পঁচাত্তরের ২৫ জানুয়ারি কীভাবে পাস হয়েছিল ‘বাকশাল’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে দুর্ভিক্ষ এবং জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি নতুন ধরনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নিয়ে বঙ্গবন্ধু এগোতে থাকেন- তিনি যেটিকে বলতেন ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’- সেই বিপ্লব কায়েমের অংশ হিসেবে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদে পাস হয় সংবিধানের বহুল আলোচিত (এবং বিতর্কিত) চতুর্থ সংশোধনী বিল। যে সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচনের বিপুল ভোটে জয়লাভ করে সরকার গঠন করবে, সে বিষয়ে কারও সন্দেহ ছিল না। কিন্তু মুশকিল হলো, রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের এই আধিপত্য দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আনেনি। ভারতে যেমন শুরুর দিকে কংগ্রেসের প্রভাবশালী অবস্থান জাতি গঠনের প্রক্রিয়ায় সহায়তা করেছিল এবং একটি স্থিতিশীল সংসদীয় গণতন্ত্রের বিকাশকে উৎসাহিত করেছিল, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের একক আধিপত্য জাতি গঠনের বিপরীতে কর্তৃত্ববাদী প্রবণতাকে উসকে দিয়েছে।
প্রথম সংসদীয় নির্বাচনে বিপুল বিজয় সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ সরকার আন্ডাগ্রাউন্ড চরমপন্থি দলগুলোর আক্রমণ অথবা প্রকাশ্যে কার্যক্রম পরিচালনাকারী বিরোধী দলগুলোর হাত থেকে রেহাই পায়নি। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে সরকার প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। কয়েকটি জেলায় ‘চরমপন্থি’ হিসেবে চিহ্নিত গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালানো হয়।
বাকশাল গঠনের অব্যবহিত পূর্বে দেশ দুর্ভিক্ষের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। এরই মধ্যে তার অবসান ঘটলেও জরুরি অবস্থা জারি হওয়ায় সারা দেশে একটা গুমোট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। গোপন চরমপন্থি দলগুলোর মধ্যে সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে সর্বহারা পার্টি বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক ধ্বংস ও নাশকতামূলক তৎপরতায় লিপ্ত হয়। ১৯৭৫ সালের ২ জানুয়ারি চট্টগ্রাম থেকে সিরাজ সিকদারকে গ্রেপ্তার করে ঢাকায় নিয়ে আসা হয় এবং ওই রাতেই পুলিশের গুলিতে তিনি নিহত হন। সিরাজ সিকদারের এই মৃত্যু নিয়ে পরবর্তীকালে দাবি করা হয় যে, তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্য করা হয়েছে।
ওই সময়ের কিছুটা চিত্র পাওয়া যাবে অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হকের লেখায়: সরকারের সমালোচনার ও সরকার-বিরোধী আন্দোলনের প্রতি সরকার অবলম্বন করেছিল কঠোর দমননীতি। তখনকার রক্ষীবাহিনীর ভূমিকায় বিরোধী দলগুলো এবং জনসাধারণও যথার্থ আতঙ্কের মধ্যে ছিল। জাসদ ১৯৭৪ সালের ১৭ মার্চ হঠাৎ করে সরকার-উৎখাতের চরম আন্দোলন আরম্ভ করতে গেলে দলের কিছু কর্মী পুলিশের গুলিতে নিহত হন, দলটির সব নেতা ও নেতৃস্থানীয় কর্মী কারাগারে বন্দি হন। দলটির জন্য এই কার্যক্রম ছিল আত্মঘাতী। ওই সময়ে বামপন্থি কোনো কোনো গ্রুপ শ্রেণিশত্রু খতমের লাইন অবলম্বন করে চরম বিপর্যয়ে পড়ে।
১৯৭৪ সালে দেখা দেয় ভয়াবহ খাদ্যাভাব ও মন্বন্তর। সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো তখন সদর্থক লক্ষ্য নিয়ে অভিপ্রেত নেতৃত্বদানে সক্ষম হয়নি; কিন্তু সমাজের স্তরে স্তরে বিরাজিত অপব্যবস্থা, দুর্নীতি ও অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ ছিল রক্তক্ষয়ী, সংঘাত-সংঘর্ষ ছিল দৈনন্দিন ব্যাপার। জনমত তখন ভীষণভাবে সরকারের ও আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল। সেই চরম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির শেষদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব কোনো দলীয় প্রস্তুতি ছাড়াই দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়ে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুসরণে একদলীয় রাজনীতি ও সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন আরম্ভ করেন। (আবুল কাসেম ফজলুল হক, রাজনীতিতে ধর্ম মতাদর্শ ও সংস্কৃতি, জাগৃতি প্রকাশনী/২০১৬, পৃ. ৫০)।
কীভাবে পাস হলো বাকশাল?
১৯৭৫ সালের ১৯ জানুয়ারি থেকে গণভবনে আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক শুরু হয়। আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যরাও বিশেষ আমন্ত্রণে বৈঠকে যোগ দেন। জাতীয় সমস্যাগুলো সমাধানের বিষয়টি আলোচনা করতে গিয়ে গোটা প্রশাসনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। বৈঠকে বঙ্গবন্ধু বিরোধী দলগুলোর মতোই নির্দয়ভাবে নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও তীব্র সমালোচনা করেন। তিন দিনে সাত ঘণ্টার তীব্র বাদানুবাদের মধ্যে দিয়ে বৈঠকের পরিসমাপ্তি ঘটে। বৈঠকে বিভিন্ন ধরনের মতামতের প্রতিফলন ঘটলেও সরকারি পরিকল্পনা তার নির্ধারিত পথেই এগিয়ে চলে।
মিজানুর রহমান চৌধুরীর ভাষায়: যারা এর পক্ষে বলেন তাদের যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি প্রকাশিত হতে থাকে। যেমন, ‘বঙ্গবন্ধু আপনি যাই করেন সেটাই ভালো, যে সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই সঠিক এবং যা বলেন, সেটাই শেষ কথা’ ইত্যাদি। কাজেই পক্ষে বলাটা খুবই সহজ। কিন্তু এর মধ্যে নেতৃবৃন্দের কেউ কেউ গোপনে আলাপ আলোচনা করে সাব্যস্ত করেন, বাকশাল কোনো অবস্থাতেই সমর্থন করা যাবে না। সে হিসেবে সভায় জেনারেল ওসমানী, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন ও নূরে আলম সিদ্দিকী অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ জোরালো বক্তব্যের মাধ্যমে একদলীয় শাসন ব্যবস্থার তীব্র বিরোধিতা করলেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখেছেন: সংসদীয় দলের বৈঠকের শেষ দিন ২১ জানুয়ারি আমি বক্তৃতা করবো বলে স্থির করলাম। পায়জামা-পাঞ্জাবির পরিবর্তে স্যুট-কোট পরে ওইদিন বৈঠকে যোগদান করি। ১৯৬৮-৬৯ সালে স্যুট-কোটের পরিবর্তে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরার অভ্যাস করেছিলাম। পাকিস্তান পার্লামেন্টে সব সময় আমি স্যুট-কোট পরেই যোগদান করতাম। যা হোক, এদিন আমি হলে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু তার সামনের সোফায় উপবিষ্ট মন্ত্রীদের মধ্যে সেরনিয়াবাত এবং ফরিদ গাজীর মাঝখানে আমাকে বসতে বললেন। সভার কাজ শুরু হওয়ার পর সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলোচনার সূত্রপাত করলেন এই বলে ‘বঙ্গবন্ধু, আপনি সরকার পদ্ধতি সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে যাচ্ছেন সেটা আসলে কী এবং কেন এই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, তা নিজ মুখে বুঝিয়ে বলুন। আপনি যা বলবেন তা-ই গৃহীত হবে এবং পরে তা আইনে পরিণত করা হবে।’
সৈয়দ নজরুলের এই বক্তব্যের পর বঙ্গবন্ধু বলেন যে, তিনি সংসদীয় পদ্ধতির সরকারের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে চান। বহুদলীয় গণতন্ত্রের পরিবর্তে একদলীয় সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে আগ্রহী। এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু আরো বলেন, তিনি কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে চান না। উপস্থিত সংসদ সদস্যগণ আলোচনার মাধ্যমে যা স্থির করবেন সেটাই তিনি গ্রহণ করবেন। বঙ্গবন্ধু এই সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে এর ওপর আলোচনা করার আহ্বান জানান।
মিজানুর রহমান চৌধুরী লিখছেন: আমি তখন আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য দাঁড়াই। আমার সামনে বঙ্গবন্ধু এবং চার সিনিয়র নেতা উপস্থিত। আমি কথা শুরু করার ক্ষণেই তিনি আকস্মিকভাবে দাঁড়িয়ে আহ্বান জানালেন, ‘যারা আমার বক্তব্য সমর্থন করো, তারা হাত উঠাও।’ পলকের মধ্যে সভাস্থলে হাত উঠে গেলো। আড়ালে দুচারজন হাত না তুললেও এমনভাবে বসেছিলেন যাতে তারা বঙ্গবন্ধু দৃষ্টির আড়ালে থাকতে পারেন। অবশ্য সে সময় জেনারেল ওসমানী ও মইনুল হোসেন সভাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না। সম্ভবত নূরে আলম সিদ্দিকীও অনুপস্থিত ছিলেন। আমি বক্তৃতার জন্য দাঁড়িয়ে আছি, ওদিকে হাত উঠানো হয়ে গেলো। তখন বঙ্গবন্ধু খুব উচ্চ স্বরে আমাকে বললেন, বস বস। এ অবস্থায় আমি আর কী বক্তৃতা করবো। অগত্যা বসে পড়লাম। তিনি ইঙ্গিতে আমাকে হাত তুলতে নির্দেশ দিলেন। আমি মাথা নেড়ে হাত তুলতে অস্বীকার করলাম। এখানেই সভার সমাপ্তি। সভায় জাতীয় সমস্যা সমাধানে যে কোনো পদক্ষেপ নেয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা হলো। (মিজানুর রহমান চৌধুরী, রাজনীতির তিন কাল, অনন্যা/২০০৩, পৃ. ১৫৪)।
বিল উঠল সংসদে
ঘটনার চার দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেন। জাসদের সংসদ সদস্য আব্দুস সাত্তার বিলের বিরোধিতা করে এর ওপর আলোচনার দাবি জানান এবং সংশোধনী প্রস্তাব দেয়ার কথা বলেন। তিনি এ ধরনের বিলের আগে ৭ দিন বা ৩ দিনের নোটিশ প্রদানের প্রসঙ্গ তুলে ধরেন; কিন্তু জাতীয় সংসদের স্পিকার বিলটির তৃতীয় পাঠের সময় আলোচনার সুযোগ হবে মর্মে জানান। যদিও পরে বিলটি তিন মিনিটের ভেতর ২৯৪-০ ভোটে পাস হয়ে যায়। (কাজী জাহেদ ইকবাল, বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনী ১৯৭২-১৯৯৮ প্রেক্ষাপট ও পর্যালোচনা, ধ্রুবপদ/২০১৬, পৃ. ৬৫)।
দ্বিতীয় পাঠে সংসদে বিলটি পাস হওয়ার মুহূর্তে জাসদের সংসদ সদস্য আবদুস সাত্তার (টাঙ্গাইল-১), মইনুদ্দিন আহমদ (রাজশাহী ১১), আবদুল্লাহ সরকার (কুমিল্লা-২৫) এবং স্বতন্ত্র সদস্য মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (পার্বত্য চট্টগ্রাম-১) সংসদ কক্ষ ত্যাগ করেন। (মহিউদ্দীন আহমেদ, একদলীয় সরকার যেভাবে এলো, গ্রন্থিক প্রকাশন/জানুয়ারি ২০২৪, পৃ. ২৭৯)।
১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি গণকণ্ঠের খবর: ‘সংবিধানের বিশেষ বিধি অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হয়েছেন। গতকালই তিনি শপথ গ্রহণ করেন। সংশোধিত সংবিধানে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে। দায়িত্ব রাষ্ট্রপতির ওপর। সংবিধানের সংশোধনী সম্পর্কে আলোচনা বন্ধের প্রতিবাদে জাসদসহ বিরোধীদলীয় চার সংসদ সদস্য সংসদ কক্ষ থেকে ওয়াকআউট করেন।’
মওদুদ আহমদ লিখেছেন: নজিরবিহীন ন্যূনতম সময়ের মধ্যে বিলটি সংসদে গৃহীত হয় এবং আইনে পরিণত হয়। অত্যন্ত গরুত্বপূর্ণ হলেও বিলটি নিয়ে সংসদে কোনো আলোচনা ও বিতর্কই অনুষ্ঠিত হয়নি। দলের ভেতরে এই ইস্যুতে দ্বিভাবিভক্তি থাকলেও মুজিবের তেজোদীপ্ত ভাবগম্ভীরতা ও ব্যক্তিত্বের কাছে নিজেদের সত্তা বিসর্জন দেয়া ছাড়া অন্যান্যদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। চাটুকার নেতৃবৃন্দ পরিবেষ্টিত অবস্থায় শেখ মুজিবের সর্বশক্তিমত্তা ছিল বৈঠকের মূল কেন্দ্রবিন্দু। যদিও এমএজি ওসমানি ও মইনুল হোসেনের মতো নেতারা সরকারের রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা না করে দল থেকে পদত্যাগ করেন।’ (মওদুদ, প্রাগুক্ত, পৃ. ৩১৪)। অধিবেশন শেষ হবার অব্যাবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। আর উপরাষ্ট্রপতি পদে নিয়োগ দেন সৈয়দ নজরুল ইসলামকে।
সরকারি দল আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং ন্যাপ (মোজাফফর) ছাড়া অন্য সকল দল চতুর্থ সংশোধনীর বিরোধিতা করে। বিরোধী দলগুলো চতুর্থ সংশোধনীকে অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী ও ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিপীড়ন করার কৌশল বলে এর সমালোচনা করে। তবে আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাপ ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর অংশ এবং ‘বাস্তব অবস্থার নিরিখে’ চতুর্থ সংশোধনী আনা অপরিহার্য বলে মত ব্যক্ত করে। (জালাল ফিরোজ, পার্লামেন্টারি শব্দকোষ, বাংলা একাডেমি/১৯৯৮, পৃ. ১০১)।
বদলে গেলো রাষ্ট্রকাঠামো
এই বিল পাশ হওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্রব্যবস্থার এক ঐতিহাসিক পরিবর্তন সাধিত হয়। একদিকে যেমন একদলীয় শাসন প্রচলন করা হয়, একই সঙ্গে রাষ্ট্রপতির ওপর নির্বাহী (প্রশাসন), আইন ও বিচার বিভাগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ অর্পিত হয়। বিল পাশের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নতুন আইনবলে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে সীমাহীন একক ক্ষমতা দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপতি সংসদ কিংবা কারো কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য নন। চতুর্থ সংশোধনীতে রাষ্ট্রপতিকে গুরুতর অসদাচরণের জন্য অপসারণ করতে সংসদের তিন-চতুর্থাংশ সদস্যের সমর্থনের বিধান রাখা হয়। (ড. সুলতান মাহমুদ, বাংলাদেশ সংবিধান প্রেক্ষিত এবং প্রাসঙ্গিকতা, আলেয়া বুক ডিপো/২০২১, পৃ. ৯১)।
সংসদে বিল পাস করে চলমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ বাকশাল গঠনের দিন থেকে নতুনভাবে পাঁচ বছর করে নেয়া হয়। ধারণা করা হয়েছিল, এ দেশের মানুষ সমাজতন্ত্র পছন্দ করে, সুতরাং বাকশালকে সমাজতন্ত্র মনে করে বাকশালকে প্রবলভাবে সমর্থন দেবে; কিন্তু তা হয়নি। দ্বিতীয় বিপ্লব ও বাকশালের প্রতি জনগণের মধ্যে আস্থার বদলে সৃষ্টি হয়েছিল ভয়াবহ আতঙ্ক। বাকশালের প্রতি এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। দিল্লি-মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্র সহ্য করতে পারছিল না। ফলে দ্বিতীয় বিপ্লবের কার্যক্রম বেশি দূর এগোতে পারেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সকাল হওয়ার আগেই ঘটে যায় মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি।
পরিশেষে, ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ যে বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, তাকেই ১৯৭৫ সালে একটা নতুন বিপ্লবের সূচনার জন্য সংবিধানে এই যে বিরাট পরিবর্তন আনতে হয়, তার পেছনে ছিল ওই সময়ের রাজনীতি ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি। এই সংশোধনীটি আনা হয় একটি সম্পূর্ণ পরিবর্তিত ও নতুন রাজনৈতিক কর্মসূচি শুরু করার জন্য। যে কারণে বদলানো হয় দেশের রাজনৈতিক দলের কাঠামো, রাষ্ট্রের রাজনৈতিক পদ্ধতি, রাষ্ট্রের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনিক পদ্ধতি। সর্বোপরি নেয়া হয় একটি সম্পূর্ণ নতুন অর্থনৈতিক কর্মসূচি। যদিও সেটি সফল হওয়ার আগেই চতুর্থ সংশোধনী বিল পাসের সাত মাসের মধ্যে সপরিবারে তিনি নিহত হন।
আমীন আল রশীদ: সাংবাদিক ও লেখক।
মতামত দিন
মন্তব্য করতে প্রথমে আপনাকে লগইন করতে হবে