নি।
টাউন ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শামীম কামাল শামীম বলেন, ‘আমি কার বিরুদ্ধে অভিযোগ করব? আমাদের অস্তিত্ব বিপন্ন করা হবে, এমন কিছু আমরা করব না। আমাদের পরিবার আছে, জীবন ঝুঁকির মধ্যে ফেলা ঠিক হবে না।’
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে