মাদকের কবলে হলিউড: গ্ল্যামারের আড়ালে তিক্ত সত্য
খ্যাতির লোভ অনেক সময় অন্ধকার জগতে ঠেলে দেয় সেলিব্রেটিদের। হলিউডের চকচকে গ্ল্যামারের মোহে পড়ে মিডিয়ার সজাগ দৃষ্টি, পাবলিক ইমেজ ও বিনোদন জগতের উচ্ছ্বাস টিকিয়ে রাখতে মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন অনেকেই। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বা মোহ কেটে গেলে এ থেকে বের হতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হয় তাদের।
হলিউডে অতি সহজেই মাদকদ্রব্য পেয়ে যান সেলিব্রেটিরা। যখন-তখন মাদক সরবরাহে উন্মুখ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কও রাখেন তারা। হলিউডে মাদকের অপব্যবহার এতটাই প্রবল যে, প্রায়ই পার্টিতে বিদঘুটে পরিবেশ তৈরি হয়।
এ ধরনের নানা অভিযোগ অনেকদিন ধরেই প্রকাশ্যে আনছেন খোদ ইন্ডাস্ট্রির ভেতরের অনেকেই। তাদের মাধ্যমে হলিউডপাড়ার মাদককাণ্ড এবং সেলিব্রেটিদের আসক্তির ভয়াবহতা প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও।
হলিউডে রয়েছে মাদকের অপব্যবহারের দীর্ঘ ইতিহাস। নির্বাক চলচ্চিত্র যুগ থেকেই নানা ধরনের মাদকের কবলে পড়ে আসছেন বিখ্যাত অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। স্টুডিও কালচারের স্বর্ণযুগেও অভিনেতা ও মঞ্চক্রুদের ওষুধে মিশিয়ে মাদক দেয়া হতো- যা স্থায়ী হতো ১৫ থেকে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত।
১৯৪০-এর দশকে হলিউডে ঘটে বেশ কয়েকটি হাই-প্রোফাইল ড্রাগ কেলেঙ্কারির ঘটনা। কিছু ঘটনায় জড়িত ছিলেন ড্রামার জিন কৃপা এবং অভিনেতা রবার্ট মিচাম। ১৯৪৩ সালে মিচামকে টানা ৯০ দিন মাদক পরিবেশন করেছিলেন ড্রামার কৃপা। ১৯৪৮ সালে মারিজুয়ানা রাখার দায়ে অভিনেত্রী লিলা লিডসের সঙ্গে গ্রেপ্তারও হন রবার্ট মিচাম।
সেই যুগে মারিজুয়ানা রাখা নতুন কিছু না হলেও বহু বছর ধরে সেলিব্রেটিদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সেটি। ভয়াবহ মাদক এলএসডি উদ্ভাবিত হয় এ দশকেই।
১৯৫০-এর দশকে গাঁজা ও হেরোইনের ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি হলিউড তারকাদের দিয়ে পরীক্ষা করানো হয় এলএসডিও। সাইকোথেরাপি সেশন বা বিনোদনের অংশ হিসেবে সে সময় এলএসডি ব্যবহার করতে দেয়া হয়েছিল শতাধিক হলিউড তারকাকে। মনোচিকিৎসায় চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে এলএসডির নমুনা গ্রহণ করেছিলেন সাঁতারু ও অভিনয় তারকা এথার উইলিয়ামসও।
১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে হলিউডে এলএসডি নেয়াদের মধ্যে ছিলেন তরুণ তারকা জ্যাক নিকলসন। পরে এলএসডি সম্পর্কে নিজের অভিজ্ঞতাকে ‘সুন্দর ও স্বপ্নীল’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন অস্কার বিজয়ী এ অভিনেতা।
মাদকাসক্তির রোমহর্ষক ঘটনাগুলো উঠে আসে ৭০ দশকের হলিউডি সিনেমাগুলোতেও। বিশ্বজুড়ে ড্রাগিস্টদের দৈনন্দিন গল্প বিশদভাবে ছড়িয়ে দেন তরুণ নির্মাতা মিশেল অ্যান্তনিও চিমিনো তার ‘কোপ্পলা’ এবং ‘স্কোর্স’ সিনেমার মাধ্যমে।
মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও আসক্তির পর তা কীভাবে কাটিয়ে উঠছেন, সেসব নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কথা বলেছেন অসংখ্য তারকা। তবে ‘তারকা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর’- হলিউডের বাসিন্দাদের ওপর থাকে নানা চাপও। অনেক নেগেটিভ বিষয়কেও তাদের পজেটিভ করে বলতে হয়, যেন ওই দেশের কোনো বদনাম না হয়।
মাদকাসক্তি থেকে পরিত্রাণে চ্যালেঞ্জিং যুদ্ধের মুখোমুখি হওয়া একজন বিখ্যাত অভিনেতা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র। ১৯৮০’র দশকের শেষের দিকে শুরু হওয়া তার মাদকাসক্তি অব্যাহত ছিল বেশ কয়েক বছর, যা তার ক্যারিয়ার ও ব্যক্তিগত সম্পর্কসহ জীবনের বিভিন্ন দিককে উল্লেখযোগ্য ও নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।
মাদকের কবলে পড়ে ২০০৮ সালে মারা যান অভিনেতা হিথ লেজার। তার শরীরে বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া যায়, যা তৈরি হয়েছিল ছয় ধরনের মাদক থেকে। ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এ অভিনয় শেষ করার পরপরই তার মৃত্যু ঘটে। পরের বছর ২০০৯ সালের অস্কারে ওই ছবির সেরা সহ-অভিনেতা হিসেবে মরণোত্তর একাডেমি পুরস্কার দেয়া হয় তাকে।
জীবদ্দশাতে হিথ লেজার স্বীকার করে গেছেন যে, মাদকের ভয়াবহতায় তার জীবনটাই হয়ে ওঠে চাপের উৎস। এসব চাপ ও অনিদ্রা দূর করতে ব্যথানাশক, অ্যান্টি-অ্যাংজাইটি- এমনকি ঘুমের ওষুধও নিতে বাধ্য হতেন তিনি।
হলিউড তারকা ম্যাথিউ পেরির করুণ মৃত্যুর ঘটনা উঠে এসেছে নতুন ডকুমেন্টারি ‘ফ্রেন্ডস’-এ। গত বছরের অক্টোবরে কেটামাইনের ওভারডোজে মারা যান তিনি। গোপনে সেলিব্রেটিদের মাদকচক্রে যুক্ত হন পেরি, যা কয়েক বছর ধরে বেড়েই চলেছে হলিউডে।
‘টিএমজেড ইনভেস্টিগেটস ম্যাথিউ পেরি অ্যান্ড দ্য সিক্রেট সেলিব্রিটি ড্রাগ রিং’ শিরোনামের ডকুমেন্টারিতেও প্রথমবারের মতো উঠে এসেছে ম্যাথিউ পেরিসহ অন্য তারকাদের নানা ঘটনা। এতে মাদকের অপব্যবহারের পেছনে অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে ডাক্তারদের নেটওয়ার্কের দিকেও। ডকুমেন্টারিটিতে বলা হয়েছে, তারকাদের মাদক ও ওষুধ সরবরাহে জড়িত খোদ চিকিৎসকরাও।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে